“গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ” মহাকবি কাজেম আল কোরায়শী ওরফে কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১) -এর জীবনের শেষ রচনা। সম্ভবত বাংলা ভাষায় গাউছে পাক রদ্বীয়াল্লাহু ‘আনহু’র পূর্ণাঙ্গ জীবনী সংক্রান্ত এটিই প্রথম ও একমাত্র কাব্যিক আখ্যান। এ মহাকাব্য লেখার প্রেক্ষাপট এখানে কিঞ্চিত তুলে ধরছি।
মহাকবি কায়কোবাদ ‘আলাইহির রহমাহ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন কলকাতার তালতলাস্থ মোদিনীপুর দরবার শরীফের পীর, গাউছে পাকের ২১ তম বংশধর, সাইয়্যিদ এরশাদ আলী আল-কাদেরী আল-বাগদাদী’ রদ্বীয়াল্লাহু ‘আনহুর মুরীদ এবং আঞ্জুমানে কাদেরিয়া ত্বরীক্বার সালেক। কবি কায়কোবাদ অত্যন্ত বৃদ্ধ বয়সেও ঢাকা থেকে যেতেন খানকায়। নিতেন মুর্শিদের নসীহত ও সহবত।
১৯৪৭ সাল। শায়্যখ এরশাদ আলী রদ্বীয়াল্লাহু ‘আনহু একদিন তাঁকে বললেন- “ভাই কবি সাহেব, আপনি তো অনেক বই ও কবিতা লিখেছেন। এবার হযরত বড়পীর গাউছে পাক জিলানীর জীবনীর উপর কিছু লিখুন।” কবি কায়কোবাদ স্বীয় মুর্শিদের এই অনুরোধের বহু আগে থেকেই অসুস্থতাজনিত কারণে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তথাপি মুর্শিদের কাছে তিনি সবিনয়ে জানালেন, “ইয়া হুজুর পাক, আমার শরীরের যে অবস্থা, তাতে আমার ভয় লাগছে, যদি কাজ শেষ হবার আগে আমি মারা যাই, তবে বেয়াদবি হবে।” শায়্যখ এরশাদ আলী কবিকে অভয় দিয়ে বললেন, “ভাই যদি একবার লেখা শুরু করেন, লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার মরণ আসবে না।”
[সূত্রঃ (১) গ্রন্থের ভূমিকায় কবি-কন্যা জাহানারা বেগমের বক্তব্য, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯; (২) শাহজাহান মোহাম্মদ ইসমাঈল রচিত “গাউসে পাকের প্রেমের কুঞ্জে বাংলার দুই কবি”; (৩) তফিজ উদ্দীন কাদেরী’র ফেইসবুক পোস্ট, ১৮ আগস্ট, ২০১৯]
মুর্শীদের অনুরোধ আদেশসম। তাই ঢাকায় ফিরে এসে মহাকবি বড়পীরের জীবনীসংক্রান্ত পুস্তকাদি পাঠে মনোনিবেশ করলেন। ইতোমধ্যে ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো৷ [সূত্রঃ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লিখিত কবি-কন্যা জাহানারা বেগমের বক্তব্য, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯]
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাস শেষে কবি একে-একে লিখে ফেললেন ৪ খন্ডের এই মহাকাব্য। নাম দিলেন, “গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ”। এর প্রথমে জুড়ে দিলেন, গওছে পাকের সৌজন্যে রচিত কিছু মানক্বাবাত। প্রথম মানক্বাবাতটি ২১ স্তবক বিশিষ্ট, নাম, “গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ।” আর দ্বিতীয় মানক্বাবাতটি ২২ স্তবক বিশিষ্ট, নাম “প্রেমের সুরা।” এ দু’টি মানক্বাবাত থেকে কয়েক লাইন উল্লেখ করছিঃ-
গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জে
ফুটেছে অই গোলাব ফুল!
কে লইবি? আয় না ছুটে
টগর চাঁপা জুই বকুল।সে যে বড় দুর্গম স্থান
হিংস্র জন্তু সদা চরে!
যেতে হবে ঐপথটি দিয়ে
গওছ পাকের আলো ধ’রে।গওছ পাক সেই পথ দেখিয়ে
নিয়া যাবে তাহার পাশে!
তারি প্রেমের ফুল-বাগানে
ব’সে আছি যাওয়ার আশে!
এ দু’টো মানক্বাবাতের পর থেকেই মূল মহাকাব্য শুরু হয়েছে। মূল কাব্যটি ৪ খন্ডে বিভক্ত।
১ম খন্ডে রয়েছে ৪টি সর্গ বা অধ্যায়, যেখানে গাউছে পাকের পিতা-মাতার (তাঁদের সবার প্রতিই মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন) ঘটনা থেকে শুরু করে দস্যুদল কর্তৃক গাউছে পাকের কাছে তওবা ও ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে।
২য় খন্ডটি ৫টি সর্গে বিভক্ত। এ খন্ডে বাগদাদে গাউছে পাকের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে নিয়ে বাগদাদে ২৫ বছর কাল সাধকের জীবনযাপন করা, মুহিউদ্দীন নামের কারণ, ওয়াজের সূচনালগ্ন এবং এক সঙ্গীতজ্ঞের তওবার ঘটনাসহ আরও বহু বর্ণনা বিবৃত হয়েছে।
৩য় খন্ডে রয়েছে মোট ৩টি সর্গ। এতে রয়েছে আল-গাউছুল আযমের শিক্ষাদান পদ্ধতি, দৈনিক কার্যাবলী, মুরীদগণের প্রতি নসীহত ও অভয় দান, রচিত গ্রন্থাবলী, উপদেশসমূহ, “আমার ক্বদম সকল ওলীর কাঁধের উপর” সংক্রান্ত আলোচনা ও পারিবারিক জীবন সংক্রান্ত বর্ণনা।
৪র্থ খন্ডে রয়েছে ২টি সর্গ। ১ম সর্গে বিবৃত হয়েছে গাউছে পাকের পারিবারিক জীবন, তাঁর কয়েকজন পুত্রের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং কারামতসমূহের বিবরণ। এছাড়া মহাকাব্যের শেষ দিকে গাউছে পাকের ওফাতের সময়কার ঘটনাবলী ও শেষ নসীহতসমূহ উঠে এসেছে আলাদাভাবে। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটেছে এ কাব্যিক আখ্যানের।
কবি এ কাব্যগ্রন্থটি লেখার ৩ মাস পরই ইন্তেকাল করেন। কবির শেষ ইচ্ছানুযায়ী কাব্যগ্রন্থটি তাঁর ওফাতের ২৮ বছর পর ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে কবির নাতি আবুল হেনা সাদউদ্দীন কর্তৃক ঢাকার সেগুনবাগান থেকে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এই ১ম সংস্করণ দুষ্প্রাপ্য হলেও একটি কপি সাইফুল ইসলাম রুবাইয়াৎ ভাইয়ের কাছে রয়েছে। বইটি স্ক্যানিংয়ের জন্য দেয়ায় রুবাইয়াৎ ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রুবাইয়াৎ ভাইয়ের সৌজন্যে ১ম সংস্করণের পৃষ্ঠাগুলোর ছবি তুলে রেখেছিলাম ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় পিডিএফ করা হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে এ বছর মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে সেসব ছবি প্রয়োজনীয় ফটোশপ, এডিটিং, ক্রপিং ইত্যাদি করে পিডিএফ বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। পিডিএফটির মান আশানুরূপ না হলেও তা ১ম সংস্করণ দর্শনে আগ্রহীদের কৌতুহল মেটাবে ইন শা’আল্লাহ।
১ম সংস্করণের পিডিএফ লিংক (২৭ এমবি): (ক্লিক করুন)
আলহামদু লিল্লাহ, সম্প্রতি বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত কায়কোবাদ রচনাবলী (৪র্থ খন্ড) এক ‘পুরনো বই’ বিক্রেতা থেকে খরিদ করি এবং এতে শেষ কাব্য হিসেবে “গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ”-এর অন্তর্ভুক্তি দেখে যার-পর-নাই পুলকিত হই। এ সংস্করণটি – বলা যায় – মহাকাব্যটির পিডিএফ নিয়ে পুনঃউদ্যমে কাজ করতে আমায় অনেকাংশে উৎসাহিত করে। এছাড়া, গত কয়েক বছরে ফেইসবুকে বেশ কয়েকজন পাঠকের বারংবার জিজ্ঞাসা ও পিডিএফ পাওয়ার জন্য আগ্রহ আমায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
১ম সংস্করণ আর বাংলা একাডেমী সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য হলো, ১ম সংস্করণে ভূমিকা ও মানক্বাবাত দু’টো, গ্রন্থের শুরুতে স্থান পেয়েছিলো। তবে বাংলা একাডেমী সংস্করণে এগুলো মূল কাব্যের শেষে “পরিশেষ” অংশে স্থান পেয়েছে। এছাড়া, ১ম সংস্করণে আলাদা সূচিপত্র রয়েছে, যেটি বাংলা একাডেমী সংস্করণে স্থান পায়নি। তবে টাইপিং ও ফন্টের বিচারে আমার কাছে বাংলা একাডেমী সংস্করণই অধিকতর প্রাঞ্জল মনে হয়েছে। তাই এই সংস্করণ দিয়ে একটি মানসম্পন্ন পিডিএফ উপহারের প্রয়াস নিয়েছি৷ আর মানসম্পন্ন পিডিএফ তৈরি করতে গিয়েই সপ্তাহখানেক সময় লেগে গেলো। তাই আশা করি, যারা ইতঃপূর্বে পিডিএফ-এর জন্য বারবার তাগাদা দিয়েছেন, তারা এই বিলম্বকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বাংলা একাডেমী সংস্করণের ৩ ধরনের পিডিএফ করা হয়েছে। ১মটি অল্প জায়গাবিশিষ্ট হওয়ায় মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য, ২য়টি কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য (বড় স্ক্রিণে পড়ার জন্য) আর ৩য়টি তাদের জন্য, যারা বইটি পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করতে আগ্রহী।
বাংলা একাডেমী সংস্করণের পিডিএফ লিংকঃ
মোবাইল ভার্শন (৯ এমবি) (ক্লিক করুন)
কম্পিউটার ভার্শন (১০৭ এমবি): (ক্লিক করুন)
প্রিন্ট ভার্শন (৯৭৫ এমবি): (ক্লিক করুন)
পরিশেষে প্রত্যাশা করি, যেনো এ পিডিএফ সংস্করণের মাধ্যমে পাঠকগণ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থটি পাঠ করে উপকৃত হতে পারেন। আরো বোধ করি, কবি কায়কোবাদ ‘আলাইহির রহমার এ রচনাটি তাঁর জন্য নাজাতের উছিলা হবে ইন শা’আল্লাহ।