প্রশ্নঃ প্রচলিত মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান যে রীতিতে আয়োজন ও পালন করা হয়, তা তো হুবহু মহানবী ﷺ কিংবা সাহাবা, তাবেঈন ও তাবেউ তাবেঈনের যুগে ছিলো না। কাজেই, তা শরীয়তসম্মত হয় কিকরে?
উত্তরঃ প্রথম তিন যুগে বা খায়রুল কুরুনে কোনো রীতি না থাকলে, তা পরবর্তীকালের মুসলিমরা পালন করতে পারবেন না, এমন কোনো কথা বা শর্ত শরীয়তের মূলনীতি নয়। বরং, শরীয়তের মূল নীতিমালা হলো কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস, ইসতিহসান (জনকল্যাণকর), ইসতিদলাল (যুক্তিযুক্ত), উরফ (প্রচলন), আদত (অভ্যাস)। এগুলোর যেকোনো এক বা একাধিক মূলনীতি অনুসারে কোনো রীতি পালন করলেই, তা শরীয়তসম্মত হবে।
আর এই বৈধতা শুধু রীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং যেকোনো বস্তু ব্যবহার এবং লেন-দেনের ক্ষেত্রেও হতে পারে। কেননা, শরীয়ত শুধু রীতি সিদ্ধ কি সিদ্ধ হবে না, এমন ফয়সালা দেয় না। বরং কোনো বস্তু গ্রহণ বা বর্জন কোনো ভিত্তিতে করতে হবে, তারও ফয়সালা দেয়। আর এ ফয়সালার ভিত্তিই হচ্ছে, উপরে উল্লিখিত ৮টি মূলনীতি।
আমাদের সমাজে সিহাহ সিত্তাহ নামে প্রচলিত হাদীছের ছয়টি সংকলন কিতাব মূলত খায়রুল কুরুনের পরেই বা ফিতনার যুগেই সংকলিত হয়েছিলো। এগুলোর কোনোটিরই এমন প্রাচীন হস্তলিখিত পান্ডুলিপি পাওয়া যায় না, যা কিতাবগুলোর লেখকের যুগের কাছাকাছি সময়ে সংকলিত। তারপরও কিন্তু মুসলিমরা এ কিতাবগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া কিংবা এগুলো থেকে হাদীছ বর্ণনা করা বন্ধ করেনি। বরং এগুলোর প্রতি আস্থা রেখেছে। কেননা, এগুলোর পান্ডুলিপি ও বর্ণনা কিয়াস, উরফ ও ইসতিদলাল অনুসারে সিদ্ধ। একইভাবে, খায়রুল কুরুনের পর রচিত ও প্রকাশিত বহু আলেমের বহু কিতাবের বর্ণনা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা হয়েছে।
একইভাবে, বহু রীতি, অনুশীলন ও ব্যবহার বর্তমানে যেভাবে করা হয়, খায়রুল কুরুনে হুবহু সেভাবে ছিলো না এবং অনেক ক্ষেত্রে, সেগুলোর অস্তিত্বই ছিলো না। যেমন,
১. প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন, মাইকিং, চাঁদা নেয়া এবং ওয়াজকারীকে মোটা অংকের টাকা দেয়া। বিভিন্ন সাজে, বিচিত্র ব্যানারে, সামিয়ানা টানিয়ে, আলোকসজ্জা করে ওয়াজ মাহফিলের যে আয়োজন বর্তমানে প্রচলিত আছে, তা খায়রুল কুরুনে মোটেও ছিলো না।
২. ওয়াজকে পেশা হিসেবে নেয়া এবং এ কাজের জন্য ওয়াজকারী কর্তৃক অর্থ দাবি করার প্রচলন খায়রুল কুরুনে ছিলো না।
৩. জুমআ ও ঈদের নামাজে বহুল প্রচলিত সিরিয়ার আলেপ্পোর তৎকালীন খতীব ইবনে নাবাতার (৩৩৫-৩৭৪ হিঃ) খুতবা, যা রচিত হয়েছে খায়রুল কুরুনের অনেক পরে! এছাড়াও পড়া হয় দেওবন্দের আশরাফ আলী থানভীসহ খায়রুল কুরুন-পরবর্তী বিভিন্ন আলেম লিখিত খুতবা।
৪. প্রচলিত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন পদ্ধতি অনুসরণ না হলে, বিয়ে খারিজের প্রচলিত সিস্টেম। রেজিস্ট্রেশনের কয়েকদিন আগে শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে পড়ানো হলেও, রেজিস্ট্রেশন না থাকায়, বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। এই নিবন্ধনের সিস্টেম খায়রুল কুরুন কিংবা উপনিবেশের আগেও ছিলো না।
৫. বিয়ের ঘটকালি কিংবা কাযী কর্তৃক বিয়ে পড়ানোকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যাপারটি খায়রুল কুরুনে ছিলো না।
৬. মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে খতমে বুখারী শরীফের প্রচলন রয়েছে। অথচ, খায়রুল কুরুনে বুখারী শরীফই ছিলো না!
৭. ইমামতি ও আযান দেয়াকে পেশা হিসেবে নেয়া। অথচ, খায়রুল কুরুনে কেউ এ দুটো পেশা হিসেবে নিয়েছে, এমন নজির নেই।
৮. কয়েকজনের কাফেলা নিয়ে মুসলিমদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কিংবা রাস্তা-ঘাটে মুসলিমদের দাঁড় করিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে, ইসলামের বাণী শোনানোর পদ্ধতি কোনোভাবেই খায়রুল কুরুনে ছিলো না।
৯. মসজিদ্গুলোতে নামাজ ও খুতবার সময় মাইক ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে এই গত শতাব্দীতে।
১০. মসজিদ-মাদ্রাসায় তো খায়রুল কুরুনে বৈদ্যুতিক বাতি-ফ্যান বা যান্ত্রিক সুব্যবস্থাও ছিলো না! অথচ, তা এখন প্রায় সব মসজিদ-মাদ্রাসায়ই আছে।
১১. বহুতল মসজিদের ভবন নির্মাণের বহুল প্রচলন শুরু হয়েছে গত শতাব্দীতে। অথচ, খায়রুল কুরুনে দ্বিতল কোনো মসজিদ বা নামাজ পড়ার জায়গা ছিলো না।
১২. গ্রাম্য সালিশ বা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কোনো অপরাধের রায় দেয়া এবং অভিযোগের নিষ্পত্তি করার পদ্ধতি একটি খায়রুল কুরুন-পরবর্তী বিচার পদ্ধতি। খায়রুল কুরুনে এবং এর পরেও রাজ্য নির্ধারিত বিচারক বা কাযী কর্তৃক বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হতো।
১২ই রবিউল আউয়ালের সাথে সঙ্গতি রেখে ১২টি পয়েন্ট উল্লেখ করলাম। আশে-পাশে তাকালে এবং একটু চিন্তা করলে, আপনারাও এমন বহু ব্যাপার, রীতি ও বস্তুর ব্যবহার পাবেন, যা খায়রুল কুরুনে ছিলো না। যেমন, বর্তমান ট্রাফিক আইন, বিচার প্রক্রিয়া, জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব নিবন্ধনের পদ্ধতি, সামরিক যুদ্ধের পদ্ধতি ইত্যাদি। কিন্তু পরবর্তীকালে ফকীহগণ শরীয়তের এই ৮টি মূলনীতির কোনো এক বা একাধিক নীতিতে ফেলে, সেসব মুসলিমদের জন্য শরীয়তসিদ্ধ বলে রায় দিয়েছেন।
আবার, খায়রুল কুরুনের সবকিছুই যে আমাদের জন্য শরীয়তসিদ্ধ হয়ে যাবে, তা নয়। যেমন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈকেরামের অংশগ্রহণে যেসব যুদ্ধ হয়েছে এবং সেগুলোতে স্বজাতি মুসলিমদের নিহত ও আহত হওয়ার যেসব ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, হাদীছ ও ইতিহাসের কিতাবগুলোতে বর্নিত থাকলেও, আমাদের জন্য অনুসরণীয় বা শরীয়তসিদ্ধ হয়ে যায়নি।
অথচ, মীলাদুন্নবী ﷺ পালন ও প্রচলিত মীলাদুন্নবীর ﷺ অনুষ্ঠানও শরীয়তের এই ৮টি মূলনীতির যেকোনোটি অনুসারে সিদ্ধ। যেমন,
সুরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াত ও সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াত অনুসারে, মীলাদুন্নবী ﷺ উপলক্ষে উৎসব করা কুরআন সিদ্ধ। বিভিন্ন হাদীছ থেকে জানা যায়, নবীজীর জন্মসংক্রান্ত আলোচনা করা আল্লাহর রসূলের ﷺ নিজের এবং সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত। হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা, সেসব রাজ্য ও সাম্রাজ্যের আলেমগণের ইজমার দলীল। একইভাবে, অসংখ্য ন্যায়পন্থী ও বিশ্ববিখ্যাত আলেমের বরাতে আমরা জেনেছি, উৎসব ও আয়োজন করে শরীয়তের বিধিনিষেধের মতে, মীলাদুন্নবী ﷺ পালন করা জনকল্যাণকর এবং উত্তম আমল, যা ইসতিহসানের দলীল। একইভাবে, এই রীতি যুক্তিযুক্তও বটে, কেননা আমাদের নবীই আমাদের জন্য অনুগ্রহ এবং তাঁর আগমন ও তাঁর উম্মতের মধ্যে আমাদের অন্তর্ভুক্তি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের দলীল। ফলে এটি ইসতিদলাল-এর মূলনীতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য। একইভাবে, উরফ (প্রচলন) মূলনীতি অনুযায়ী, প্রচলিত মীলাদুন্নবীর ﷺ নিয়ম যে শরীয়তসিদ্ধ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একইভাবে প্রচলনের কারণে, মীলাদুন্নবী ﷺ বিশ্বের ৩৬টি মুসলিম দেশে সরকারী ছুটি ছাড়াও বাৎসারিক আনন্দের দিনে পরিণত হয়েছে, যা মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক ইতিবাচক অভ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, হালুয়া-রুটি বানিয়ে প্রতিবেশী ও গরীবদের মাঝে বন্টন করা, মীলাদুন্নবী উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো, নতুন জামা-কাপড় পরিধান করা এবং আলোকসজ্জা করা। এগুলো আদত বা অভ্যাসেরই দলীল।
কাজেই, মীলাদুন্নবীর ﷺ প্রচলিত অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি করলে, বর্তমানে প্রচলিত অসংখ্য অনুশীলন-অনুষ্ঠান-রীতির ব্যাপারেও আপত্তি উঠবে, যা খায়রুল কুরুনে ছিলো না; অথচ, আপত্তিকারীরা নিঃসঙ্কোচে করে যাচ্ছে! তাই সংখ্যালঘুদের মীলাদুন্নবীর ﷺ প্রতি বিরোধিতা অনর্থক বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
✍ মুহাম্মাদ যাহিদ হাসান আল-মাতুরীদী