তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গত মাসে ক্রিমিয়া বিষয়ক সম্মেলনে ভিডিও এক বক্তৃজতায় বলেছিলেন: ‘আন্তর্জাতিক আইনের শর্ত মোতাবেক, ইউক্রেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্রিমিয়ার ইউক্রেনে ফেরা জরুরী।’ যারা তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন – তারা নিশ্চয়ই তাঁর এ বক্তব্যে খুব একটা অবাক হবেন না। একদিকে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি এরদোয়ানের সমর্থন – অন্যদিকে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে অংশ নিতে অস্বীকার – তাঁর এ বিপরীতমুখী তথা ভারসাম্যপূর্ণ কিংবা আরো পরিষ্কার করে বললে – অনবদ্য কৌশলগত অবস্থানের উদাহরণ এ বক্তব্যটি। দেখার বিষয় যে, ক্রেমলিন যখন ইউক্রেনে নাজুক অবস্থায় পড়েছে – তখন রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে চোখ রাখছে তুরস্ক। সিরিয়া হোক কিংবা দক্ষিণ ককেশাস – যেখানেই আপাতদৃষ্টিতে রশিয়ার প্রভাব কমছে – সেখানেই আঙ্কারা শূন্যস্থান পূরণে প্রস্তুত!
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসনের পর, তুরস্ক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছে। জুলাইয়ে আমরা দেখেছি, জাতিসংঘের সহায়তায় তুরস্কের মধ্যস্থতায় ওডেশা বন্দর থেকে ইউক্রেনে শস্য রপ্তানি শুরু হয়। তুরস্কের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যচুক্তি আরো প্রসারিত হচ্ছে। এরদোয়ান এখনো ক্রিমিয়া ইস্যুতে ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছেন। ক্রিমিয়াবাসী তাতারদেরকে তুরস্ক স্বজন বলে মনে করে। ইউক্রেনে তুরস্কের সমর্থনের প্রমাণ হলো – তুরস্ক ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীকে বায়রাকটার ড্রোন দিচ্ছে।
২০০৮ সালে জর্জিয়া যুদ্ধের পর, কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার প্রভাব বাড়াকে তুরস্ক হুমকি হিসেবে দেখে। তাছাড়া, রাশিয়া যখনই বাফার স্টেটসে (সীমান্তের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে) তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে – তখন তুরস্ক তাদের সাথে অভূতপূর্ব ভালো ব্যবহার করছে। তুরস্ক অবশ্য কৃষ্ণসাগরীয় অন্যান্য দেশের সাথেও মিত্রতা গড়ে তুলেছে, বিশেষত যারা রুশ আগ্রাসনে ভীত; যেমন- ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, রোমানিয়া ও মালদোভা। বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, তুরস্ক বরং আরেক দফা এগিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে! যেমন- উত্তর সিরিয়ায়। মে থেকে এরদোয়ান তাল রিফাত ও মানবিজ এলাকা থেকে পিপলস প্রটেকশন ইউনিট বা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি সমর্থিত ওয়াইপিজিকে সরাতে আক্রমণ করার কথা বলে আসছেন। তুর্কি বাহিনী এবং তাদের মিত্র সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ফোরাত নদের পশ্চিমে ও কোবানে, আইন ইসা ও তাল তামের থেকে পূর্বদিকে কুর্দিস যোদ্ধাদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। একই সাথে এরদোয়ান এ বিষয়ে রাশিয়া ও ইরানকে পেতে কূটনৈতিক জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ইরানের তেহরানে ২১শে জুলাই’র ত্রিদেশীয় সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সাথে আলাপে সিরিয়াই ছিলো এরদোয়ানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এমনকি ৫ই আগস্ট রাশিয়ার সোচিতেও পুতিনের সাথে বৈঠকে এ বিষয়ে আলাপ করেন এরদোয়ান। রাশিয়া ও ইরানকে পেতে তাঁর এ পরিকল্পনা আক্রমণাত্মক। কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি সুবিধা আদায় করতে চান। এখন ভাবনার প্রশ্ন যে, পুতিনের সেখানে এগোনো ঠিক হবে কিনা – যেখানে তুরস্ক একতরফাভাবে আক্রমণে যাচ্ছে?
একই কথা প্রযোজ্য দক্ষিণ ককেশাসের ক্ষেত্রেও। জুলাইয়ে তুরস্ক ও আর্মেনিয়া ১৯৯০’র দশকের পর, সীমান্ত খুলে দিতে একমত হয়। তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার কূটনীতিকরা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন। আসলে তুরস্কের ভয়েই আর্মেনীয়দের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতির জন্যে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে আজারবাইজান যখন তুরস্কের সহায়তায় নাগার্নো-কারাবাখে আর্মেনীয়দের পরাজিত করে – তখন রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্ক কার্যত ভণ্ডুাল হয়ে যায়। মোটের ওপর – রাশিয়া সেখানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এবং আর্মেনীয় সেনারা নিজেরাই লড়াই করে। এখন আর্মেনীয় নেতৃত্ব বাস্তবতা বুঝে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক গড়ছে। আর তাতে তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উপকারও হচ্ছে। সিরিয়া কিংবা আর্মেনিয়া – উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে – তুরস্ক পদ্ধতিগত বা কৌশলগতভাবে রাশিয়াকে তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও অঞ্চল থেকে হটিয়ে দিচ্ছে – যেখানে সম্প্রতি ভূরাজনৈতিক শত্রুতা সত্ত্বেও কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করেছিলো।
অস্বীকারের উপায় নেই যে, রাশিয়া চাইলেই তুরস্কের এসব পদক্ষেপ থামিয়ে দিতে পারে। বিক্ষিপ্তভাবে হলেও রাশিয়ার এখনো ইরান ও সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সাথে বন্ধুত্ব এবং ওয়াইপিজির সাথে এক ধরনের অংশীদারিত্বও রয়েছে। নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যে সংঘাত – সেখানে রাশিয়া ২ হাজার শক্তিশালী শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েন করেছে – যেখানে এসব সেনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বৈকি। আর্মেনিয়ার সাথে সম্পর্কে রাশিয়ার অর্থনৈতিক উপকারিতাও রয়েছে। তাদের মাঝে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে। কেননা, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আর্মেনিয়া এখন রাশিয়ার পেছনের দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উভয় তরফ থেকে যুদ্ধ-বিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও গত সোমবার আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মাঝে সংঘাত নতুন করে শুরু হয়।
এখনো যারা মনে করছেন যে, ইউক্রেনের যুদ্ধ দিনশেষে শুধু রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের যুদ্ধ – তারা যুদ্ধটা অনেক দূর থেকে দেখছেন। এখন রাশিয়া আগ্রাসন বন্ধ করলে, তুরস্ক কিংবা অন্য কোনো জাতি সেখানে তাদের কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারে তৈরি হয়ে আছে।
সূত্র: মূল – দিমিতার বেচেভ; ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক কার্নেগি ইউরোপের ভিজিটিং স্কলার, আল-জাজিরা; ঈষৎ সংক্ষেপে বঙ্গানুবাদ মাহফুজুর রহমান মানিক; সম্পাদনা: রুবাইয়াৎ।