চীনে উশু মার্শাল আর্টে উনবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন যিনি, তিনি কোনো বৌদ্ধ নন, নন কোনো নাস্তিক। তিনি এমন একজন মুসলিম গ্র্যান্ডমাস্টার, যার নাম মুসলিম হওয়ার পরও চীনের আধুনিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
চীনা মুসলিম কিংবদন্তি শায়খ ওয়াং যি পিং (১৮৮১-১৯৭৩)
তাঁর নাম ওয়াং যি পিং (১৮৮১-১৯৭৩)। জন্মগ্রহণ করেন চীনের উত্তরে হেবেই প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত চ্যাংঝোও অঞ্চলের এক হুই মুসলিম পরিবারে। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন মুসলিম মার্শাল আর্ট গুরু। এ অঞ্চলের হুই মুসলিমরা ইসলাম চর্চার পাশাপাশি কুংফ্যু-কে নিজেদের জীবনযাত্রার সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সেখানকার মসজিদগুলোতে নামাজের পর মুসলিমরা জড়ো হয়ে কুংফ্যু অনুশীলন করতো এবং এখনও করে। মীলাদুন্নবী, পহেলা মুহররম, রমজান মাসসহ বিভিন্ন ইসলামী দিবস উপলক্ষ্যে মসজিদগুলোতে আয়োজন করা হয় চিত্তাকর্ষক ও বিনোদনধর্মী কুংফ্যু প্রতিযোগিতার। ঐতিহাসিকভাবে কুংফ্যু যেমন চীনা মুসলিমদের আত্মরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তেমনি তা তাদের কয়েকজনকে নিয়ে গিয়েছে খ্যাতির শীর্ষে। সেসব মুসলিম কুংফ্যু মাস্টারদের একজন ছিলেন ওয়াং যি পিং। তিনি ছিলেন হানাফী মাযহাব এবং নকশবন্দীয়া তরীক্বার অনুসারী।
চীনা মুসলিম কিংবদন্তি শায়খ ওয়াং যি পিং (১৮৮১-১৯৭৩)
মাস্টার ওয়াং যি পিং এর ব্যাপারে একটি চমৎকার কাহিনী চীনাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশেষ করে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের চেতনা প্রকাশে এ কাহিনী চীনাদের মুখে মুখে চলে। কাহিনীটি হচ্ছে, তখন চীনে জার্মানদের উপনিবেশ চলছে (১৮৯৮-১৯১৪)। শায়খ ওয়াং যি-ও তখন বেশ তরুণ এবং মার্শাল আর্টে বেশ নাম করেছেন। একদিন ক্বিনঝোও অঞ্চলের একটি মসজিদের প্রাচীন সদর দরজা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে বলে আগমন করলো জার্মান সেনারা। তখন শায়খ ওয়াং যি জার্মান সেনাপতিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন এই বলে যে, ভার উত্তোলনে যদি তাকে জার্মানদের কেউ হারাতে পারে, তাহলে তারা সেই দরজা নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ভার উত্তোলন করতে গিয়ে জার্মান সেনাপতিসহ সেনাদলের কেউই শায়খ ওয়াং যি’র কাছে টিকতেই পারেনি। জার্মান বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়ে ময়দান ছেড়ে পালায় এবং মসজিদের দরজা চীনাদের অধীনেই রয়ে যায়, যা আজও সেখানে রয়েছে। তিনি ভার উত্তোলনে এতোটাই পারদর্শী ও শক্তিশালী ছিলেন যে, তাঁকে “হাজার পাউন্ড লোক” বলে আখ্যায়িত করা হয়।
এভাবে শায়খ ওয়াং যি একে-একে হারিয়েছেন, ব্রিটিশ, এমেরিকান, রাশানসহ বহু দেশী-বিদেশী মুষ্টিযোদ্ধা এবং মার্শাল আর্ট মাস্টারকে। চীনের সাম্রাজ্য ও সম্ভ্রম রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি “উশু’র সিংহ” নামে খ্যাতি লাভ করেন। উশু হচ্ছে চীনা মার্শাল আর্ট বা আত্মরক্ষার কৌশল। কেউ কেউ উশুকে কংফ্যু’র আধুনিক সংস্করণও বলেন।
হুই মুসলিমদের মাঝে নকশবন্দীয়া তরীক্বার প্রসার ঘটেছিলো। ফলে, শায়খ ওয়াং যি পিং এ তরীক্বা অনুসরণ করার সুযোগ পান। তিনি যখন এ তরীক্বা চর্চা করতে থাকলেন, তাঁর শক্তিমত্তা, বিচারবুদ্ধি এবং আত্মরক্ষা-কৌশল যেনো আরও শাণিত হতে লাগলো। তিনি সূফী চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আত্মরক্ষার কৌশল – শ্যাওলিন, উশু, চাক্বুয়ান, হাক্বুয়ান সহ অন্যান্য কৌশল দীক্ষা দিতে থাকেন। তিনি আত্মরক্ষার কৌশলের উপর দু’টি প্রসিদ্ধ বই রচনা করে যান।
বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শায়খ ওয়াং যি (‘আলাইহির রহমাহ) ৯২ বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে এক অনুপ্রেরণার নাম। মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র রূহকে ইল্লিয়ীন নসীব করে তাঁর কবরকে প্রশস্ত করে দিক।