মূলকথা, যারা দাবি করে থাকেন, গিরিশ্চন্দ্র সেন বাংলায় কুরআনের প্রথম অনুবাদক, তাদের বেশিরভাগই পরিস্কার করে উদ্ধৃতি দেন না যে, গিরিশচন্দ্র সেন সম্পূর্ণ কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক নাকি তার আগে আর কেউ বঙ্গানুবাদ করেছেন? এ কারণে ঐ সব উদ্ধৃতির রেফারেন্স দিতে গিয়ে অনেকেই নিজের অজান্তেই বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়িয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, গিরিশ্চন্দ্র সেন ১৮৮৬ সালে সম্পূর্ণ আল-কুরানের প্রথম অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
তবে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে গিরিশ্চন্দ্র সেন নন, বরং মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া (রঃ) যিনি গিরিশ্চন্দ্র সেনের জন্মেরও ২৭ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে কুরআন শরীফ প্রথম সফলভাবে বঙ্গানুবাদ করেন। তবে মাওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়ার (রঃ) এ অনুবাদটি ছিল আংশিক অর্থাৎ শুধুমাত্র আমপারার অনুবাদবিশেষ।
আমীরউদ্দিন বসুনিয়া (অনেকে ‘আমিরুদ্দীন’ নামটিও ব্যবহার করে থাকেন) (রঃ) ছিলেন পূর্ব বাংলার রংপুর জেলার গঙ্গাচড়ার মটকপুরের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মাওলানা ও পুঁথি সাহিত্যিক।
আল-কুরআন বঙ্গানুবাদের পথিকৃৎ মাওলানা আমীরউদ্দীন বসুনিয়া মটুকপুরী (রঃ) যে যুগে (এখন থেকে ২০৬ বছর পূর্বে) অনুবাদ করেন তখন অত্যন্ত বিপজ্জনক যুগ ছিল, কারণ সে যুগের মানুষের ধারণা ছিল কুরআন-হাদিস থাকবে উর্দু ও ফার্সিতে। কবি আবদুল কাদির তার সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা নিম্নরূপঃ
“রংপুর জেলার মটুকপুরের আমীরউদ্দিন বসুনিয়া বাংলা ভাষায় আমপারা শরীফের প্রথম অনুবাদ করেন। তাঁহার বইখানি সম্বন্ধে ১৩১৫ সালে রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার তৃতীয় ভাগ ১২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়, এই বইখানি সেকালের কোনো লিথো প্রেসে মুদ্রিত। আকার ডিমাই ১২ পেজি- ১৬৮ পৃষ্ঠা। ইহা এখন দুষ্প্রাপ্য। ‘বাসনা’ সম্পাদক কাকিনা নিবাসী ফজলল করিম (১৮৮০-১৯৩৮) সাহেব একখণ্ড অনেক চেষ্টায় সংগ্রহ করিয়াছেন। অনেকের ধারণা যে গিরিশচন্দ্র সেনের অনেক আগে আমীর উদ্দীন বসুনিয়ার অনুবাদ প্রকাশিত হয়ে ছিল। উহা সংগ্রহ করা অত্যাবশ্যক; তাহা হইলে উহার প্রকাশকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ সম্ভব হইবে।”
এই ছিল কবি আবদুল কাদিরের মন্তব্য।
অতি সম্প্রতি আল-কুরআন একাডেমি পরিচালক হাফেজ মুনির উদ্দিন মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়ার (রঃ) ‘আমপারা’ অনুবাদের প্রকাশকাল উদ্ধার করেছেন, আর তা হলো ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের এই তারিখই সর্বপ্রাচীন। অর্থাৎ আমীরউদ্দিন বসুনিয়াই (রঃ) হচ্ছেন আল-কুরাআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক।
এই ঐতিহাসিক তথ্যের সমর্থন রয়েছে ঢাকা ও কলকাতার প্রায় সব ক’জন কুরআন গবেষকের লেখায়। উভয় বাংলার প্রায় সব ক’টি কুরআন গবেষণা সংস্থা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই এ ব্যাপারে একমত যে, মওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়াই (রঃ) সে সৌভাগ্যবান মানুষ যিনি বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের এই মহান কাজটির শুভ সূচনা করেন।
মাওলানা আমীরউদ্দিন (রঃ) রচিত কুরআনের ১ম বঙ্গানুবাদের একটি কপি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের (১৮৬৯-১৯৫৩) কাছে মজুদ ছিল বলে তাঁর ‘বাংলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে এর কোন কপির সন্ধান পাওয়া যায় নি। তিনি এতে মাওলানার অনুবাদ গ্রন্থের শেষ এবং শুরুর চরণগুলো উল্লেখ করেছেন।
‘শুরু এই কেতাবের নামাতে আল্লাহর
দয়াময় দয়ালু বহুত রহমত যাহার
সকলি তারিফ আছে ওয়াস্তে আল্লাহর
পালনেওয়ালা সেই সারা সংসার।’
শেষের অংশ-
‘আর যত কাফের কহে তাহারা সবে
হায় হায় মাটি হৈতাম হৈতো ভাল তবে
মাটি হৈলে হেছাব কেতাব নাহিত দিতে হৈতো
আজ এত দুষ্কুর তবে নাহিত মিলিত।’
মাওলানা আমীরউদ্দিনের (রঃ) এই অনুবাদ গ্রন্থটির মূল কপি সম্পর্কে ডঃ মুজিবুর রহমানের ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায় যে, সৈয়দ আলী আহসান ও মতিয়ুর রহমান বসুনিয়ার বরাত অনুযায়ী একটি কপি কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারের ৫০২ নম্বর সংখ্যায় মজুদ ছিলো। এটিই যে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের প্রথম অনুবাদ এ ব্যাপারে গবেষকদের মাঝে আর দ্বিমত নেই। এই অনুবাদটির কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে- এর কাগজ ছিলো ডিমাই, সাইজ ১২ পেজি, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬৮, ছাপা- কারও মতে লিথো প্রেস (উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উদ্যোগে ১৭৭৭ সালে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের প্রচলন হয়), আবার কারো মতে কাঠ বা পাথরের ব্লকে ছাপা হতে পারে। চীনামাটি বা পোড়ামাটির ফলকেও ছাপা হতে পারে বলে ধারণা ক, মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া (রঃ) থেকে গিরিশ চন্দ্র সেন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮০৮ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে আরো ৯ জন ব্যক্তি আল-কুরআন অনুবাদ করেছেন। সুতরাং, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়,
কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক মওলানা আমীরুদ্দিন বসুনিয়া (রঃ) কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করে যেতে পারেন নি বটে, কিন্তু তাঁর এ মূল্যবান অবদান অনুপ্রাণিত করেছিল পরবর্তী যুগের অনেক বাংলা ভাষা-ভাষী পন্ডিতদের যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন মুসলিম সমাজকে একটি ভুল-ভ্রান্তিবিহীন ও পরিণত অনুবাদগ্রন্থ উপহার দেয়ার জন্যে।
(সমাপ্ত)
তথ্যসূত্রঃ-
১। মাসিক মদীনা, আগষ্ট ২০০৪, প্রশ্নোত্তর পর্ব পৃষ্ঠা ৪৭
২। মাসিক আল-হুদা, ফেব্রুয়ারী ২০১০ সংখ্যা
৩। গ্রন্থঃ কোরআন শরীফ সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, রচয়িতাঃ হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমদ, আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, মার্চ ২০০২
ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন এখানে।
৪। দৈনিক ইনকিলাব, ইসলামী জীবন সংখ্যা, ১১ অক্টোবর, ২০০৯
ডাউনলোড
৫। গ্রন্থঃ আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদঃ প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান, রচয়িতাঃ আলী হাসান তৈয়ব, ২০১২।
ডাউনলোড
৬। বাংলা ভাষায় আল-কুরআনের অনুবাদ, মামুন মল্লিক, ২৯ মে, ২০১১
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
৭। কুরআন মজিদের প্রথম অনুবাদক কে? আব্দুল হালিম, ২০১০
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
৮। কোরআনচর্চা
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
৯। আল-কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক : মাওলানা আমীর উদ্দিন বসুনিয়া>গিরিশচন্দ্র সেন নয় (Nasim Abu Farhan-এর নোট থেকে চয়নকৃত), ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১
ডাউনলোড
১০। আল-কুরানের বঙ্গানুবাদকঃ মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়া, ২০১১
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
১১। কোরআন শরীফ- সহজ সরল বাংলা অনুবাদ (We are Muslims- আমরা মুসলমান পেইজ থেকে চয়নকৃত), ২২ জুলাই, ২০১৩
ডাউনলোড লিঙ্কঃ
১২। বাংলা ভাষায় অনুদিত প্রথম কুরআন চর্চা ও বিশিষ্টজনদের মত, মোঃ আলী আশরাফ খান, ২০১২
ডাউনলোড লিঙ্কঃ