ইসরাইলের আয়রন ডোম কুলাতে পারছে না
ইহুদিদের জেরুজালেম দখল দিবস উদযাপন এবং শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ঘিরে শুরু হওয়া সংঘাতে তথা ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। আজও (বুধবার) ইসরাইলি বিমান হামলা চালিয়ে গাজার বেশ ক-টি বহুতল ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জবাবে ইসরাইলের অভ্যন্তরে রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হামাস। এ পর্যন্ত হামাসের দু শীর্ষ নেতাসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৪১ জন নিহত হয়েছে – যাদের মাঝে ২ নারীসহ ৫ ইসরাইলি এবং ১০টি শিশুসহ ৩৬ জন ফিলিস্তিনি রয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৭০০ জন ফিলিস্তিনী ও কয়েকশ’ ইসরাইলি। পশ্চিম তীরে তেল আবিবের দক্ষিণে ইসরাইল অধ্যুষিত লড শহরে জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইসরাইল। সোমবার এক ইসরাইলি ইহুদি – মুসা হাসুনা নামে এক ফিলিস্তিনি নাগরিককে গুলি করে হত্যার পর থেকে সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৬ সালের পর, প্রথমবারের মতো কোনো আরব সম্প্রদায়ের ওপর জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করলো ইসরাইল সরকার।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সোমবার রাত থেকে হামাস ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে অন্তত ১০৫০টি রকেট হামলা চালিয়েছে – যেগুলোর ৮০% প্রতিহত করেছে তাদের আয়রন ডোম এবং বাকি দু শতাধিক রকেট বিভিন্ন স্থাপনা ও স্থানে হামলা চালিয়েছে। গাজা থেকে ছোড়া রকেটে দক্ষিণাঞ্চলীয় আশকেলন শহরের দুটো বাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে ২০ জনের মতো।
২০১৪ সালের পরে এ প্রথম গাজা থেকে জেরুজালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে। আর এ প্রথম ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমকে ব্যর্থ করে হামাসের এতো রকেট ইহুদিদের শহরে হামলা চালাতে সক্ষম হলো! ফলে, হামাসকে নিয়ে নতুন করে ভাবনায় পড়েছে ইসরাইল! তাদের আয়রন ডোম নিয়ে এতো দিনের দম্ভ চূর্ণবিচূর্ণ করে একের পর হামলা চালাচ্ছে হামাসসহ ফিলিস্তিনের অন্য প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠনগুলো।
হামাস বলছে, আমরা ইসরাইলি আগ্রাসন ও সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদকে রক্ষা করছি। আর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছে, চলতি বছর প্রথমবারের মতো জেরুজালেমের দিকে রকেট ছুঁড়ে রেড লাইন অতিক্রম করছে হামাস।
গাজার ১৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে ইসরাইল। এতে হামাসের আনুমানিক কার্যালয় ১৩ তলার গাজা টাওয়ার ধসে পড়ে; যদিও এতে কেউ হতাহত হয়নি। কেননা, হামলার আশঙ্কায় আগেই মানুষ নিরাপদস্থলে সরে গিয়েছিলো। জবাবে ইসরাইলের দিকে ৪০০’র বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে হামাস ও অন্যান্য গ্রুপ! এর মাঝে তেল আবিবকে লক্ষ্য করেই অন্তত ১৩০টি রকেট ছোঁড়া হয়েছে। পরে ইসরাইলি বিমান বাহিনী গাজায় আরেকটি টাওয়ার ধ্বংস করে। আজ ভোরেও তেল আবিবসহ বের্শেবা, মধ্য ও দক্ষিণ ইসরাইলের দিকে প্রচুর রকেট নিক্ষেপ করে হামাস। এতে বেশ কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃত্যু সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসেম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তেল আবিবের উদ্দেশ্যে ১১০টি এবং বিরসিভার উদ্দেশ্যে একশ’ রকেট হামলা চালানো হয়েছে। বেসামরিক মানুষের ওপর হামলার জবাবেই এসব রকেট হামলা।
হামাসের রকেট হামলায় প্রাণভয়ে দিগ্বিদিগ ছুটছে ইহুদিরা। আজ ভোরে ইসরাইলের লড শহরে বাড়ী ছেড়ে গাড়ীতে করে পালাতে গিয়ে রকেট হামলায় দু ইসরাইলি নিহত হয়েছে। এতে গাড়ীটি উড়ে যায়।
ইসরাইল সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষা ও জননিরপত্তামন্ত্রীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোরভাবে তা মোকাবিলা করার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
অন্যদিকে, হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছেন: ইহুদিবাদী ইসরাইল পবিত্র জেরুজালেম আল-কুদস শহর এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদে হামলা বন্ধ না করলে, হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট হামলা অব্যাহত রাখবে। জেরুজালেম আল-কুদস রাজনৈতিক এবং সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করেছে। আশা করি, ফিলিস্তিনি জনগণের এ ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ়চেতা মনোভাব চূড়ান্ত বিজয় এনে দেবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যতোক্ষণ দখলদার ইসরাইল আল-কুদস শহরে তার সব আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড এবং আল-আকসা মসজিদে হামলা বন্ধ না করবে, ততোক্ষণ আমাদের অভিযান চলবে।
হামাসের মুখপাত্র ফুজি বারহুম বলেছেন: বোমার জবাব বোমা দিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সংগ্রামীরা বিন্দুমাত্র পিছু হটবে না। বোমার বদলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের দিন বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন ইসরাইলি শত্রুর সাথে কথা হবে শক্তির ভাষায়। ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিরোধ সংগ্রামীদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে পেরে না উঠে গাজার আবাসিক এলাকা এবং অবলা নারী ও শিশুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
এদিকে, গতকাল (মঙ্গলবার) ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ আন্দোলনের প্রধান আব্দুল মালেক বদরুদ্দীন আল-হুথি বলেছেন: মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ ঘটনাবলীতে প্রতিরোধ পক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করছে ইয়েমেনিরা। আজকে ফিলিস্তিনে আমরা আপনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছি। আমরা যা পারি তার সবই করবো। ফিলিস্তিনি জনগণকে সহযোগিতা করতে ইয়েমেনিরা অর্থ সংগ্রহ করবে এবং নতুন যে কোনো ঘটনার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। ইয়েমেনিরা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাসহ অন্য প্রতিরোধ ফ্রন্টের সাথে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে চলেছে।
ওদিকে, গতকাল মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত নরওয়েজীয় টর ভেনেসল্যান্ড এক টুইটে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনকে সতর্ক করে বলেছেন: অবিলম্বে আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করুন। আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দু পক্ষের নেতাদের ডি-এ্যাসকেলেশনের (সংঘাত সমাধানের পন্থা বের করার) দায়িত্ব নিতে হবে। গাজায় যুদ্ধের ফলাফল ধ্বংসাত্মক এবং সাধারণ লোকেরা সেটা ভোগ করছে। চারপাশে শান্তি পুনরুদ্ধার করতে জাতিসংঘ কাজ করছে। এখনই সহিংসতা বন্ধ করুন।
কিছুক্ষণ আগে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গাজা থেকে ছোঁড়া ফিলিস্তিনিদের ট্যাংক-বিধ্বংসী একটি কোরনেট ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের উত্তরাঞ্চণের নাতিফ হাসারায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একটি জিপে আঘাত হানলে, একজন ইসরাইলি ইহুদি নিহত ও অন্তত তিন জন আহত হয়েছে। এ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রয়েছে।
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, বিবিসি, জেরুজালেম পোস্ট, টাইমস অব ইসরাইল, পার্সটুডে ও এনডিটিভি।