তুরস্ক ও লিবিয়ার সম্পর্ক প্রায় ৫০০ বছরের! বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও লিবিয়া উছমানীয় খেলাফতের অধীনেই ছিলো। কখনোই লিবিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তেমন খারাপ ছিলো না। শুধু কমিউনিস্ট ও একনায়ক গাদ্দাফীর পতন পর্যন্ত লিবিয়ার সাথে সম্পর্ক খারাপ ছিলো তুরস্কের। বর্তমানে তুরস্কের সাথে লিবিয়ার যে দহরম-মহরম, তা শুরু হয় ২০১৯ সালের গোড়ার দিকে। লিবিয়ায় তখন চলছিলো প্রচণ্ড গৃহযুদ্ধ। রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ফ্রান্স ও গ্রীসের সমর্থিত সন্ত্রাসী হাফতার বাহিনী (এলএনএ) বনাম ত্রিপলীভিত্তিক জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার (জিএনএ)। যুদ্ধে জিএনএ এতোটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে যে, এক পর্যায়ে এলএনএ’র কাছে পতনটা ছিলো সময়ের ব্যাপার মা্ত্র! তখন জিএনএ নানা দেশের কাছে সামরিক সহযোগিতার আবেদন করে। কিন্তু কেউই সহযোগিতায় হাত বাড়ায়নি; বরং দেশটির ওপর জারি করা হয় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বের বড় বড় দেশ যেমন- ফ্রান্স, রাশিয়া, আমেরিকা, আরব আমিরাত, মিসর ও গ্রীস লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা খলিফা হাফতারকে অস্ত্রশস্ত্র, কুবুদ্ধি ও কুপরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছিলো। সেই নিদানকালে পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা জিএনএ’র প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায় তুরস্ক। ২০১৯ সালের জানুয়ারীতে লিবিয়ায় সেনা, সাঁজোয়া যান ও ড্রোন পাঠানোসহ সব ধরনের সামরিক সহযোগিতার আশ্বাস দেয় তুরস্ক। এরদোয়ান সরকারের সেই সহযোগিতাই লিবিয়ার জন্যে মূলত গেম চেঞ্জার হয়ে দাঁড়ায়। তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনী ও কিলার ড্রোন হাফতারের বাহিনীকে ত্রিপলীর উপকূল থেকে তাড়িয়ে ৪৫০ কিঃমিঃ পূর্বে সিরত শহর দিয়ে আসে! ফলে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে জিএনএ তথা ফায়েজ আস-সাররাজের সরকার। তখন তুরস্ক লিবিয়ার সাথে দুটি চুক্তি করে। প্রথমটি ভূমধ্যসাগরে পানিসীমা নিয়ে; দ্বিতীয়টি সামরিক।
তুরস্ক ও লিবিয়া ভূমধ্যসাগরের মাঝ বরাবর একটি জায়গায় নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করে। আর এটাই ছিলো গত এক দশকে এরদোয়ানের সবচেয়ে বিচক্ষণ চাল। আসলে ভূমধ্যসাগরীয় ইসরাইল, গ্রীস, ফ্রান্স, সাইপ্রাস ও মিসর চেয়েছিলো এ ইস্যুতে তুরস্ককে একেবারে কোণঠাসা করে রাখতে। ওরা তুরস্ককে বাইরে রেখে একটি জোট করেছিলো – যা এ সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও তা বন্টনের সিদ্ধান্ত নেবে। অথচ এ সাগরের পূর্ব অঞ্চলে তুরস্কের রয়েছে ১৬০০ কিঃমিঃ এবং লিবিয়ার ১৭০০ কিঃমিঃ দৈর্য্ব উপকূল! আর এ তুরস্কবিরোধী জোটটি তাদেরকে কোনো আধিকারই দিতে নারাজ ছিলো! কিন্তু তুরস্ক ও লিবিয়ার ঐ পানিসীমা চুক্তি ওদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়। তেমনি ইসরাইল, মিসর, গ্রীস, সাইপ্রাস ও ফ্রান্স চেয়েছিলো ভুমধ্যসাগরের খনিজ সম্পদেও তুরস্ককে কোনো ভাগ না দিতে; অর্থাৎ তুরস্কের এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোনেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কোন পথ তুরস্কের জন্যে খোলা রাখেনি ওরা। ওদের আরো মতলব ছিলো – তুরস্ককে বাইপাস করে ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন তৈরি করে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা। কিন্তু তুরস্ক-লিবিয়ার পানিসীমা চুক্তির ফলে সেটি এখন তুরস্কের অনুমতি ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। মোট কথা, এ চুক্তির ফলে ওদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে।
লিবিয়ায় তুরস্কের স্বার্থ কী?
১। লিবিয়া যুদ্ধের কারণে তুরস্কের শত শত কম্পানি যে তাদের ওখানকার ফ্যাক্টরি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট ছেড়ে এসেছিলো, সেগুলোতে আবার ফিরে যেতে পারবে। সেই ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নিতে পারবে।
২। লিবিয়ার অবকাঠামোগত উন্নয়নে তুরস্কের কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
৩। লিবিয়ার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে তুরস্কের এনার্জি কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
৪। লিবিয়ার তেল-গ্যাস তথা খনিজ সম্পদ তুলতে তুরস্কের কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
সর্বোপরি, লিবিয়াতে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তুর্কি কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পাবে। তুরস্ক ও লিবিয়ার বর্তমান বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার।
৭। তুরস্ক লিবিয়াকে আফ্রিকায় ঢোকার একটি দরজা বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে!
আফ্রিকার সাথে তুরস্কের বর্তমানে ব্যাপক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। আর তা আরো উন্নত করতে বা এগিয়ে নিতে আরো বেশি ব্যবসা-বাণিজ্য দরকার। আর এর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, নৌপথ। তুরস্ক তার পণ্য মালবাহী জাহাজে লিবিয়া দিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে খুব সহজে পৌঁছাতে পারবে। এটি তুরস্কের এমন একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা যে, দিন যতো যাবে – ততোই তুরস্ক এর সুফল পেতে থাকবে।
লিবিয়ার স্বার্থ কী?
১। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
২। সন্ত্রাসের কবল থেকে দেশের বিশাল এক অংশ উদ্ধার করা।
৩। দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
৪। অর্থনৈতিক গতি ফিরে আসা।
৫। ভূমধ্যসাগরে বিশাল এক এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের অধিকার পাওয়া।
সর্বোপরি, জিএনএ’র সামরিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য একটি সরকার হিসেবে টিকে থাকা।
সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? ২০১৯ সালে যখন প্রথম চুক্তি হয়, তখন ক্ষমতায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আস-সাররাজ। মার্চে শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার – যারা ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত দেশ চালাবে। অনেকেই ভেবেছিলেন – আব্দুল হামিদ আদ-দাবিবাহ’র নেতৃত্বের নতুন এ সরকার তুরস্কের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে না। এ নিয়ে গ্রীস, মিশর, ফ্রান্স ও রাশিয়া অনেক চেষ্টাও চালাচ্ছে। কিন্তু আদ-দাবিবাহ তার মন্ত্রীপরিষদের ১৫ জন সদস্য এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরো ব্যক্তিদের নিয়ে গত সপ্তাহে তুরস্ক সফরে এসে যে শোডাউন করে গেলেন, তাতে আপাতত সম্পর্কে চির ধরার সম্ভবনা নেই। অবশ্য তুরস্কবিরোধী জোটটি থেমে থাকবে না। ছলে, বলে, কৌশলে, কখনো প্রলোভন দেখিয়ে, কখনোবা হুমকি দিয়ে লিবিয়াকে তুরস্ক থেকে দূরে সরাতে চেষ্টা চালিয়েই যাবে। যেসব দেশ সারা বিশ্বের সামনে নির্লজ্জের মতো অন্য দেশের সরকারকে ব্লাকমেইল করতেও দ্বিধা করে না, তারা পর্দার অন্তরালে না জানি কতো চালই চালে ও চালবে! কিন্তু তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি এখন আরো বেশি সচেতন আরো বেশি পরিপক্ক।
সুত্র: আনাদোলু এজেন্সি।