৭০০ বছর ধরে সংরক্ষিত কস্তুরী-সোনা মেশানো জাফরান কালিতে লেখা কুরআন শরীফ
মসজিদুল আকসার কুব্বাতুস সাখরা সংগ্রহশালায় ৭০০ বছর ধরে সংরক্ষিত আছে কস্তুরী ও সোনা মেশানো জাফরানের কালিতে লেখা কুরআন শরীফের একটি অনুলিপি।
স্মরণীয় হয়ে থাকতে প্রখ্যাত মামলুক সুলতান মুহম্মদ বিন মানসুর কালাউনের সমসাময়িক মরক্কোর সুলতান আলী আবুল হাসান মানসুর বিল্লাহ আল-মারিনী মসনদে বসে অভিনব কিছু কাজ করেছিলেন। এগুলোর অন্যতম ছিলো ১৩৪৪ সালে তাঁর নিজের হাতে কুরআন মজীদের ঐতিহাসিক অনুলিপি তৈরি করে রূপাখচিত ও আবলুস কাঠে নির্মিত বর্গাকৃতির একটি বাক্সে করে আল-আকসা মসজিদে হাদিয়া পাঠানো! বাক্সটির ভিতরে ত্রিশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত। আর প্রতিটি অংশে এক পারা করে মোট ত্রিশ পারা কুরআন শরীফ! আজও প্রায় সেভাবেই সংরক্ষিত আছে।
বর্গাকৃতির বাক্সে সংরক্ষিত থাকায় ওটিকে ‘মরক্কোন রাবা’ বলা হয়। আরবিতে ‘রাবা‘ অর্থ ‘বর্গাকৃতি’। শুধু তা-ই নয়, কুরআন মজীদের একই রকম আরো দু পাণ্ডুলিপি তৈরী করে ঐ সুলতান মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতেও হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। তবে কালের পরিক্রমায় ঐ দুটি সংরক্ষিত থাকেনি!
আল-আকসায় ওয়াকফ করে আল-কুরআনের ঐ হাদিয়া পাঠিয়ে সুলতান আল-মারিনী ওসিয়ত করে বলেছেন: শুধু কুব্বাতুস সাখরার ভেতরেই প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় এ পাণ্ডুলিপিটি তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াতের আগে-পড়ে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস ও সূরা বাকারার শেষ দু আয়াত বিশেষভাবে পড়তে হবে। তিলাওয়াত শেষে রাসুলে কারীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম) ও তাঁর আহলে বাইতের শানে দরূদ এবং সুলতানের পরিবারের জন্যে কল্যাণ ও ক্ষমার দোয়া করতে যেনো কোনো পাঠক ভুল না করেন!
মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে নানা সময়ে পবিত্রতম স্থান আল-আকসায় অনেক হাদিয়া পাঠানো হয়েছে। তবে সুলতান আল-মারিনীর ঐ উপহারকে এ পর্যন্ত আল-আকসায় প্রেরিত অন্যতম মূল্যবান হাদিয়া মনে করা হয়ে থাকে।
অবশ্য কুরআন কারীমের ঐতিহাসিক এ নুসখাটির শিল্পমান ও বিন্যাসশৈলী নিয়ে এ পর্যন্ত পর্যাপ্ত একাডেমিক গবেষণা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনি পাণ্ডুলিপি গবেষক সমর বকিরাত। তিনি মরক্কোর মারিনী যুগে কুরআনের প্রতিলিপি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি এ নারী গবেষক সুলতান আল-মারিনীর পাঠানো ৭০০ বছর ধরে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এ পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, সুলতান আল-মারিনী উন্নত চামড়ায় বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন যেনো কাগজের মতো সহজেই ক্ষয়ে না যায়। লেখার ক্ষেত্রে তখনকার প্রচলিত কুফি লিখন রীতি এবং বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ ফিতার সাহায্যে জ্যামিতিক নানা সূত্র অনুসরণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক এ পাণ্ডুলিপির কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কস্তুরী মেশানো জাফরান – যাতে কার্বন ও সোনা মেশানো কালিও পর্যাপ্ত ছিলো। কোনো সুরা বা পারার শুরু-শেষে বিশেষ আলঙ্কারিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় কারুকার্যের মাধ্যমে বিশেষ নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে গত শতকের প্রথমদিকে ফিলিস্তিন নিয়ে নানা মাত্রিক অস্থিরতা তৈরি হলে, ঐতিহাসিক এ পাণ্ডুলিপির ৬টি অংশ লুট হয়ে গেছে! বর্তমানে ‘মরোক্কান রাবাতে’ ২৪ পারা রয়েছে।
আল-কুরআনের ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপির ধারক ‘মরোক্কান রাবা’ তদানীন্তন মারিনী শাসকদের উৎকর্ষতার প্রতীক হয়ে আছে। পাশাপাশি সুলতান আল-মারিনীর উন্নত রুচিবোধ এবং আল-কুরআনের প্রতি অনুরাগ ও নিবিষ্টতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও এটি। ইতিহাস বলে – আল্লাহভীতি, সচ্চরিত্র ও ভদ্রতার কারণে সুলতান আল-মারিনী মরক্কোর অপরাপর শাসকদের থেকে সদা অনন্য ছিলেন।
সূত্র: আল-জাজিরা অবলম্বনে।