‘তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকে’র গেরিলারা ইরানের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে’ – মর্মে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু বক্তব্যের প্রতিবাদে রোববার তেহরানে নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূত দারিয়া উরুসকে তলব করেছে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এরপর সেদিনই ইরাকের কুর্দিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে – ‘তুর্কি বাহিনীর ইরাকের মাটিকে হুমকিতে ফেলা কিংবা (সীমানা) লঙ্ঘন করা উচিত নয়। তুরস্ক অথবা অন্য যে কোনো দেশই হোক না কেন, ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপ বা ইরাকে সামরিক উপস্থিতি বা অগ্রসরতা আমরা মোটেও সমর্থন করি না। আঙ্কারাকে ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সীমানাকে সম্মান দেখাতে হবে। ইরাকি অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইরাকি বাহিনী ও (কুর্দিস্তান) আঞ্চলিক বাহিনীর’ – মর্মে ইরাকে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত ইরাজ মাসজেদীর বক্তব্যের প্রতিবাদে আঙ্কারায় নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত মুহম্মদ ফারাজমান্দকেও ডেকে পাঠিয়েছে তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তাছাড়া, ইরাজ মাসজেদীর ঐ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় – ‘আঙ্কারা আশা করে, ইরান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তুরস্কের লড়াইকে সমর্থন করবে; বিরোধিতা করবে না। ইরানের রাষ্ট্রদূত হবেন ইরাকের সীমানা-সম্মান সংক্রান্ত তুরস্ককে জ্ঞান দেয়া সবশেষ ব্যক্তি’ – মর্মে ইরাকে নিযুক্তি তুর্কি রাষ্ট্রদূত ফাতিহ ইলদিজের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলেছে ইরান। ফলে, মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে ইরান-তুরস্ক!
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিগত কয়েক দশক ধরে রক্তাক্ত হামলা চালিয়ে আসছে। তুরস্ক, আমেরিকা ও ইইউ এটাকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে পিকেকে। এটার উপস্থিতি নির্মূলে তুরস্ক কয়েক দশক ধরে ইরাকি অঞ্চলগুলোর ভেতরে বেশ ক-টি সামরিক ফাঁড়ি মোতায়েন করেছে। বিমান ও স্থল-সীমান্তে তুর্কি বাহিনীর অভিযান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে। সম্প্রতি এসব অভিযানে তুর্কি বাহিনী ও বিমানের সীমানা লঙ্ঘনে বাগদাদ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আঙ্কারা পিকেকে’র সিনিয়র সদস্যদের হত্যা করতে ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। অনেক বছর ধরে পিকেকে’র হাতে বন্দী ১৩ নাগরিককে মুক্ত করতে সবশেষ উত্তর ইরাকের গ্যারা পর্বতে ১৯ই ফেব্রুয়ারীর তুর্কি অভিযান ব্যর্থ হয়। আঙ্কারার অভিযান পরিচালনাকালে পিকেকে’কে বন্দী-হত্যায় অভিযুক্ত করার সময়, পিকেকে দৃঢ়ভাবে দাবি করে যে, তুরস্ক নিঁখুতভাবে তাদের গুহার বন্দীদশায় বোম্বিং করেছে। ইরান-সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া এবং হাশদ আল-শাবী নামে পরিচিত পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট, এ অঞ্চলে তুর্কি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সিরিয়ার সীমান্তে সিনজারে তিনটি ব্রিগেড মোতায়েন করেছে।
এছাড়া, ১৪ই নভেম্বর ২০১৯-এ তুরস্ক-প্রবাসী ইরান সরকারবিরোধী ইরানী বিজ্ঞানী মাসউদ মৌলভী বর্ধনজানীর খুনের সন্দেহে তুরস্ক সম্প্রতি ইরানি এক কর্মকর্তা মুহম্মদ রেজা নাসেরজাদেহকে গ্রেপ্তার করলে, তুরস্ক ও ইরানের মাঝে উত্তেজনা বেড়েছে।
লন্ডনের চাথাম হাউসের সহযোগী গ্যালিপ ডালে আরব নিউজকে বলেন: তুরস্ক-ইরান সম্পর্ক আরো অশান্ত হয়ে উঠবে। ইরাক এখনো ইরানের জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যেখানে ইরাকি কেন্দ্রীয় সরকার সিনজারে তুর্কি কোনো অভিযানকে স্বাগত জানায় না – সেখানে উত্তর ইরাকে তুরস্কের বর্ধিত সামরিক উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক উৎসাহ ইরানকে ক্রমশ বিরক্ত করে তুলছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও বিশ্লেষক স্যামুয়েল রমানীর মতে, তুরস্ক-ইরান সম্পর্ক অস্থিতিশীল। কেননা, প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা বাড়তে থাকায় একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। তিনি আরব নিউজকে বলেন: এ মুহুর্তে আমরা তীব্র প্রতিযোগিতার একটি পর্যায়ে প্রবেশ করছি। একদিকে তুরস্ক ইরাকে পিকেকে থেকে বর্ধিষ্ণু হুমকির মুখোমুখি রয়েছে। অন্যদিকে, গত বছর ইরানের সিনিয়র কমান্ডার কাসেম সোলাইমানীর নিহতের পরে ইরাকি কুর্দিস্তানের সাথে ইরানের সম্পর্ক একটি ইতিবাচক মুহূর্তে রয়েছে। ইরাকের সাথে তুরস্কের বর্ধিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ইরানের আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফলে, বাগদাদে তুর্কি সামরিক অভিযানকে ‘ইরাকি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনকারী’ বলে ইরান তার অসন্তোষকে পুঁজি করার চেষ্টা করছে। তুরস্ক ও ইরানের মাঝে বিস্তৃত উত্তেজনার একটি ব্যাপার রয়েছে। তুরস্ককে মোকাবিলা করতে ক্যাস্পিয়ান অঞ্চলে রাশিয়া-ইরানের সম্পর্ক বাড়ছে। আঙ্কারা অভিযুক্ত ইরানি গুপ্তচরকে (মুহম্মদ রেজা নাসেরজাদেহ) গ্রেপ্তার করেছে এবং উভয় দেশই উত্তর সিরিয়ার পরিস্থিতি – বিশেষ করে, আয়িন ইসা শহরের বিষয়ে একমত নয়। আঙ্কারার পিকেকেবিরোধী অভিযানের বৈধতা এবং ইরাকে ইরানের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে তুরস্ক ও ইরানের বাক-বিতর্কিত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। তবে ইরানি ও তুর্কি বাহিনী বা স্থানীয় মিত্রদের মাঝে সরাসরি দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা নেই।
তবে ডালে আশা করেন যে, সিনজারে মার্কিন-সমর্থিত তুর্কি অভিযান খুবই সম্ভাব্য। তিনি বলেন: হাশদ আল-শাবী ও আঙ্কারার মাঝে চলমান সংকট আরো বাড়লে, ইরান এখানে আঞ্চলিক সমীকরণ টানতে পারে। যেখানে হাশাদ আল-শাবী এ অঞ্চলে পিকেকে’র প্রচ্ছন্ন সহযোগী – সেখানে সিনজার প্রতিরোধ ইউনিট তথা একটি ইয়াজিদি মিলিশিয়া গ্রুপের উপস্থিতির সুবাদে হাশদ আল-শাবীর সহযোগিতা ইয়াজিদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সচেতনতা বাড়াতে পারে।
সুত্র: আরব নিউজ, আল-জাজিরা ও ইরনা।