পৃথিবীর কত কিছুই তো জানি না, কিছু কিছু জিনিস বা বিষয় যখন জানি তখন আমি নিজে যে একটা অথর্ব এর প্রমান বেশ ভালভাবেই পাওয়া যায়।
বিষয়ের উপর অবতারণার পর মনে মনে ভাবি-
ইস্! এটা আমি জানি না; এটা তাহলে এই বিষয় কিংবা তাহলে ওরা একসময় এরকম বা এভাবে ছিল আমাদের দেশে কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশে কিংবা এরা সংখ্যায় কম হলেও এখনো আছে বহাল তবিয়তে ঐতিহ্যের টানে!
এরকমই একটি বিষয় আজ শেয়ার করবো আপনাদের সাথে; যারা জানেন না তারা বেশ অবাক হবেন শুনে বা জেনে, এটা বাজি ধরেই বলতে পারি !!
আচ্ছা, আগে যখন সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না তখন মানুষ কি বা কি ধরনের পানি খেতো কিংবা সুপেয় পানি কোথায় কিভাবে পেত ?
পানি এখন যেমন আমরা কিনে খাই, আগে কি কখনো মানুষ পানি কিনে খেতো কিংবা কিনতো ??
উত্তর হচ্ছে-হ্যাঁ, কিনে খেতো!
তারা কিনতো ভিস্তিওয়ালাদের কাছ থেকে পানি।
প্রশ্ন হচ্ছে- কারা এই ভিস্তিওয়ালা ?
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানীর বেশ অভাব।
ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতোই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার ওপর।
তখন মিনারেল ওয়াটারের যুগ ছিল না।
পশুর চামড়াই ছিল পানি সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম।
সেই চামড়ার থলেকে বলা হতো “মশক” বা “ভিস্তি”!
মশকে থাকতো পানি।
সেই মশক পিঠে বয়ে বেড়াতো এক ধরনের মানুষ, আর ফেরি করে মশক থেকে ঢেলে ঢেলে পানি বিক্রি করতো!
এদেরকেই বলা হতো ভিস্তিওয়ালা!
সেকালে কলের পানি সব বাড়িতে পৌছায়নি।
যেখানে পানির কল নাই, সেখানে ভিস্তিওয়ালা সহায়।
ছাগলের চামড়ার মশকে করে পানি ফেরির দৃশ্য- মানে ভিস্তিওয়ালা !!
সকাল বেলা ভিস্তি আসত বিরাট মশকে ভরে পানি কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে।
ভিস্তির সেই বিকট গলা …‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’।
মশকের মুখটা খুলে চেপে ধরে কলসিতে পানি ঢেলে রাখত।
বিরাট সেসব কলসি, মাটির মটকায়ও পানি রাখা হতো।
ভিস্তিওয়ালাদের মশকে জল থাকত ঠান্ডা।
‘বেহেশত’ একটি ফার্সি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ‘স্বর্গ’।
এই ‘বেহেশত’ থেকে ‘ভিস্তি’ কথাটি এসেছে।
পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয়, স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, খাল আর বাগান।
একটা সময় মানুষের বিশ্বাস ছিল, ভিস্তিওয়ালারা জল নিয়ে আসেন স্বর্গ থেকে।
স্বর্গের জল তাঁরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন বলে স্বর্গের দূতও বলা হত তাঁদের।
ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের “সাক্কা” বলা হত।
সেসময় ভিস্তিওয়ালাদের একটি সংগঠন ও ছিল। সংগঠনের প্রধানকে নওয়াব ভিস্তি বলা হতো।
আজ পুরান ঢাকার যে সিক্কাটুলি দেখা যায় তা ছিল ভিস্তিদের এলাকা।
বুঝাই যায় সেই সাক্কা থেকেই সিক্কাটুলী!
১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেছিলেন।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা ছিল সুন্নি মুসলিম।
মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে তাদের প্রত্যক্ষ করা যেত।
দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান খ্যাত বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণিদের মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা টমটম ভরে বড় বড় চামড়ার থলেতে পানি দিয়ে আসতো।
কলকাতায় একজন ভিস্তি ১০ থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে এক মশক পানি সরবরাহ করে দিত।
এক মশকে পানি ধরতো প্রায় ৩০-৪০ লিটার।
শামসুর রাহমান তার শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের চিত্রায়িত করেছেন এভাবে—
“রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে।
কালো মোষের পেটের মত ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি।
তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর৷
মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা! “
এক ভিস্তিওয়ালার সাথে বিখ্যাত মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে; যেটির উল্লেখ হুমায়ূন স্যারের বিখ্যাত ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসে উল্লেখ আছে!
হুমায়ূন পেছন দিকে তাঁকালেন, তাঁর তাবুতে আগুন জ্বলছে।
আগুন ছুটে যাচ্ছে জেনানা তাঁবুর দিকে। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল।
সম্রাট হুমায়ূনের ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে আযান দিচ্ছেন, আল্লাহু আকবার।
আল্লাহু আকবার।
মহাবিপদের সময় আযান দিতে হয়। আজ মুগলদের মহাবিপদ।
সম্রাট ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন।
মুহূর্তেই ঘোড়া পানিতে তলিয়ে গেল। সম্রাট নিজেও তলিয়ে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ শুনলেন কে যেন বলছে, আমি আপনাকে বাতাস ভর্তি একটা মশক ছুঁড়ে দিচ্ছি। আপনি মশক ধরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করুন।
— তুমি কি আমাকে চেনো?
— আপনি মুঘল সম্রাট হুমায়ূন!
— তোমার নাম কি?
আমি নাজিম। ভিস্তিওয়ালা নাজিম। আপনি মশক শক্ত করে ধরে ভাসতে থাকুন।
মনে আছে ভাগ্যাহত মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের কথা? শেরশাহ এর সাথে যুদ্ধে প্রায় মরতে বসা সম্রাটকে মশক দিয়ে বাঁচিয়েছিল এক ভিস্তি, নিজাম ভিস্তিওয়ালা।
সম্রাট খুশি হয়ে সেদিন বলেছিলেন যদি তিনি তার সিংহাসন ফিরে পান তবে একদিনের জন্য হলেও নিজাম ভিস্তিওয়ালাকে রাজ সিংহাসনে বসাবেন।
আশ্চর্যের কথা হলো হুমায়ূন তার কথা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে সিংহাসন পূনরূদ্ধার করে নিজাম ভিস্তিকে সম্রাট বানিয়ে এক নজিরবিহীন কাণ্ডের অবতারণা করেন তিনি।
এখন অবশ্য নেই ভিস্তিওয়ালাদের আনাগোনা।
বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ভিস্তওয়ালারা, তবে কলকাতায় এখনো ভিস্তিওয়ালাদের চোখে পড়ে।
ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ পানির অপ্রতুলতার প্রতি খেয়াল রেখে নবাব খাজা আবদুল গণি ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠার জন্য দুই লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদান করেন।
তাঁর এই বদান্যতায় ১৮৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভায় গড়ে উঠে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহের আধুনিক সুবিধা।
আরো পরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসীর নিরাপদ পানির চিন্তা দূরীভূত হয়।
আর এরই সাথে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় ভিস্তিদের বর্ণাঢ্য পেশাদারি জীবনের৷
আবেদন কমতে থাকে একেকজন সুক্কা বা সাক্কাদের। তারাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিজেদের জড়িয়ে নেয়।
ঢাকা শহরে ভিস্তিওয়ালারা বহুদিনযাবত তাদের পোক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল।
ভারতবর্ষে ঢাকাই ছিল শেষ শহর যেখানে ষাটের দশক পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়।
১৯৬৮ সালের দিকে এসে ঢাকা শহর থেকে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বর্তমানে পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি দাঁড়িয়ে আছে ‘ভিস্তিওয়ালা’ নামের অতীতের এক কর্মজীবীদের পেশার সাক্ষী হয়ে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ঢাকার রাস্তায় শেষবারের মত এক ভিস্তিকে দেখা গিয়েছিল !!!
কলকাতার জনা চল্লিশেক ভিস্তিওয়ালা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের পারিবারিক পেশা।
তাঁদের বেশিরভাগই আদতে বাস করেন বিহারের কাটিয়ারে।
মধ্য কলকাতায় ঘর ভাড়া করে থাকেন তাঁরা।
প্রত্যেক ঘরে অন্তত দশজন করে মানিয়ে গুছিয়ে থেকে যান।
মহম্মদ আনসার, মহম্মদ জারিফুল, মহম্মদ রেজাউলের মতো ভিস্তিওয়ালাদের থেকে এখনও জল কিনে খান কিছু লোক।
হোটেলেও যায় এঁদের জল।
সকাল-বিকেল তাঁরা পৌরসভার ট্যাপ কল আর টিউবওয়েলের জল মশকে ভরে ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে জল পৌঁছে দেন!
বাড়ি এবং দোকান মিলিয়ে একেকজন ভিস্তিওয়ালা দিনে দুবেলা মোটামুটি ৩০টি বাড়িতে জল পৌঁছে দেন।
এর জন্য মাসে চারশো টাকার মতো খরচ হয় একেকটি পরিবারে।
এখনো কলকাতার কোথাও কোন রাস্তায় দেখা যায় ভিস্তিওয়ালা মশকে করে পানি নিয়ে ফেরি করছে— সত্যি ই অপূর্ব দৃশ্য।