ভাস্কর্য নির্মাণ-কেন্দ্রিক চলমান বিতর্কের মধ্যে ক্যামেরায় ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ করার বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে। বিশেষত, ভাস্কর্য নির্মাণ সংক্রান্ত ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশনা উল্লেখ করার পর বিপরীত মতাবলম্বীদের পক্ষ থেকে ছবি তোলার বিষয়টি পাল্টাযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এ বিষয়টি পর্যালোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হারাম সাব্যস্ত হয়।
আয়েশা সিদ্দীকা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ ﷺ (গির্জায় সাজানো প্রতিকৃতির ব্যাপারে) বললেন, তাদের মধ্যে যখন কোনো পুণ্যবান লোক মারা যেত তখন তারা ওদের কবরের ওপর উপাসনার জায়গা নির্মাণ করত এবং এসব প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখত। এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে গন্য হবে।” [সংক্ষেপিত, সহীহ বুখারী; কিতাবুস সালাত, সহীহ মুসলিম; কিতাবুল মাসাজিদ]
এখানে যে প্রতিকৃতির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো পূজার মূর্তি নয়। Trinity-তে বিশ্বাসী হলেও খ্রিস্টানরা প্রচলিত অর্থে মূর্তিপূজক নয়। তারা কেবল ভক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখত। এ হাদীসের আলোকে চার মাযহারের সকল ইমাম-আইম্মার ঐক্যমত হচ্ছে, যে কোনো রূহবিশিষ্ট প্রাণীর চিত্র ও ভাস্কর্য তৈরি করা স্পষ্টত হারাম, চাই যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হোক। হাদীসে প্রাণীর চিত্র ও ভাস্কর্য তৈরি করার শাস্তি সম্পর্কেও স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত হবে চিত্রকর/ভাস্কর।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল লিবাস, সহীহ মুসলিম; কিতাবুল লিবাস]
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উপরিউক্ত হাদীসসমূহে চিত্র ও ভাস্কর্যের জন্য تصوير (তাসওয়ীর) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। تصوير শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আকার, আকৃতি বা রূপদান করা’। এ শব্দ থেকে আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হচ্ছে ٱلْمُصَوِّرُ বা আকৃতিদাতা [সুরা হাশর : ২৪]। এটি আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গুণ। যখন হাত দিয়ে تصوير তথা চিত্র ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, তখন এটি এক ধরণের تخليق বা সৃষ্টিকর্মে পরিণত হয়। মুহাদ্দিস ও ফকীহগণও تصوير শব্দকে ‘হাতে তৈরি করা চিত্র বা প্রতিকৃতি’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। আবার আরবি ভাষায় ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিকেও تصوير বলা হয়। তাই বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দেয় যে, তাসওয়ীর যেহেতু হারাম, তাহলে কি ছবি তোলাও হারাম?
ভাষাবিজ্ঞানের সাথে পরিচিতরা জানেন যে, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের ব্যবহার পরিবর্তিত হয়, অর্থ বিস্তৃত হয়। প্রাচীন আরবে উটের ক্যারাভানকে বলা হতো ‘সাইয়্যারাহ’। আজ ‘সাইয়্যারাহ’ দ্বারা মোটরগাড়ি বুঝায়। এক সময় ‘ক্বাহওয়া’ বলা হতো নেশাযুক্ত পানীয়কে। আজ ‘ক্বাহওয়া’ দ্বারা বুঝায় কফি। আরবি ভাষায় এগুলোর জন্য কোনো শব্দ ছিল না বিধায় আরবরা প্রাচীন শব্দকে আজ নতুন অর্থে ব্যবহার করছে। একইভাবে যখন ক্যামেরা আবিষ্কার হলো, তখন আলাদা শব্দ না থাকায় তাঁরা ‘তাসওয়ীর’ শব্দের অর্থকে বিস্তৃত করে ক্যামেরার ছবিকেও তাসওয়ীরের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলল। এমনকি প্রচলিত আরবি ভাষায় ক্যামেরাকে বলা হয় ‘কামিরা’, ভিডিওকে বলে ‘ফিদিও’, ফিল্মকে বলে ‘ফিলিম’। তাঁরা আলাদা শব্দ তৈরি করার প্রয়োজন বোধ করেনি। শব্দের এই অভিন্নতাই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এবার, ইসলামি শরীয়তের একটি উসূল বা মূলনীতি হচ্ছে-
কুরআন-সুন্নাহ থেকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে শব্দ ও তার গঠন বিবেচ্য নয়; বরং বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে শব্দের অর্থ ও এর উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ,
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “প্রত্যেক নেশাজাতীয় দ্রব্য খামর এবং প্রত্যেক খামর হারাম।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল আশরিবাহ]
এ হাদীসে যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তা ‘খামর’ নামক শব্দের জন্য নয়; বরং مُسْكِر তথা নেশাজাতীয় দ্রব্যের জন্য। কাল যদি কেউ Tang বা রুহ আফজা শরবতের নাম ‘খামর’ রেখে দেয়, তবুও সেটি হারাম হবে না। কারণ এতে নেশাজাতীয় দ্রব্য নেই। অপরদিকে মদের বোতলে ‘শারাবান ত্বাহুরা’ লিখে দিলেও অ্যালকোহল কন্টেন্টের জন্য সেটি হারাম-ই থাকবে। এটি উসূলে ফিকহের একটি বুনিয়াদি নীতি।
যেসব হাদীসের আলোকে প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম করা হয়েছে, সেসব হাদীস একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দুটি। একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাণীর চিত্র বা প্রতিকৃতি তৈরি করার ফলে স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহর অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যে অনধিকার চর্চা করা হয়, যা আল্লাহকে রাগান্বিত করে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির সদৃশ কিছু সৃষ্টি করতে চায়। সামর্থ থাকলে তারা সৃষ্টি করুক একটি বীজ বা একটি অণু।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল লিবাস]
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
“যারা চিত্র/ভাস্কর্য তৈরি করে, তারা কিয়ামতের দিন শাস্তি পাবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যেগুলোকে সৃষ্টি করেছিলে, ওগুলোতে প্রাণ দাও।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল লিবাস, সহীহ মুসলিম; কিতাবুল লিবাস]
উক্ত হাদীসদ্বয় গবেষণা করলে বুঝা যায়, আল্লাহ যেহেতু প্রাণীর আকৃতি দান করেন, তাই এর সদৃশ কিছু অন্য কারও হাতে সংঘটিত হওয়া আল্লাহর পছন্দনীয় নয়। প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য হারাম হওয়ার পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেহেতু ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, তাই এতে শিরকের সম্ভাব্য পথ প্রসারিত হয়। তাই আল্লাহ খোলাখুলিভাবে যাবতীয় প্রতিমা পরিহার করার আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ
“অতএব তোমরা মূর্তিসমূহের নোংরামি পরিহার করো এবং পরিহার করো মিথ্যা কথাবার্তা।” [সুরা হাজ্জ : ৩০]
প্রক্ষান্তরে, ক্যামেরার ছবিকে যদিও আরবি ভাষায় ‘তাসওয়ীর’ বলা হয়; তথাপি সেটি تخليق বা সৃষ্টিকর্ম নয়। বরং এক ধরণের reflection বা প্রতিবিম্ব। ক্যামেরা লেন্সের মাধ্যমে আলোকরশ্মি ধারণ করে প্রতিবিম্ব তৈরি করে। আমরা যেভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে দেখি, ক্যামেরাও একইভাবে আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে বস্তুর অবয়ব ধারণ করে। নাম ‘তাসওয়ীর’ হলেও হাতে বানানো চিত্র বা প্রতিকৃতি আর ক্যামেরায় ধারণ করা প্রতিবিম্ব এক নয়। তাই প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি হারাম হওয়ার পেছনের প্রথম উদ্দেশ্যটি এখানে অনুপস্থিত। এ জন্য উলামায়ে কেরাম ক্যামেরায় তোলা ছবি ও ভিডিওকে চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতির আওতাভুক্ত করেননি। চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি হারাম হওয়ার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শিরকের আশঙ্কা এখানেও বহাল। তাই ক্যামেরায় তোলা ছবি ব্যবহার করে শিরকের সম্ভাবনাযুক্ত যে কোনো কাজ করা স্পষ্টত হারাম।
এ সবগুলো বিষয়কে সামনে রেখে আরব ও অনারব উলামায়ে কেরামের দুটি মতামত পাওয়া যায়।
এক. প্রাক-আধুনিক যুগের কিছুসংখ্যক উলামা ছবি তোলাকে সরাসরি হারাম বলেছেন। আজও স্বল্পসংখ্যক উলামা একান্ত অনিবার্য প্রয়োজন (Dire necessity) ব্যতীত ছবি তোলা হারাম মনে করেন।
দুই. আরব-আজমের সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামা ক্যামেরায় ছবি ও ভিডিও ধারণ করাকে জায়েয বলেছেন, যেহেতু এখানে প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি হারাম হওয়ার পেছনের ‘ইল্লাত’ তথা কারণ ও উদ্দেশ্য উপস্থিত নেই। যেহেতু ‘ইল্লাত’ নেই, সেহেতু হুকুমও নেই। তবে একইসাথে তাঁরা বলে দিয়েছেন যে-
★ প্রয়োজন ব্যতীত অহেতুক ছবি তোলা নিন্দনীয় কাজ।
★ যা সাধারণভাবে হারাম, তার ছবিও হারাম। উদাহরণস্বরূপ, বেপর্দা অবস্থায় নিজেকে প্রদর্শন করা যেহেতু হারাম, এ অবস্থার ছবি প্রদর্শন করাও হারাম।
★ মানুষ বা অন্য জীবজন্তুর ছবি ঘরে লটকিয়ে রাখা হারাম। এতে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।
★ শিরকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধা বা উপাসনার জন্য ছবির ব্যবহার হারাম।
যদিও প্রথমোক্ত মতটি তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী; তথাপি সামগ্রিক প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান যুগের প্রায় সব আলিম-উলামা ২য় মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। পরিশেষে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা’আলার কাছে নিহিত।।
-মারজান আহমদ চৌধুরী
পছন্দের আরো লেখা