১৯৯০ পর্যন্ত ইয়েমেন দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একটা দক্ষিণ ইয়েমেন আরেকটা উত্তর ইয়েমেন নামে পরিচিত ছিল, যদিও এগুলো অফিশিয়াল নাম নয়।
দক্ষিণ ইয়েমেনের রাজধানি ছিল বিখ্যাত বন্দরনগরি এডেন। বাব আল মানদেবের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রণালি এবং লোহিত সাগরে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্রিটিশরা দক্ষিণ ইয়েমেনকে নিজেদের কলোনি বানায় ১৮৩৯ সালে। ১৯৬৭ সালে তারা কলোনি গুটিয়ে নেয়।
ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট, আরব বসন্তে উৎখাত হওয়া আলি আবদুল্লাহ সালেহ বলেছিল যাদের নিয়ন্ত্রণে বাব আল মানদেব আর হরমুজ প্রণালী থাকবে, তাদের পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন নেই। বাব আল মানদেব দিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন ৪ মিলিয়ন ব্যারল তেল সরবরাহ হয়।
ওদিকে উত্তর ইয়েমেনে ছিল ‘ইমামত’ বা শিয়া ধর্মীয় রাজতন্ত্র। ১৯৬২ সালে রাজতন্ত্র উৎখাত করে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়। যায়েদি শিয়াদের মধ্য থেকে একজন ইমাম রাষ্ট্রের সর্বসের্বা থাকত। বর্তমান হুথিরাও যায়েদি শিয়া।
উত্তর ইয়েমেন হচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল, পক্ষান্তরে দক্ষিণ ইয়েমেন প্রাকৃতিক সম্পদশালী। বৃটিশদের চলে যাওয়ার পর দক্ষিণ ইয়েমেন সোভিয়েত ব্লকে যোগ দেয়। এটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ তারা পশ্চিমাদের দ্বারা শোষিত-নির্যাতিত হয়েছে বহুদিন।
এভাবে ১৯৬৭ র পর দক্ষিণ ইয়েমেন চলে যায় সোভিয়েত ব্লকে, আর উত্তর ইয়েমেন ১৯৬২ র পর পশ্চিমা ব্লকে যোগ দেয়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুই ইয়েমেন একত্র হয়ে বর্তমান ইয়েমেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
..
যারা মধ্যপ্রাচ্যের সব সমস্যার সমাধানে শিয়া-সুন্নি টোটকা নিয়ে হাজির হন, তাদের জন্য ইয়েমেন খুবই জটিল এক কেস স্টাডি।
ভৌগোলিক পার্থক্যের পাশাপাশি ইয়েমেনের রাজনৈতিক বিভাজনও তীব্র। দক্ষিণের অনেকে কখনোই উত্তরের সাথে একীভূতকরণ মেনে নেয়নি। তাদের দাবি ছিল এবং এখনো আছে- দক্ষিণের সম্পদ শুষে উত্তর আর উত্তরের রাজধানি সানার উন্নয়ন হচ্ছে। দক্ষিণীদের ভাগ্যে কিছু জুটে না।
আবার উত্তরেও ছিল শিয়া সুন্নি দুইদল। সুন্নিদের দলের নাম ইসলাহ, নোবেল বিজয়ী কিরমান তাওয়াক্কুল এই ইসলাহের সদস্য। শিয়ারা দুইদলে বিভক্ত। একটা আলি আবদুল্লাহ সালেহের জেনারেল পিপলস কাউন্সিল। আরেকটা ছিল বিদ্রোহী হুথিরা।
ফলে দক্ষিণপন্থী স্বাধীনতাকামি, উত্তরের সুন্নি ইসলাহ পার্টি, জেনালের পিপলস কাউন্সিল ও হুথিরা মিলে জটিল এক সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
উৎখাত হওয়া প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ শিয়া হওয়া সত্ত্বেও তার মিত্র ছিল সুন্নি বিরোধিদল ইসলাহ। একই সাথে প্রধান বিরোধিদল এবং প্রধান মিত্র!
অথচ স্বজাতি শিয়া হুথিরা ছিল তার আড়াই দশকের শাসনামলের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং গোটা সময়টা জুড়ে হুথিরা সালেহের বিপক্ষে সশস্ত্র প্রতিরোধ চালিয়েছে।
কিন্তু উৎখাত হওয়ার পর এতদিনের মিত্র ইসলাহ হয়ে যায় সালেহের শত্রু, সে হুথিদের সাথে যোগ দেয়। আবার মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নিজমের সোল এজেন্ট সৌদি আরব ছিল ‘শিয়া’ সালেহের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
উৎখাত হওয়ার পর সৌদিই শিয়া সালেহকে আশ্রয় দেয়। তার চিকিৎসা করে। ইরান দেয়নি।
কিন্তু ইয়েমেনে ফিরে এসে সালেহ ইরান সমর্থিত, তার সারাজীবনের শত্রু হুথিদের সাথে হাত মেলায়। শেষমেশ ২০১৭ সালে হুথিদের হাতেই সে নিহত হয়। সৌদি সমর্থিত জোট বাহিনির সাথে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক- এই ঘোষণার পরপরই সৌদি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যাওয়ার পথে রকেট হামলায় নিহত হয়।
ওদিকে আবার ইসলাহ যেহেতু সুন্নি, এবং রাজনৈতিক দল, তাই সৌদির দৃষ্টিতে তারা ইখওয়ানি। ফলে ২০১৪ সালে ইসলাহর নাম সৌদির কালো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদলের তালিকায় উঠে। আবার মাত্র একবছর পরেই ২০১৫ সালে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ইসলাহর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে সৌদি আরব হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।
..
এই জোটে সৌদি এবং আরব আমিরাত ইসলাহিদের সহায়তা করে। কিন্তু দক্ষিণ ইয়েমেনে আমিরাত আবার দক্ষিণপন্থী স্বাধীনতাকামীদেরকে মদত দিতে শুরু করে। যারা সৌদি সমর্থিত ইসলাহিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত। এবং সবশেষে তারা এসটিসি’র (সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল) অধীনে দক্ষিণ ইয়েমেনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।
ইয়েমেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য হচ্ছে যদি দক্ষিণ ইয়েমেন এখন হুতিদের দখলে থাকত, তবে আমিরাত হুথিদেরকেই সমর্থন দিত। কারণ তার চোখ দক্ষিণের প্রাকৃতিক সম্পদ আর বাব আল মানদেবের দিকে। সেখানে আমিরাত বিনিয়োগ করতে চায়, মানদেবের নিয়ন্ত্রণ চায়।
ফলে একই জোটে থেকেও সৌদি-আমিরাত পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে।
..
এই মাসের দশ তারিখ অর্থাৎ ১০ ই নভেম্বর সৌদির হাইআতু কিবারিল উলামা অর্থাৎ সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিশেবে ঘোষণা করেছে। ইয়েমেনের ইসলাহ সরাসরি এর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কারণ বহির্বিশ্বে তারা ইখওয়ানের শাখা হিশেবে পরিচিত। সৌদিতে তাদের বহু নেতা আশ্রয়ে আছে। ইয়েমেনে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। আবার এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সন্ত্রাসী হিশেবে চিহ্নিত করছে। এখানে এটাও ইন্টারেস্টিং যে সৌদি-ইখওয়ান একই জোটে!
গতকাল ২৪ শে নভেম্বর আমিরাতের শরিয়া কাউন্সিলও ইখওয়ানকে সন্ত্রাসী দল আখ্যায়িত করেছে।
..
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সৌদি কি আদৌ হুথিদের পরাজয় চেয়েছে? এমনিতেই ইয়েমেন আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র, সবচেয়ে কম প্রাকৃতিক সম্পদশালী। সৌদি সবসময় চেয়েছে একটি দুর্বল-রুগ্ন-দুর্ভিক্ষপীড়িত ইয়েমেন। কারণ দোরগোড়ায় কেউই শক্তিশালী প্রতিবেশী চায় না।
এখন যদি হুথিরা গোটা ইয়েমেন দখলে নেয়, এর মানে হচ্ছে ইরানের দখলে যাওয়া। পক্ষান্তরে সৌদি সমর্থিত ইসলাহ কর্তৃক ক্ষমতাদখলের মানে হচ্ছে ইখওয়ানের হাতে ক্ষমতা যাওয়া। সৌদির দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু সব ‘সমস্যার সমাধান’ হয়ে যায় যদি ইয়েমেন স্থায়ীভাবে ‘সমস্যায়’ জড়িয়ে যায়। যেটা এখন হচ্ছে। একদিকে উত্তর-দক্ষিণ সংঘর্ষ, আবার হুথি-ইসলাহ যুদ্ধ, শিয়া-সুন্নি বিদ্বেষের সফল উত্থান, সৌদি-আমিরাত স্বার্থের ভিন্নতা, সব মিলে ইয়েমেন মোটামুটি কয়েকদশকের জন্য শেষ!
সৌদির সুদিন শুরু। তবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য এখনো দেখার ঢের বাকি।