পৃথিবীর সবকিছুই সুনির্দিষ্ট নিয়মে চলে। যেমন চলে চাঁদ। ত্রিশদিনের একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় তাকে। নিয়মানুযায়ী শেষের পনের দিন চাঁদ আলোহীন এবং প্রথম পনের দিন চাঁদ আলোকিত। আবার তাঁর মধ্যে তিন দিন পর্যন্ত চাঁদ দেখতে হয় অপরূপ, পূর্ণ দীপ্তিময়। মানবসভ্যতাও অনেকটা এমনই। মানবসভ্যতাতেও বিদ্যমান এই কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লাপক্ষ। ইসলাম ধর্মে মানবসভ্যতার কৃষ্ণপক্ষের এই সময়টাকে বলা হয়- আইয়্যামে জাহেলিয়া বা বর্বরতার যুগ। আরব দুনিয়ায় এই বর্বরতার যুগ শুরু হয় ইসা আলাইহিস সালাম’র আড়াল হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু, এই অমাবস্যাতো স্থায়ী নয়। একদিন তা কেটেই যায়। ঠিক আরব সভ্যতার অমাবস্যাও কেটে যাওয়ার আভাস মিলল। চাঁদ উদিত হওয়ার নিদর্শন মিলতে লাগল। হঠাৎ একদিন, দীর্ঘ অন্ধকার, বর্বরতা এবং কুসংস্কারচ্ছন সভ্যতায় আলোর দিশারির ঘটল অবির্ভাব। এ যেন ঘোর অমাবস্যার পর পূর্ণিমার আভাস।
৬৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় হযরত আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ঘরে অবির্ভাব ঘটলো পূর্ণিমা ছড়ানো দাগহীন এক পূর্ণ চাঁদের। আলোকিত হয়ে উঠল হযরত আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ঘর। সব্যসাচী লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন,
“দ্বাদশ রজনী- সোমবার – রবিউল আওয়াল
বক্ষে তাঁকে পেয়ে হলো হর্ষে মত্ত, উদ্দাম, উত্তাল।
সোমবার – রবিউল আওয়াল – দ্বাদশ রজনী
ধন্য হলো বক্ষে পেয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রত্নমণি।
রবিউল আওয়াল – দ্বাদশ রজনী – সোমবার
সালামে – চুমবনে তাঁকে রোমাঞ্চিত নিজেই বারবার।”[১]
অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার থেকে গোটা মানবসভ্যতার আলোর দিশারি আজ পৃথিবীতে পদার্পন করলেন। বিশ্বমানবাতার মূক্তির দূত পদার্পন করলেন। প্রথমবারের মত পদর্পন করলেন, দুনিয়া সৃষ্টির একমাত্র কারণ, রসুলে কায়েনাত, হাবিবে খোদা, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মোল্লা আলী ক্বারী হানফি রাহিমাহুমুল্লাহ এই চিত্রপটকে কল্পনা করেই বলেছেন,
“তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন বসন্তকাল। যাঁর আগমনে সৃষ্টি হয়েছে নব বসন্তের জোয়ার। জাগতিক বসন্তের চেয়ে তিনি ছিলেন লাখ-কোটি গুণ অধিক আলো দানকারী নূর।”[২]
ঠিক এই কথাই ইমাম আহমদ রেযা রহিমাহুমুল্লাহ বলছেন,
“ওহ সুয়ে লালাহ যার ফিরতে হে
তেরে দিন আয় বাহার ফিরতে হে।”
অর্থ- সে (দঃ) আসে সাথে বাতাসে বসন্ত ফিরে
ফাগুনের উদ্বধোনের দিগন্ত জুড়ে।
কুরআনুল করিমে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করছেন,
“তাদেরকে আইয়্যামুল্লাহ(আল্লাহ’র দিবসসমূহ) স্মরণ করিয়ে দাও।[৩]
ক্বামূস-এর মধ্যে রয়েছে যে, ‘আইয়্যামুল্লাহ’ দ্বারা ‘আল্লাহ’র অনুগ্রহরাজি’র কথাই বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস, উবাই ইবনে কা’ব, হযরত মুজাহিদ এবং ক্বাতাদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ‘আইয়্যামুল্লাহ’-এর ব্যাখ্যা ‘আল্লাহ’র অনুগ্রহসমূহ’ দ্বারা করেছেন (তাফসিরে খাযিন, মাদারিক ও ইমাম রাগিব কৃত মুফরাদাত)।[৪] আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রেরিত সর্বোত্তম অনুগ্রহ সমন্ধে জানিয়ে মুমিনদেরকে ইরশাদ করছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ্ মুমিন বান্দাদের উপর এক বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কল্যাণের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করেছেন।[৫]
এমন মহান নে’মত পেলে আমরা কী করবো? সেই করণীয় সমন্ধেও আল্লাহ্ তায়ালা জানাচ্ছেন,
“আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও তারই দয়া, সেটার উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।”[৫]
আল্লাহ’র আদেশ মোতাবেক আমাদেকে তাঁর অনুগ্রহসমূয় স্মরণ করতে হবে, নে’মত প্রাপ্তিতে শুকরিয়া আদায় এবং আনন্দ উদযাপন করতেই হবে। করতেই হবে এই কারণে যে, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে আল্লাহ্ তায়ালা নে’মত বৃদ্ধি করে দেন। আর অস্বিকার করলে রয়েছে কঠিন আযাব।[৭]
মক্কার মরুময় অঞ্চলে ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় হযরত আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র ঘর আলোকিতা সেই নূরের রশনিতে দুনিয়ার পূর্ব পশ্চিম আলোকিত হয়ে উঠেছে। মুক্তি পেয়েছে মানবতা। প্রধান্য পেয়েছে মানবিকতা।
নজরুল বলেন,
“তাপীর বন্ধু, পাপীর ত্রাতা,
ভয়-ভীত পীড়িতের শরণ-দাতা,
মূকের ভাষা নিরাশের আশা,
ব্যথার শান্তি, সান্ত্বনা শোকে
এল কে ভোরের আলোকে।”[৮]