১৯৮৭ র সেপ্টেম্বরে আমেরিকার বেশকিছু পত্রিকায় পুরো পৃষ্ঠাব্যাপি একটি কলাম ছেপেছে। শিরোনাম- ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে খোলা চিঠি।
সেই চিঠিতে তিনি মার্কিন প্রশাসনকে আহবান জানিয়েছেন সৌদি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ যেসব দেশকে আমেরিকা নিরাপত্তা দেয়, বিনিময়ে তাদের থেকে টাকা নেওয়ার জন্য। তার ব্যক্তিগত হিশাব অনুযায়ী সেসময়ই টাকার অঙ্কটা ছিল ৯৪ হাজার ডলারের বেশি।
নির্বাচনের পূর্বে ট্রাম্প সেই হিশাব থেকে সরে আসেন। নির্বাচনি এক সভায় বলেছিল সৌদিরা ভালো লোক। তারা আমার থেকে এপার্টমেন্ট কিনে। ৫০ মিলিয়ন, ১০০ মিলিয়ন কিংবা আরও বেশি দামের।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর ছিল সৌদিতে, সেখানে অনেক ‘নয়ছয়’ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের প্রথম পদক্ষেপ।
মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইজরায়েল। ইজরায়েলের জন্মের পর থেকে আমেরিকা তাদেরকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু সব প্রেসিডেন্টই একটু রয়েসয়ে করেছে। ইজরায়েলকে রানটা দিলে ফিলিস্তিনিদের জন্য অন্তত গলার হাড়টা রেখেছে। ব্যতিক্রম ছিল ট্রাম্প। সে ফিলিস্তিনের ভাগেরটাও নিয়ে ইজরায়েলকে দিয়েছে।
ট্রাম্পের এই নগ্ন ফিলিস্তিন নীতির প্রধান কুশীলব হচ্ছে শেলডন এডেলসন। মার্কিন ক্যাসিনো সম্রাট। আমেরিকায় ইহুদি লবির অন্যতম প্রধান ডোনার। ট্রাম্পের নির্বাচনে সে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঢেলেছে।
বিগত নির্বাচনে সে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। এবার করোনার কারণে ব্যবসা মন্দা। তাই ফোর্বসের তথ্যমতে এবারের নির্বাচনে সে ব্যয় করেছে মাত্র ১৮০ মিলিয়ন ডলার!!
সাথে আছে ট্রাম্পের জামাতা জেরড কুশনার। ট্রাম্প অরগানাইজেশনের দুই আইনজীবী- ডেভিড ফ্রায়েডম্যান ও জ্যাসন গ্রিনব্ল্যাট। ফ্রায়েডম্যান এক কট্টর ইহুদি রাব্বির সন্তান। ট্রাম্পের সময়ে ইজরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিশেবে নিয়োগ পায়।
অবৈধ ইহুদি দখলদারি ও ফিলিস্তিনিদের ভূমিগ্রাসের একনিষ্ঠ সমর্থক সে। এবং অবৈধভাবে দখলকৃত জমিতে বাসস্থান নির্মাণের জন্য ২ মিলিয়ন ডলারের অধিক তহবিল সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি নিজেও একজন ডোনার।
গ্রিনব্ল্যাট ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক সংলাপের জন্য বিশেষ প্রতিনিধি হিশেবে নিয়োগ পায়। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিশেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তার ভাষ্যমতে- পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইজরায়েলি বসতি স্থাপন শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য কোনো বাঁধা নয়।
এই চারজন ছিল ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রধান খেলোয়াড়। তার সময়ে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন আড়াই গুণ বৃদ্ধি পায়। চারবছরে ২৬ হাজারের অধিক বাড়ি নির্মিত হয়, যেখানে পূর্ববর্তি চারবছরে এই সংখ্যাটা ছিল ১০ হাজার।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে চারমাসের মাথায়ই ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দকৃত মার্কিন অর্থসাহায্য বাতিল করে দেয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইজরায়েলের রাজধানী হিশেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয় এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়।
২০১৮ সালের মে তে দূতাবাস স্থানান্তর সম্পন্ন হয়। এর অর্থায়ন করেছে শেলডন এডেলসন, চেনা কালপ্রিট। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সে আবেগে কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছিল, ওদিকে একই দিনে ৬০ ফিলিস্তিনি ইজরায়েলিদের গুলিতে শহিদ হয়।
ট্রাম্পের সময়ে ফিলিস্তিনে মার্কিন অফিস এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিলিস্তিনি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়।
……………………
১৯৮৬ সালের জুন মাসে তুলনামূলক তরুণ সিনেটর জো বাইডেন অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় ভাষণ দিচ্ছে, সিনেটে।
‘ইজরায়েলকে সমর্থন করার কারণে আমেরিকার লজ্জিত হওয়া বন্ধ করতে হবে। আমরা যে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছি, তা যথাযথ ছিল। যদি ইজরায়েল না থাকে তাইলে মার্কিন স্বার্থও থাকবে না, তখন বরং আরেকটি ইজরায়েল তৈরি করতে হবে আমাদের’।
পরেরবছর থেকে ইজরায়েল নিয়মিত ৩ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সহায়তা পেতে শুরু করে। সংখ্যাটা আরেকবার দেখুন ৩ বিলিয়ন, নট মিলিয়ন! তাও ১৯৮৭ সালে!!
এই ভাষণের ১৩ বছর আগে ১৯৭৩ সালে জো বাইডেন প্রথমবারের মত সিনেটর নির্বাচিত হয়। তৎকালীন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ারের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়, ইজরায়েল সফরে গিয়ে। বাইডেন জীবনে বহুবার বলেছে এই মিটিং ছিল তার জীবনের মাইলফলক। তখন থেকেই সে ইজরায়েলের নিরঙ্কুশ সমর্থক। ইজরায়েলি স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী।
পাশাপাশি বর্তমান ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব, তাও ত্রিশ বছর ধরে।
সুতরাং ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বাইডেন স্পষ্টতই বলেছে যদিও জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরে তার আপত্তি ছিল, কিন্তু এখন তা পুনরায় তেল আবিবে ফিরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা নেই।
ট্রাম্পের ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির অধীনে যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শুরু হয়েছে তা চালিয়ে যাবেন। একমাত্র ভালো সংবাদ হচ্ছে ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনি অফিস পুনরায় খুলে দিবে।
অনেকেই খুব জোরেশোরে প্রচার করছে বাইডেন ফিলিস্তিনিদের জন্য মার্কিন সহায়তা পুনরায় চালু করবে। এখানে একটি ‘কিন্তু’ রয়েছে। এই অর্থ দেওয়া হবে এই শর্তে যে- এগুলো থেকে কোনোকিছু ফিলিস্তিনি কারাবন্দী পরিবার এবং ইজরায়েল কর্তৃক ঘোষিত ‘সন্ত্রাসী’ পরিবারকে দেওয়া যাবে না!
কিন্তু কথা হল ইজরায়েলের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী নয় কে? বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, নিজের ঘর ভেঙ্গে সেখানে দূতাবাসের বিরোধী, ইজরায়েলি লম্পট সেনাদের আদেশে চেহারা দেখাতে অস্বীকৃতি জানানো হাদি হাশলামুন, সবাই সন্ত্রাসী।
সুতরাং এই শর্তে পাওয়া অর্থ আদৌ ফিলিস্তিনে পৌঁছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।