আজ শহীদ নূর হোসেন দিবস। এই দিবসটি একসময় ঘটা করে পালন করা হতো। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এই দিবসটি পালন করতো। ২৯ বছরের মাথায় এসে নূর হোসেন আমাদের মাঝে বিস্মৃত এক নাম। বর্তমানে কোন দলই পারতঃপক্ষে নূর হোসেনের নাম নেয় না। ক্ষমতাসীরা তো মোটেই নয়। কারণ, ক্ষমাসীনদের ক্রুব্ধ ইচ্ছার কুঠুরীতেই গণতন্ত্রের ভোমরাটি বন্দি থাকে। তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশেরই ক্ষমতাসীনরা চায় না, স্ব স্ব দেশে গণতন্ত্র চালু থাক। কারণ, গণতন্ত্র চালু থাকলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমঅধিকার, সুশাসন এবং প্রতিটি কাজের জবাবদিহীতা থাকতে হয়। আর এটাতেই ক্ষমতাসীনদের যতো আপত্তি। কোন দেশ গণতান্ত্রিক কি-না তা কীভাবে জানবেন? গণতন্ত্র চালু থাকলে সেখানে ‘বাক স্বাধীনতা’ নিশ্চিত থাকে। গণতন্ত্র থাকলে সে দেশে প্রত্যেক নাগরিকের ‘সমঅধিকার’ থাকে, কোন ব্যক্তি, দল বা সম্প্রদায়ের প্রতি জালেমানা আক্রোশ যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না- কোন ব্যক্তি, দল বা সম্প্রদায়ের প্রতি একচেটিয়া দৃষ্টিকটু পক্ষপাতিত্ব। একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মের ও কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। আবার সেই স্বাধীনতাটা কোন অবস্থাতেই সেই দেশের সার্বভৌমত্বের বিরোধী হতে পারবে না। সেই দেশের জাতিসত্ত্বার বিরোধী হতে পারবে না। সেই স্বাধীনতাটা অন্য কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী হতে পারবে না।
তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের যে নমূনা আপনারা দেখছেন- তার একটিও গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় পড়ে না। গণতন্ত্র বা ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘ডেমোক্রেসিয়া’ থেক-যার অর্থ “জনগণের শাসন”। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে এথেন্স ও অন্যান্য নগর রাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিলো এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে সনাতনী রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময় (Demoi) এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয়। যার পরে নাম হয় ডেমক্রেশিয়া (Democratia), যার অর্থ হচ্ছে- জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)।
সে হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ মানেই জনগণের শাসন। কোন দেশের সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা লেখা থাকলে, কিংবা পাসপোর্টে ‘রিপাবলিক’ শব্দটি লেখা থাকলে অথবা ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা রোজ তিনবেলা নিয়ম করে ‘গণতন্ত্রের সবক’ দিলেও রাস্ট্রটি গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। পহেলা নম্বরে একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্র মুখে উচ্চারণ বা কাগজে লেখার নাম নয়, গণতন্ত্র হলো- আচরণের নাম, আদর্শের নাম। ক্ষমতাসীন কর্তারা তার নাগরিকদের প্রতি কী আচরণ করছেন- তা দেখেই বুঝা যায়, দেশটি আদৌ গণতান্ত্রিক কি-না? যদি ক্ষমতাসীনরা ‘জনগণের দ্বারা নির্বাচিত’ হয়ে দেশ শাসনে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন’ ঘটান, তো বুঝবেন- ‘দেশটি গণতান্ত্রিক’। এটিই গণতন্ত্রের মৌলিক কথা। এই দু’টি মৌলিকত্ব যদি না থাকে, তাহলে অবশ্যই বুঝে নেবেন- দেশটি গণতান্ত্রিক নয়। এর বিপরীতে যে যাই বলুক- ‘সবই স্রেফ বকওয়াজ’।
বিভিন্ন সময়ে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দার্শনিক ও মণীষী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আমি আমার কথার সমর্থনে এখানে দু’টি সংজ্ঞা উল্লেখ করবো। এই দু’টি সংজ্ঞার সাথে পৃথিবীর সকল শাসক এমনকি স্বৈরশাসকরাও একমত পোষণ করেছেন। ১. খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে Clean ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- That shall be the democratic which shall be the people, for the people. তার অনেক অনেক পরে আব্রাহাম লিঙ্কনও প্রায় একই রকম কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- ‘Government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the Earth’ (জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।)। আমি গণতন্ত্রের যতোগুলি সংজ্ঞা পড়েছি- এই দু’টি (মূলতঃ একটি) সংজ্ঞার চেয়ে কোন সুন্দর এবং বাস্তব সংজ্ঞা আজও পাইনি।
এই সংজ্ঞা দিয়ে যে কেউ তার দেশটি বা অন্য কোন দেশ গণতান্ত্রিক কি-না, তা সহজেই যাচাই করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমি আমার সম্মানিত পাঠক/পাঠিকাদেরকে শহীদ নূর হোসেনর বুকে-পীঠে উৎকীর্ণ স্লোগানটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করবো। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তিনি সাদা কালিতে বুকে লিখেন ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ আর পীঠে লিখেছেন- ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ছয়টি শব্দে মাত্র দুটি কথা! কিন্তু অসংখ্য কথার সমাহার। আমার মতো নাদান মূর্খও যদি এই দু’টি কথার ব্যাপকতা নিয়ে লিখতে যাই- তো দিনের পর দিন লিখতে পারবো। কিন্তু লিখে কী হবে? আমার লেখা কেউ পড়েও না, পড়লে আমলও করে না। ‘মস্তিষ্ক বিকৃত’ লোক লিখলেই কি আর না লিখলেই বা কি? শহীদ নূর হোসেনের আগে পৃথিবীতে কেউ নিজের শরীরকে এভাবে পোস্টার বানিয়েছেন কি-না আমার জানা নেই। তবে এটা জানি যে, তাঁর এই ছবিটি সে সময় বিশ্বমিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। তৎকালীন স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু আজও গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি? কিংবা জবরদস্তির ‘ক্রুব্ধ গণতন্ত্রে’র যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গণতন্ত্রের প্রাণ ভোমরাটি কি এখনো আহাজারি করছে না? অথবা গণতন্ত্রের খোলসে ‘কঠিন ও জটিল স্বৈরতন্ত্রের’ কারাগারে বন্দি ‘বন্ধ্যা গণতন্ত্র’ কি বোবাকান্নায় আহাজারি করছে না? প্রিয় পাঠক! আপনারা কি তা দেখতে পান এবং শুনতে পান?
তারিখ: ১০ নভেম্বর, ২০২০ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।