পশ্চিমের উন্নত দেশের মতো আমাদের এত উন্নত জীবন ব্যবস্থা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও চাকচিক্য নেই কিন্তু আমাদের সুখী হওয়ার মতো একটি ব্যবস্থা আছে যা তাদের নেই। আর তা হলো দৃঢ় আত্মীয়তার বন্ধন এবং সামাজিক সম্পর্ক। হাজার বছর ধরে মুসলিম সমাজ এই ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে সুখী জীবন যাপন করে আসছে।
একজন আত্মীয় তার আত্মীয়ের জন্য বা তাদের ছেলেমেয়েদের কল্যাণের জন্য কত ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন! তাদের একটু সুখের জন্য নিজের ধন সম্পদ এমনকি জীবন বিসর্জন দিয়েছেন । এই রকম ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যেত ।
কিন্তু আমাদের এই মহামূল্যবান ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। উপনিবেশিক শাসনের পর থেকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পূঁজিবাদের ব্যাপক আমদানি হয়েছে। ফলে সমাজের মানুষজন একটু আধুনিক হওয়ার জন্য মানবতার চশমা খুলে রেখে পুঁজিবাদের চশমা দিয়ে সব কিছু দেখা শুরু করেছে। সবকিছু দেখতে শুরু করেছে লাভ ক্ষতির ভিত্তিতে। এমনকি সন্তান তার বাবা-মায়ের দেখাশোনা কিংবা ভাই তার ভাইবোনের খোঁজ খবর নেওয়ার ক্ষেত্রেও লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে!!
সম্পত্তির বন্টন নিয়ে প্রায় ভাই তার ভাই/বোনের সাথে, ছেলে তার বাবার সাথে, ভাতিজা তার চাচার সাথে সম্পর্ক চির বিচ্ছিন্ন করে রাখে। শুধু তাই নয় একজন অন্যজনকে ঘায়েল করার জন্য মামলা হামলারও আয়োজন করে। এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটে। অথচ আজ থেকে দুই দশক আগেও ভাই তার ভাইবোনকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে দিতো। ভাই তার বোনের বিয়ের জন্য প্রয়োজনে বাড়িঘর বন্ধক রাখতো। কোথায় হারিয়ে গেলো সেই ভালোবাসার বন্ধন!
আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যে ছিলো আতিথেয়তা। মেহমান অপরিচিত হলেও তাকে সাধ্যমত সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করানো ছিলো আমাদের কালচার। কি দুর্ভাগ্য! এখন আমাদের আতিথেয়তার মধ্যেও পূঁজিবাদের ছায়া পড়েছে। এখন অপরিচিত দূরে থাক, আপন আত্মীয় স্বজনের আতিথেয়তার ক্ষেত্রেও ধনী গরিবের ভিত্তিতে সমাদর করা হয়। অধিকাংশ মানুষ খরচের ভয়ে আত্নীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখে না। অথচ তারা জানে না আত্মীয় স্বজনদের জন্য খরচ করলে তা কমে না বরং বৃদ্ধি পায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের রিজিক প্রশস্ত হওয়া ও নিজের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি হওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। (বুখারি ও মুসলিম)
সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে আমাদের পরিবার কাঠামোতে। বিগত কয়েক বছরে পরিবার ভাঙ্গার মাত্রা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আমাদের জাতির জন্য ভয়ংকর হুমকি। ২০১৮ সালে বিবিএস এর এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরে প্রতি ঘন্টায় ১ টি তালাক হচ্ছে। (প্রথম আলো) অনেক সময় খুবই তুচ্ছ কারণে তালাক হচ্ছে। তাদের এই স্বার্থের বলি হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। খুব ছোট বয়সেই অভিভাবক হারাচ্ছে। তালাক বৈধ হলেও ইহা নিকৃষ্ট হালাল। পরিবার ভাঙ্গার এই দূর্যোগ ঠেকানোর জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন একে অন্যের নিকট দায়বদ্ধ। একে অন্যের খোঁজ খবর নেয়া, বিপদ-আপদে সাহায্যে করা, সুখে-দুঃখে অংশীদার হওয়া এবং প্রয়োজনের সময় পাশে থাকা একান্ত কর্তব্য। শুধু কর্তব্য নয় বরং অবশ্যই করণীয়। আর ইহাই মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহর কিছু নির্দেশ আছে, যে নির্দেশ অমান্যকারীকে আল্লাহ পরকালে পাকড়াও করবেন। আবার কিছু নির্দেশ আছে, যে নির্দেশ অমান্যকারীকে তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে অবশ্যই লাঞ্ছিত করেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এমনই একটি নির্দেশ। যা লঙ্ঘনের শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করতে হবে ।
রাসূলুল্লাহ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘দুনিয়াতে যে (দুই) অপরাধের শাস্তি আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর করে থাকেন এবং আখেরাতেও এর শাস্তি অব্যাহত রাখেন। সে দু’টি অপরাধ হলো- ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। (জামে তিরমিজি)
এজন্য আমাদের সমাজে অনেক মানুষ দেখা যায়, যাদের চারপাশে ভোগের কত আয়োজন আর চাকচিক্য কিন্তু তারা সুখী নয়। সবই আছে কিন্তু মনে হয় কিছুই নেই, সবই মরিচীকা। তাঁরা মানসিক অশান্তি অনুভব করে। ইহা এক প্রকার শাস্তি।
আমাদের সমাজে কত হাজী সাহেব, নামাজী, মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়ানো তাবলীগী কয়েক বছরেও আত্নীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর না নিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকেন । কিন্তু তাঁরা জানে না একটু অসতর্কতার কারণে এই ইবাদত মূল্যহীন হয়ে যায় ।
রাসূলুল্লাহ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের আমল প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমার রাতে আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কোনো আমল কবুল করা হয় না (আহমাদ)
আমাদের সমাজের মানুষজন কোন হাদিস জানুক বা না জানুক একটি হাদিস খুব ভালো করে জানে , “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে”। অধিকাংশ মুসলমানই বিশ্বাস করে তারা যতই পাপ করুক, জ্বলে পুড়ে একদিন অবশ্যই জান্নাতে যাবে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসাল্লাম এর অনেকগুলো হাদিসে কয়েক শ্রেণীর মুসলমান জান্নাতে যাবে না বরং জাহান্নামে যাবে বলে আমাদের সতর্ক করেছেন। তা আমাদের জানা নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম) রাসুল সাঃ এর এই ভয়ংকর হুশিয়ারির সত্ত্বেও জান্নাতের প্রত্যাশী মুসলিম সমাজের অধিকাংশ পরিবার আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নের রোগে আক্রান্ত।
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নের রোগে আক্রান্ত মুসলিমরা নিজেদের এই পাপ অধিকাংশ সময় স্বীকার করতে চান না। তারা অন্যের ঘাড়ে এই অভিযোগ চাপাতে চেষ্টা করেন। অধিকাংশই বলে আমি তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই কিন্তু সে আমার সাথে কথা বলে না তাই আমিও কথা বলি না। বাংলায় একটি কথা আছে এক হাতে তালি বাজে না। তদ্রুপ একজনের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হয় না। অবশ্যই সেখানে উভয়ের দোষ রয়েছে। অন্যজন আপনার সাথে সম্পর্ক না রাখলেও অবশ্যই আপনি সম্পর্ক রাখতে হবে। না হয় অবশ্যই আপনি এই পাপের জন্য শাস্তির প্রতিক্ষা করতে হবে।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী নয়, কোন আত্মীয় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেও সম্পর্ক ছিন্ন করে। রবং আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী ওই ব্যক্তি, যার সঙ্গে তার আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও সে পুনরায় তা স্থাপন করে। (বুখারি)
কোন আত্নীয় আপনার সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করলেও আপনাকে আজীবন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করে যেতে হবে। এজন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। না হয় আপনিও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন। আপনি সব চেষ্টার পরও অন্যজন সম্পর্ক নষ্ট করলে এর দায়ভার তার উপর বর্তাবে। জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রসুল, আমার এমন কিছু আত্মীয় আছে যাদের সঙ্গে আমি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলি, আর তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। আমি সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেই, কিন্তু তারা আমার সঙ্গে মূর্খের মতো ব্যবহার করে (এখন আমি কী করব)।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যা তুমি বলেছ, যদি ঘটনা এমনই হয়ে থাকে তাহলে তুমি তাদের ওপর যেন উত্তপ্ত ছাই নিক্ষেপ করছো। (মুসলিম)