১৯১২ সালের ১৮ অক্টোবর শুরু হয় প্রথম বলকান যুদ্ধ। বলকানের খৃস্টানরা তুরস্কের সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। ভারতের মুসলমানরা তুরস্কের সুলতানকে খলিফার মর্যাদা দিতেন। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার মুসলমানরা তুরস্কের সুলতানকে সহায়তার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করেন। বলকান যুদ্ধে একদিকে তুরস্ক অনাদিকে ছিল বুলগেরিয়া, সারবিয়া, গ্রীস, মন্টিনিগ্রো।
১৭ নভেম্বর ঢাকার নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে আহসান মঞ্জিল থেকে এক বিরাট মিছিল বের হয়। তুরস্কের সাহায্যের জন্য চাঁদা সংগ্রহার্থে এই মিছিল বের করা হয়। এই সময় এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারনা হয়। চকবাজার মসজিদে তুরস্কের সুলতানের বিজয়ের জন্য মুনাজাত করা হবে-এই ধর্মীয় জোশে উদবুদ্ধ হয়ে মিছিলটি পুরােভাগে ছিলেন খাজা আতীকুল্লাহ।
তার সহযাত্রী ছিলেন নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব পরিবারের অন্যান্য সদস্য, ঢাকার সরদারগণ ও শহরের অন্যান্য গণ্যমান্য লােক। মিছিলে অনেক হিন্দুও ছিলেন। চক মসজিদে আধা ঘন্টা মুনাজাতের পর নওয়াব সলিমুল্লাহ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন এবং জনসাধারণকে তুরস্কের রেডক্রস সােসাইটিতে চাঁদা দানের জন্য আহবান করেন। সেখানে বার শ টাকা সংগৃহীত হয় অতঃপর মিছিলটি লালবাগের প্রাচীন সেনানিবাস পর্যন্ত গমন করে।
সেখানেও আসরের নামাজের পর তুরস্কের জন্য দোয়া করা হয়। নামায পড়িয়েছিলেন একজন আরবদেশীয় সৈয়দ। ঐ স্থানে সলিমুল্লাহ সভাপতি রূপে দন্ডায়মান হয়ে আবেগময় কণ্ঠে রেডক্রস সোসাইটি তে সাহায্য দানের আবেদন করেন। মহল্লা সরদারগণ চাঁদা তুলেছেন এবং নওয়াব সাহেব স্বয়ং চাঁদা গ্রহণ করছিলেন। সংগৃহীত চাদা যথাসময় তুরস্কে পাঠানাে হয়।
১৮৭১ সালের ৭ই জুন সলিমুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নবাব আহসান উল্লাহ বৃটিশ, জার্মান, ফার্সী ও উর্দু গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সলিমুল্লাহর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হয়ে ময়মনসিংহে এবং ১৮১৫ সালে বিহারের মুজাফ্ফরবাদে ও কিছুদিন ত্রিপুরায় দায়িত্ব পালন করে ইস্তাফা দেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর টেলিগ্রাম মারফত পিতা নবাব আহসানউল্লাহর ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকায় ফিরে আসেন। দু’দিন পর জেষ্ঠ্য পুত্র বিধায় তিনি নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯০৩-৪ সালে ইংরেজ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার ওপর মতামত দিতে গিয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আহসান মঞ্জিলে এক সভা করে সরকারের বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার কিছু বিষয় বিরোধিতা করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের সুবিধার্থে ঢাকায় রাজধানী করে বৃহত্তর প্রদেশ গঠনের এক বিকল্প প্রস্তাবও দেন।
ভাইসরয় লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৯০৪ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নওয়াব সলিমুল্লাহর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওই সময় তাঁদের মধ্যে আলোচনার ফলে বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন ঘটে। এরপর ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গ বিভাগ কার্যকর হলে ঢাকা নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। কংগ্রেসের বিরোধিতার মুখে বঙ্গ বিভাগ টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনমত সংগঠিত করার ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠার দিনেই তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকার নর্থব্রুক হলে পূর্ববঙ্গের নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে গঠিত হয় ‘Mohammedan Provincial Union’ নামে একটি রাজনৈতিক সমিতি।
সে সময়ে এ সমিতি বাঙালি মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্লাটফরম হিসেবে কাজ করে। সলিমুল্লাহ তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন মফস্বল শহরে সভা করে নতুন প্রদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে কংগ্রেস এর বিরোধিতায় আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতি’ গঠন করেন এবং একই সালের ১৪ ও ১৫ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সমিতির প্রথম অধিবেশনে তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ ‘Muslim All India Confederacy’ নামে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর পরিকল্পনাটি বিবেচনার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন নেতা ও সমিতির নিকট প্রেরণ এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে আলীগড় আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাদের অনুরোধ করে ‘নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ (All India Mohammedan Educational Conference)-এর ২০তম অধিবেশন তিনি সম্পূর্ণ নিজ ব্যয়ে ঢাকায় আয়োজনের ব্যবস্থা করেন।
১৯০৬ সালের ২৭ থেকে ৩০ ডিসেম্বর নওয়াবের শাহবাগস্থ পারিবারিক বাগান-বাড়িতে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দসহ প্রায় দু সহস্রাধিক সুধী যোগ দেন। এতে তাঁর ছয় লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। নবাব সলিমুল্লাহ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেন্সী’ অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন; হাকিম আজমল খান, জাফর আলী এবং আরো কিছু প্রতিনিধি প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন।
কিছু প্রতিনিধির আপত্তির প্রেক্ষিতে কনফেডারেন্সী শব্দটি পরিত্যাগ করে লীগ শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়। অবশেষে সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ বা নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয়।তিনি এর সহ-সভাপতি এবং গঠনতন্ত্র তৈরি কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। এ সংগঠনের ব্যাপারে শুরু থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠী বিরূপ অবস্থান নেয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সম্পাদিত ‘দি বেঙ্গলি’ পত্রিকা নবগঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কে সলিমুল্লাহ লীগ হিসেবে অভিহিত করে।
১৯০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি নওয়াব সলিমুল্লাহ মুন্সিগঞ্জের রিকাবী বাজারে এক সভায় বক্তৃতা করেন। এতে তিনি সদ্য গঠিত মুসলিম লীগের মূলনীতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা প্রসংগে নওয়াব সাহেব প্রত্যেক পুরুষের কাছ থেকে মাসে এক পয়সা চাঁদা সংগ্রহ করে একটি তহবিল গঠনের আহ্বান জানান। কলকাতার বেঈলী’ পত্রিকায় এজন্য নওয়াব সলিমুল্লাহ ভিক্ষার ঝুলি হাতে তীর্থ যাত্রার দরবেশ বলে ব্যঙ্গ করে।
নতুন প্রদেশ গঠনের সময় থকেই নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অন্য নেতাদের দাবি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। ১৯১১ সালে ঘটে বঙ্গভঙ্গ।
গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসেন। সলিমুল্লাহসহ সহযোগী নেতারা হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দেন, প্রদেশ বাতিলের ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। ঢাকার মতো একটি অবহেলিত ও অনগ্রসর প্রাচীন নগরীতে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তখন অনেকের কাছেই ছিল অযৌক্তিক।কিন্তু সেই বুক ভরা স্বপ্ন দেখেছিলেন সলিমুল্লাহ।
বিশেষ করে তৎকালীন কলকাতার বাবু শ্রেণির প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই কদর্যতাপূর্ণ, হিংসা বিদ্বেষে ভরা। এর মাঝে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বযুদ্ধ। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যায় আরো পিছিয়ে। অনেক টানা পোড়নের পর সেই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি দেখে যেতে পারেন নি তার স্বপ্নদ্রষ্ট্রা নবাব খাজা সলিমুল্লাহ।
বঙ্গভব্দ রহিত হবার পর থেকেই নবাব সলিমুল্লাহ স্বপ্নভঙ্গের ব্যাধিতে ভুগতে থাকেন। এ.কে.ফজলুল হককে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারী কলিকাতা থেকে তাঁর ঢাকা ফেরার কথা ছিলো।
তিনি ফিরলেন, তবে জীবিতাবস্থায় নয়। ১৬ জানুয়ারী রাত ২-৩০ মিনিটে তাঁর কলিকাতার চোরঙ্গী রোডস্থ ৫৩ নং বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ১৬ জানুয়ারী বিকাল চারটায় কলিকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন ওয়েলসলী স্কোয়ার পার্কে নামাজে জানাযা শেষে ১৭ জানুয়ারী নবাব সলিমুল্লাহর লাশ ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় দু’টি জানাযা শেষে নবাবকে দাফন করা হয় বেগম বাজার পারিবারিক গোরস্থানে।
নবাবের মৃত্যু নিয়ে বেঁধে আছে বিশাল রহস্য। অনেক ঐতিহাসিক স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বললেও আমরা ইতিহাসবিদ সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদের লেখায় পাই ভিন্ন কথা। নবাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যখন রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি হিন্দু বাবু শ্রেণির চোখের কাঁটা।
তাইতো নবাবকে একেরপর এক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করে সামনে আগাতে হয়েছিল। গোড়া হিন্দু প্রভাবিত ব্রিটিশদের ও বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন কিছুটা। তারপরও দমে যান নি। পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের উন্নতির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ছিল সামনের দিকে।
বর্ণহিন্দুরা তাকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা চালায়। হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে, গুলি করে। ইতিহাস গবেষক মরহুম সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খণ্ডে- বইতে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বঙ্গভঙ্গ আইন বহাল রাখার দাবিতে কুমিল্লার এক জনসভায় খাজা সলিমুল্লাহর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে এক হিন্দুবাড়ি থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ফলে জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। নবাব বাহাদুর ঢাকা ফিরে আসেন। নবাবকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় অন্যপন্থা অবলম্বন করা হলো। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধানো হলো। হিন্দুরা সশস্ত্র, মুসলমানরা নিরস্ত্র, তাই মুসলমান বেঘোরে প্রাণ হারাতে লাগল। শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক ‘দি অটো বায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ : আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খণ্ড-, পৃ ২১৩)।
ইতিহাসবিদ কবি ফারুক মাহমুদ বলেন, হিন্দুদের চক্রান্তের ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড়লাটের সাথে নবাবের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে বড়লাট নবাবকে অপমানজনক কথা বলেন। তার সহ্য হয়নি। নবাবের সাথে সব সময় একটি ছড়ি থাকত। সে ছড়ি দিয়ে নবাব বড়লাটের টেবিলে আঘাত করেন। এ নিয়ে চরম তির্যক বাদানুবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়লাটের ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষী নবাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় বিনিদ্র প্রহরায় নবাবের লাশ ঢাকায় আনা হয়। তার আত্মীয়স্বজনকেও লাশ দেখতে দেয়া হয়নি। সামরিক প্রহরায় বেগম বাজারে তাকে দাফন করা হয়। (ওই; পৃ : ২২১) আর অকালেই পরিসমাপ্তি ঘটে একটি স্বপ্নের। যদিও পরবর্তীতে সেই স্বপ্নকে সত্যিকারে বাস্তবায়ন করেছিলেন কিছ বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশানার স্যাভেজ ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এতে ব্যয় ধরা হয় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। সরকার ত্রিশ হাজার টাকা বরাদ্ধ করে। নবাব সলিমুল্লাহ বাকী এক লক্ষ টাকা ও জমি দান করলে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “ঢাকা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ আরো অর্থ দান করে পিতার নামে স্কুলটির নামকরণ করেন। “আহসান উল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং”।
১৯৪৭ সালের পর স্কুলটি কলেজে উন্নীত হয়। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে কলেজটির উন্নতি করে প্রতিষ্ঠা করে ‘পূর্ব-পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ যা ছিলো তদানীন্তন প্রদেশের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর এটির নাম করণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি’ (বুয়েট)। নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে বুয়েট প্রতিষ্ঠিত।
এতিম মুসলিম ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ১৯০৮ সালে আজিমপুরে ২৮ বিঘা জমিদান করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা’। লেখাপড়ার জন্য এতিমখানায় ছেলেদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি করে দু’টি স্কুল রয়েছে। শত শত এতিম ছেলে মেয়ের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয় নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে খরচ করেছেন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই এতিমখানাটি বর্তমানে বিভিন্ন মানুষের দান করা অর্থে পরিচালিত হচ্ছে।
১৯০৫ সালেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ দান করেন। শিক্ষা সম্মেলন, শিক্ষা সমিতি, সর্ব ভারতীয় ও প্রদেশিক মুসলিম লীগ গঠনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে ১৯১৩ সালে তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। বৃটিশ সরকার তার জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহন করে ‘কোর্টস অব ওয়ার্ড’ গঠন করে এবং জমিদারীর আয় থেকে তাকে মাসোহারার ব্যবস্থা করে। বাংলা তথা বৃটিশ ভারতের মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ও তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে নবাব সলিমুল্লাহ হয়ে পড়েন নিঃস্ব।
তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মাথার মুকুট। গরীব মুসলমানের উন্নতির লক্ষ্যে অসংখ্যবার ঋণগ্রস্থ হয়েছিলেন তারপরও দমে যান নি। সাহসের সাথে স্বপ্ন নিয়ে কাজ করেছেন বিনা স্বার্থে। কারো কাছ থেকে পাওনা লাভের আশায় নয়। বরং পিছিয়ে পড়া একটা বিশাল সম্প্রদায়ের উন্নতি কল্পে। বর্ণ হিন্দুদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে।
প্রচলিত আছে যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জমি দান করেছেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি শ্রুতি বা মিথ। দান করার মতো জমি নবাব পরিবারের ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি খাসজমিতে।
ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের সূত্রে জানা যায়, নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৮ সালে আর্থিক সংকটে পড়লে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকার থেকে তৎকালীন ৩০ বছর মেয়াদে পরিশোধযোগ্য বার্ষিক শতকরা ৩ টাকা সুদে ১৪ লাখ রুপি ঋণ গ্রহণ করেন। সম্পাদিত বন্ধকি চুক্তি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ৫ লাখ রুপি মূল্যের হীরকখণ্ড দরিয়া-এ নূর এবং আরও রত্নাদি ঋণদাতার বরাবর বন্ধক থাকে।
সেই ১৪ লাখ রুপির সুদাসল অদ্যাবধি পরিশোধ করা হয়নি। ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানের একটি চিঠি উদ্ধৃত করে দৈনিকটিতে উল্লেখ করা হয়, দরিয়া-এ নূরসহ ১০৯ প্রকার রত্ন সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের ভল্টে এখনো রয়েছে। ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র অনুসারে আরও জানা যায়, ঋণের জামানত সম্পদগুলো ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন স্টেট ব্যাংকে জমা রাখা ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখন জমা রয়েছে সোনালী ব্যাংকে। তবে এগুলো যথাযথভাবে আছে কি না, তা নিয়েও এখন সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের পক্ষে থেকে অনেকবার এগুলোকে বের করার প্রচেষ্টা চালালেও চেষ্টা বিপলে যায়। এখন পর্যন্ত এগুলো আছে কি না, তাও বা কে জানে।