‘মিয়া’ অতি পরিচিত একটি বাংলা শব্দ, যা বাংলায় ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা ভাষার সাথে উর্দু ভাষার আত্মীয়তা সূত্রে। উর্দুতে ‘মিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় পুরুষ লিঙ্গার্থে কোনো সজ্জন ব্যক্তিকে সম্ভাষণ করার সময়, অর্থাৎ ‘মিয়া’র ব্যুৎপত্তিগত আনুষঙ্গিক ধারণাটি ভদ্রতা, সভ্যতা, সৌজন্য ইত্যাদি গুণাবলি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘মিয়া’ সম্ভাষণটি হিন্দুদের ‘বাবু’ সম্ভাষণের ইসলামীয় সংস্করণ বলে ধরা যেতে পারে। যেমন ‘রমেশ বাবু’ ও ‘গহর মিয়া’। মৌলানা বন্দে আলিও তার নামের শেষে লাগিয়েছিলেন ‘মিয়া’ নামক শব্দ। কিন্তু এটার বংশগত কারণ কি ছিল তা এতটা স্পষ্ট নয়।
কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম ১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনার শহরের রাধানগরের নারায়ণপুর মহল্লায় । কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনার গ্রামীণ ও নাগরিক পরিমণ্ডলে। পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন। দীর্ঘ চার বছর তিনি এখানে অধ্যয়ন করেন। সে সময়ে কোন মুসলমান শিক্ষার্থী এই চিত্রবিদ্যালয় অধ্যয়ন করত না, তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম শিক্ষার্থী। তাঁর পরে অবশ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এ একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে কবি কৃতিত্বের সঙ্গে আর্ট একাডেমির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং একই বছর কলকাতার আশুতোষ লাইব্রেরি কর্তৃক শিশুতোষ বই ‘চোরজামাই’ প্রকাশ করেন। পরে তিনি প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর অনুপ্রেরণায় করটিয়া সাদাত কলেজে ভর্তি হয়ে কিছু কাল এফএ পড়েন। তিনি সেখানে অধ্যয়ন বেশিদিন না করে আবার কলকাতা পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং বিদ্যাসাগর কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১৯৩৪ সালে টিচার্স সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
কলকাতায় থাকার সুবাদে সমকালীন পত্রপত্রিকার সাথে কবি বন্দে আলী মিয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর কিছুদিন পরই কবি ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক থাকাকালে তিনি ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও জড়িত ছিলেন। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতা জীবনে রবীন্দ্র-নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করেন। তখন তার অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানীতে তার রচিত পালাগান ও নাটিকা রের্কড করে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
কবির করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পেছনে আছে গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। ১৯২৯ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন থাকতেন কলকাতার বালিগঞ্জের মে-ফেরারি রোডে। বাড়িওয়ালা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি বন্দে আলী মিয়া অধ্যাপক মনসুরউদ্দীদের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি, সুরেনবাবু ও তাঁর বিদ্যুষী স্ত্রী প্রজ্ঞা দেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য কবিকে সেখানে নিয়ে যান। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় এমনকি স্বরচিত বইপত্রেরও আদান-প্রদান হয়। সে সময়ে কলকাতা করপোরেশন স্কুলসমূহের অধিকর্তা ছিলেন ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন এই দম্পতির জামাতা।
একদিন প্রজ্ঞা দেবী জামাতার কাছে কবি বন্দে আলী মিয়ার চাকরির জন্য সুপারিশ করেন। তিনি করপোরেশনের এক স্কুলে কবির চাকরির ব্যবস্থা করেন। প্রায় ১৬ বছর কবি করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রকৃতির মতই সহজ সরল। সাহিত্যের সব শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। সাহিত্য ভুবনে কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, সব্যসাচী লেখক। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কবিতায় পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় নৈপুন্যের পরিচয় প্রদান করেছেন। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৯ খানা কাব্য ১০ খানা উপন্যাস, ৩ খানা ছোট গল্প, ১১ খানা নাটক এবং সঙ্গীত ভিত্তিক ২ খানা রচনা রয়েছে। এ ছাড়া তার “জীবনের দিনগুলি’’ একটি বিশেষ রচনা।
কবি বন্দেআলী মিয়ার সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’। ময়নামতির চর কাব্য গ্রন্থে খুব সহজেই বাংলার শাশ্বত সৌন্দর্যকে ভাষার ব্যঞ্জনায় চিত্রায়িত করেছিলেন। যা কবিকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহঃ
১। ময়নামতির চর,
২।অরণ্য,
৩। গোধূলী,
৪। ঝড়ের সংকেত,
৫। নীড়ভ্রষ্ট,
৬। জীবনের দিনগুলো
৭। অনুরাগ ইত্যাদি।
শিশুতোষ রচনায়ও কবি বন্দে আলী মিয়া কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে কবি বন্দে আলী মিয়ারই বইয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, সাধনা ও অনলস চর্চার জন্য তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
কবির শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে বড় অবদান হলো ছোটদের উপযোগী জীবনীগ্রন্থ। মহত্ লোকদের জীবনী যে মানুসের চরিত্র ও মনুষ্যত্ব অর্জনে বড় অবলম্বন তা হয়তো বন্দে আলী মিয়া বিশেষভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাই তিনি ইতিহাস থেকে বিখ্যাত মনীষী, মহামানব, কবি-সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ প্রভৃতির জীবনতথ্য অবলম্বনে প্রচুর শিশুতোষ জীবনী লিখেছেন। তার মধ্যে ‘কোহিনূর’, ‘ছোটদের বিষাদ সিন্ধু’, ‘ছোটদের মীর কাসিম’, ‘তাহমহল’, ‘কারবালার কাহিনী’ প্রভৃতি গ্রন্থে শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরা হয়েছে। তিনি কোরান, হাদিস ও গুলিস্তাঁর গল্প লিখেছেন। আরো লিখেছেন ‘ইরান-তুরানের গল্প’, ‘ঈশপের গল্প’, ‘দেশ বিদেশের গল্প’, ‘শাহনামার গল্প’। তিনি লোককাহিনী, রোমাঞ্চকর ও রূপকথার কাহিনী অবলম্বনে গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বন্দে আলী মিয়ার লেখা ‘কোরাণের গল্প’ একটি ইসলামি শিক্ষা বিষয়ক অসাধারণ বই। বইটিতে বেশ কিছু ইসলামিক সত্য ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন লেখক। এ বইটি তিনি লিখেছেন তরুণদের মনোজগতে কোরআনের ঘটনাগুলোর বর্ণণার দ্বারা আঁচড় কাটার জন্য। তার মধ্যে আছে, আদি মানব ও আজাযিল,হাবিল ও কাবিল, স্বর্গ চ্যুতি, মহাপ্লাবন,আদজাতির ধ্বংশ, ছামুদ জাতির ধ্বংশ, বলদর্পী নমরুদ, হাজেরার নির্ব্বাসন,কোরবানি, কাবাগৃহের প্রতিষ্ঠা, ইউসুফ ও জুলেখা, শাদ্দানের বেহেস্ত, পাপাচারী জমজম,কৃপন কারুণ,ফেরাউন ও মুসা।
১৯৩২ সালে কবি বন্দে আলী মিয়ার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করে কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি। কবির এই ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসাপত্র পাঠান। কাব্যগ্রন্থটির প্রশংসা করে লিখেছেন :
“তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি তাতে করে, কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি। ২৬ জুলাই ১৯৩২।”( বন্দে আলী মিয়া রচনাবলি : বাংলা একাডেমি- ১ম খ-, ভূমিকা- আলাউদ্দিন আল আজাদ- পৃঃ ১৩)
ময়নামতীর চর’ পড়লেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরচেনা গ্রামের চিরন্তন চিত্র। যেমন তিনি লিখেছেন,
“বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর/গাঙ-শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।/গহিন নদীর দুই পার দিয়া আঁখি যায় যত দূরে/আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহার আঙিনা জুড়ে।/মাছরাঙ্গা পাখি একমনে চেয়ে কঞ্চিতে আছে বসি/ঝাড়িতেছে ডানা বন্য হংস-পালক যেতেছে খসি।’
তার কবিতার কথামালায় আছে চরজীবন নিসর্গ আর গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার বর্ণনার কারুকার্য। নদীপারের মানুষের জীবন, নদীর ভাঙাগড়া, সেখানকার মানুষের আশা-আকাঙ্খা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা সবই যেন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
তার কবিতায় রয়েছে, কাজের সন্ধানে দূরগাঁয়ে ছুটে যাওয়া দিনমজুরের কষ্টকথা, আপনজনের জন্য তার বিরহীমনের হাহাকার । বন্যায় আক্রান্ত শিকারি ফৈজুর বর্ণনা। যেমন :‘হাওরে পড়েছে ঢল/পানির শব্দে ফৈজু গাজীর মন হলো চঞ্চল।/ভোর হতে ফৈজু চলিল গাঁয়ের দক্ষিণ সীমানায়/পানি আসিয়াছে হাওর ভরিয়া-মাঠে মাঠে গ্রোত যায়।’
দীর্ঘ বিশ বছর শিক্ষকতা শেষে ১৯৫০ সালে তিনি এ পেশার ইতি টানেন এবং বাংলাদেশে ফিরে এসে সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অবশেষে পনের বছর পরে ১৯৬৫ সালে তিনি রাজশাহী বেতারে স্ক্রিপট এডিটর পদে যোগদান করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন।কবি যখন বেতারে কাজ করতেন, তখন ছোটদের জন্য একটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন তিনি। নাম ছিল ‘সবুজ মেলা’। বেতারে ছোটদের জন্য আরও একটা অনুষ্ঠান হত তখন– ‘ছেলে ঘুমাল’। সে অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই নিত্যনতুন গল্প লিখে দিতেন তিনি। আর এসব করতে করতেই তিনি গল্পদাদু’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
আমাদের গ্রাম’ নামক বিখ্যাত কবিতার লেখক:
বন্দে আলী মিয়া ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তার সাহিত্যক্ষেত্রের বিচরণই শুধু এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল না, বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল তার পেশাগত জীবনও। তিনি শিক্ষকতা করেছেন, বেতারে কাজ করেছেন এমনকি নাটকেও কাজ করেছেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে।
ছোটদের জন্য পাঁচটা-দশটা নয়, মোট বইয়ের সংখ্যা ১০৫। আর সে সময়ে ছোটদের জন্য লেখা তার ছড়া-কবিতাগুলো এখনও জনপ্রিয়।তার ‘কলমিলতা’ কবিতায় তিনি লিখেন: ‘বাতাস লাগিয়া দোলে নিরবধি কলমিলতা/পাতায় তাহার মাটির মনের গোপন কথা/বিহানের রোদে টলমল করে বিলের পানি/বুকে ভাসে তার রূপে ডগমগ কলমি রানী।’প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থগুলো আজও অমর হয়ে আছে।
বন্দে আলী মিয়া সারাজীবনে খুব একটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। সত্যি বলতে কি, তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে দারিদ্র্যে। তাতে কী, কবি কিন্তু কখনও সাহিত্যচর্চায় আপোষ করেননি। লিখে গেছেন অবিরাম। লিখেছেন বাংলার জীবন ও প্রকৃতির রূপ নিয়ে। আর লিখেছেন ছোটদের নিয়ে, ছোটদের জন্য, ছোটদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। কোকড়ানো ঝাকড়া চুল, উন্নত নাসিকা, টানা চোখ, ভরাট মুখমণ্ডল এবং স্নেহপ্রবণ হাসি মুখের অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া নিরিবিলি ও অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁকে উত্তেজিত, রাগারাগি, চেচামেচি করতে দেখা যেত না। আপন ভুবনে তিনি বিচরণ করতেন। লেখালেখি নিয়েই তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। লেখালেখির জন্য তাঁর কোনো বাঁধাধরা সময় ছিল না।
তিনি সময় সুযোগ পেলেই শিশুদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মেতে যেতেন। এটা ছিল তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। না হলে তাকে ‘গল্প দাদু’ বলাইতো মিছে। তিনি সুযোগ পেলেই ছড়াকারে কথা বলতেন বা কোনো কাগজ-কলম হাতের কাছে পেলেই লিখে পেলতেন একখানা ছড়া। যেমন লিখেছেন,
‘ঢুলু-ঢুলু আঁখি-এ রাতে কোথায় থাকি!
কি বা করি কি বা খাই;
কোথায় মেজবান-ধারে-কাছে কেহ নাই।’
তিরিশ-চলিশ দশকের কোনো এক সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসার ফলে তার মনে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে তিনি কণ্ঠশিল্পীদের বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করতে শুরু করেন। কাজী নজরুল ইসলামের নির্দেশে তিনি গীতি আলেখ্য “কারবালা” রচনা করেন। তার গানগুলো তৎকালের কয়েকটি কোম্পানি রেকর্ড করেন। দুইটি রেকর্ড চারখণ্ডে সমাপ্ত পরবর্তীতে করা হয়।
টুইন রেকর্ড এফ.টি- ৪৮৪১-৪২ এটি ১৯৩৭ সালে প্রকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে তা মুসলিম ফ্রেন্ডসে পরিবর্তিত হয়। ঠিক এর কিছু আগে প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহম্মদ কবি বন্দে আলী মিয়া দ্বারা রচিত ‘ওয়াজ মাহফিল’ টুইন রেকর্ডে বাণীবদ্ধ করেন। অপরটি টুইন রেকর্ড এফ.টি- ৪৭৭৯। এটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। জনপ্রিয়তা অর্জনের ফলে কবি শুধু টুইন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত না থেকে আরো
অসংখ্য রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন।
কবি নাটিকাই শুধু রচনাই করতেন না; তাতে তিনি অভিনয় এবং নিজে পরিচালনাও করতেন। শিল্পী ও সুরকার আব্দুল হালিম চৌধুরী বন্দে আলী মিয়ার বেশ কয়েকটি গান হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে কণ্ঠ দেন।
তাঁর লেখা ও গাওয়া কয়েকটি গান হলো- জিন্দেগী তোর আখের হইল (এইচ-৮৯৯) ও ইয়া এলাহী কবুল কর (এইচ-৮৯৯) অপরদিকে, আরও ইসলামী গানসহ বিভিন্ন ধরনের গান সম্পর্কে জানা যায়, যেমন- ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ-খোদা তালার প্রিয়জন, আবদুল কাদের জিলানী-বুজর্গ পীর, লা’শারিকালা নামে নাওখানি বাইয়া, জেয়ারতের রওযা ভূমে, রোজা নামাজ, মরু মদিনায়, এসো পথিক, পিয়াল পাতার, এতো জ্বালা জানি যদি, চেয়েছিনু মালাখানি, ভালবেসে, দখিনা বাতাস বধু, দল বেঁধে চলে মেঘ, শতেক তারার মাঝে, আমার ভূবনে মধু পূর্ণিমা আলো, পিয়াল বনের পাখি, তোমার পথের ধারে, তোমার কামনার রূপধরে ইত্যাদি।
তার প্রকাশিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, জীবনী গ্রন্থ গান একশতের উপরে বইয়ের সংখ্যা, ছবিও এঁকেছেন অনেক। অথচ তাঁকে নিয়ে কেউ একটি বইও লিখেননি, এমন কি তাঁর সাহিত্য কর্মের ওপর কেউ জীবিতকালে একটি প্রবন্ধও লিখেননি। উভয় বাংলায় খ্যাতিমান কবি হওয়া এবং বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্ম থাকা সত্ত্বেও তিনি সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পুরস্কার বা সংবর্ধনাও পাননি। এর একমাত্র কারণ তিনি কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠির মতবাদের ধারে কাছে যাননি, কোনো দলের মতবাদের প্রচার করেননি। আজকাল আমাদের সমাজের অনেক নবীন ও প্রবীণ লেখকরা বিশেষ কোনো দলের একটু করুণা লাভের জন্যে, একটা রুটি ও একটু হালুয়ার লোভে একবার ডানে আরেকবার বামে কাত হচ্ছেন। নিজেরাই নিজেদের ঢোল বাজাচ্ছেন। কতটুকুই মূল্যবান এমন তাঁদের সাহিত্য কর্ম!
কবি বন্দে আলী মিয়া বলেছেন:
“আমার সাহিত্য কর্মের যদি সত্যিকার মূল্য না থাকে তবে তোমরা যদি তা সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দাও তবু তার মূল্য হবে না। আর যদি আমার সাহিত্যের মূল্য থাকে তবে তোমরা হাজারবার উপেক্ষা-অবহেলা করলেও একদিন তার মূল্য হবে। কারণ সত্যিকার মূল্যায়ন যাচাই করবে মহাকাল।”
এই মহান সব্যসাচী কবি ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে পাবনার রাধানগরের ‘কবিকুঞ্জ’তে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
পছন্দের আরো লেখা