বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসে এসেছে ইউসুফ।চারপাশে নতুনত্বের ছোঁয়া।একেবারেই ভিন্ন পরিবেশে এসে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে সে।ফার্স্ট সেমিষ্টারের ক্লাস কোথায় হবে সেটা জেনে নিয়ে দুরু দুরু বুকে ধীর গতিতে সেই রুমের দিকে আগাচ্ছে ইউসুফ।রুম নাম্বার ৪০৪১। দরজায় দাড়িয়ে বেশ পরিষ্কার কন্ঠস্বরে সবার উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে সালাম দিলো সে “আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”।একে অপরের সাথে কথোপকথনে ব্যাস্ত একঝাঁক তরুণ-তরুণী মাথা তুলে তার দিকে তাকালো।পুরো ক্লাস জুড়ে হঠাৎ শুনশান নীরবতা।কেউ বা নীচুস্বরে সালামের জবাব দিলো,কেউ বা মুখ টিপে হাসছে।সামনের সারিতে বসা সুদর্শন এক ছেলে তার পাশের সহপাঠীকে মৃদুস্বরে বললো
“ক্লাসে একটা ক্ষ্যাতের প্রবেশ হয়েছে।বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই।এরকম কাঠ মৌলভী পূর্বেও অনেক দেখেছি”।
মন্তব্যটা শুনে থমকে দাড়ালো ইউসুফ।ব্যাগ থেকে মার্কার পেনটা বের করলো সে।বেশ গোটা গোটা অক্ষরে হোয়াইট বোর্ডে লিখলো
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীদের সালাম না করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।” (সুরা-২৪ নূর, আয়াত: ২৭)।
বেশ হাসিমাখা মুখে ইউসুফ ক্লাসের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “আজ থেকে এটা আমাদের পরিবার। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের মঙ্গলের উদ্দ্যেশ্যে আরবি ভাষায় সালাম দিয়েছি।যার অর্থ হলো আপনার বা আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।আমরা কি আমাদের এই পরিবারের সদস্যদের জন্যে শান্তি চাইতে পারি না?” গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী বাদে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো “ওয়ালাইকুমআসসালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”। ইউসুফের মনে একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করলো যেনো!
সামনের সারির সেই প্রথম ছেলেটা এবার বিব্রত বোধ করলো। তার অস্বস্তি দেখে ইউসুফ তার কাঁধে হাত রেখে বললো “পৃথিবীটাকে জয় করে নিতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। আপনি একটা মানুষকে যত বেশি ভালোবেসে আপন করে নেবেন সে মানুষটা আপনাকে ঠিক তেমন করেই শ্রদ্ধা করবে।তবে হ্যাঁ তাকেই ভালোবাসা দেবেন যিনি ভালোবাসা পাবার যোগ্য।”ইউসুফ হাত বাড়িয়ে ঐ সহপাঠীর সাথে হ্যান্ডশেক করলো।
এভাবে ভার্সিটি তে যাওয়ার পথে,ভার্সিটি থাকা অবস্থায় কিংবা ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রতিনিয়ত প্রায় সবাইকে সালাম দেয় ইউসুফ। একদিন এক বৃদ্ধ অসহায় ভিক্ষুক তার কাছে ভিক্ষা চাইলো। বৃদ্ধ অসহায় মানুষটাকে সালাম দিলো সে। অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলেন বৃদ্ধ।পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বৃদ্ধের হাতে দিলো সে।তার এহেন আচরণে কেঁদে দিলেন বৃদ্ধ।চোখ মুছতে মুছতেই বললো “বাবা ঠিকমত দুটো পয়সাও কেউ দিতে চায় না।হিসেব বিহীন কতো বেলা না খেয়ে থাকতে হয়।আর আপনি বাবা আমার মত গরীব মানুষরে সালাম দিলেন,সম্মান করলেন।উপরে এক আল্লাহ আপনারে নেক হায়াত দান করুন। আপনার সম্মান যেনো আপনার উত্তম আচরণের মতই দিন দিন বৃদ্ধি পায়।”
সেই ভার্সিটি যাবার পথে প্রথমদিন রিকশাচালক ভাইটাকে সালাম দিয়েছিলো ইউসুফ।আজ পঞ্চম দিনেও একই জায়গায় দাড়িয়ে ইউসুফের জন্যে অপেক্ষা করছেন সেই রিকশাচালক আনিস ভাই।সালাম দিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো আনিস ভাই আপনি প্রতিদিনই আমার জন্যে দাড়ায়ে থাকেন কেনো? আপনার সময়গুলো নষ্ট হয় না?
মৃদু হেসে গামছা দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছতে মুছতে আনিস বললেন “ভাইজান এই শহরে আপনি মহামানব হয়তো না।কিন্তু আপনের সুন্দর একটা হৃদয় আছে।মানুষের মন ভালো করার মতন।সকালবেলা আপনের মত একজন মানুষরে আমার রিকশায় উডাইলে নিজের দিলে শান্তি লাগে ভাইজান।রিজিকের মালিক তো ঐ আল্লাহ।তিনিই মিলায়ে দেবেন রুটি-রুজি।পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহর দরবারে গিয়া সেজদা দেবার চেষ্টা করি ভাই।আমাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু সবসময় পাই না।সেইটা অন্তত একটু হইলেও আপনি দিছেন।আপনার সাথে দুটো কথা বললেও ভালা লাগে ভাইজান।আমি প্রতিদিন আপনের জন্যে অপেক্ষা করুম।যেই দিন আপনে আসবেন না সেইদিন আমারে একটা ফোন দিবেন।সেদিন অপেক্ষা করুম না”
ফোন নাম্বারটা নিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকে যাবার সময় সালাম দিয়ে নিজ গন্তব্যে হাটতে হাটতে ইউসুফ ভাবছে স্রষ্টা প্রদত্ত একটা কুশল বিনিময়ী বাক্য তার জীবনটাই যেনো বদলে দিচ্ছে।স্রষ্টা কতই না মহান।
বাসায় ইউসুফ দেখে তারর বড় বোন এসেছে।সাথে তার দশ বছর বয়সী ছেলে নাজির।সালাম দেবার পর বোনের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ভাগ্নে নাজিরকে দেখে সালাম দিলো সে।নাজির চুপ করে আছে।সালামের জবাব এখনো দেয় নি।নাজিরের আদুরে গালদুটো আলতো টেনে ধরে আদর করতে করতে ইউসুফ ভাগিনাকে বললো “মামা,আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’লা কি বলেছেন জানো?”
তিনি বলেছেন
‘আর যখন তোমাদের সালাম দেওয়া হবে, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে অথবা জবাবে তাই দেবে।” (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৮৬)।
তুমি না প্রতিদিন কোরআন পড়ো।তবে সালামের জবাব দাওনি কেনো বলতো?দেখি সুন্দর করে বলো “ওয়ালাইকুমআসসালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”। শান্তশিষ্ট মামা ভক্ত ভাগিনা খুব সুন্দরভাবেই মামার অনুকরণ করলো।
এলাকার সবাই ইউসুফকে সম্মান করে,স্নেহ করে। তার বাবা-মা এবং পরিবারের সুনাম করে।এলাকায় তার সুন্দর একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে।ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিয়ে প্রায় সবার নিয়মিত খোঁজ-খবর সে নেয়।এলাকার শিশুরাও তাকে অনুকরণ করে।শিশুদের সাথে তার একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে,কে কার আগে সালাম দিতে পারে।ইউসুফের বিশ্বাস একদিন সে অবশ্যই এই শিশুদেরকে নিয়ে আগামীর সুন্দর একটা সমাজ গড়ে তুলতে পারবে।তারা হবে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত।স্রষ্টা যেনো তাকে সেই শক্তিটুকু দান করেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে এই দোয়াই সে সবমসময় কামনা করে।