বেশ খিটখিটে মেজাজেই বাসায় ফিরছে তৈমুর।একটু পরেই তার জীবনের অধ্যায়টা বদলাতে চলেছে।নিঃশ্বেস হতে চলেছে স্ত্রী ঝুমুরের সাথে অতিবাহিত করা পূর্বেকার দুঃখে জর্জরিত কিংবা মধুর স্মৃতিমাখা সময়গুলো। সমস্যা শুধু একটা জায়গাতেই।একমাত্র মেয়েটা কার কাছে থাকবে এ নিয়ে দ্বন্দ্বের কোনো অবসান হচ্ছে না।তৈমুর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। প্রয়োজন হলে লম্বা সময় আইনের লেজ ধরে ঝুলে থাকবে তবুও মেয়ের অধিকার সে ছাড়বে না।
সেই সময় শুভ্র একগুঁচ্ছ গোলাপ হাতে ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে তার হাতের আঙ্গুল টেনে ধরলো।খিটখিটে মেজাজ থাকায় এক ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো তৈমুর।ফুল নেয়ার মত কোনো অর্থবহ সম্পর্ক তার এই মুহূর্তে নেই।সামনে হেটে চললো সে।ছোট্ট মেয়েটি রাস্তার উপর ছিটকে পড়েছে তার সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ করেই কেনো জানি নিজের মেয়ে জাবিনের মুখটা ভেসে ওঠলো।তার মেয়েটার নিয়তি ও এমনটা হতে পারতো।ঘুরে দাড়ালো তৈমুর।এগিয়ে এসে ছিটকে যাওয়া ফুলগুলো কুঁড়িয়ে নিলো সে।মেয়েটার কনুইটা ছিলে গেছে।রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সে জায়গাটা থেকে।মামনি আমাকে মাফ করে দাও।অনেক কষ্টে আছি বলে বেখেয়ালি মনে তোমাকেও কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
তৈমুর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে হাটতে লাগলো।ব্যান্ডেজ লাগানো শেষে পকেট থেকে এক হাজার টাকার দুটো নোট মেয়েটার হাতে দিয়ে বললো তুমি বাসায় যাও মামনি।আমার খুব তাড়া আছে বলে তোমাকে পৌঁছে দিতে পারলাম না।যাবার পথে আবারও হাতের আঙ্গুলটা টেনে ধরে ছোট্ট মেয়েটা বললো “আংকেল এই ফুলগুলো আপনার জন্যে।আপনার সাথে ভালো কিছু হোক”।তৈমুর ফুলগুলো হাতে নিলো।ছোট্ট মেয়েটার মমতা জড়ানো ফুলগুলো তৈমুর কেনো জানি ফেলে দিতে পারেনি।
বাসায় ঢুকেই ফুলগুলো টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে ঢুকলো সে।জাবিনের দৃষ্টি ফুলগুলোর দিকে নিবদ্ধ। মা এখনো স্বর্ণালংকার আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে চলেছে।হুট করেই জাবিন একটা কাজ করে বসলো।ড্রয়ারে রাখা সেই চিঠিটা বের করলো যেটা একদিন বাবার ডায়েরিতে কুঁড়িয়ে পেয়েছিলো।চিঠি সমেত ফুলগুলো নিয়ে মায়ের কাছে গেলো জাবিন।ঝুমুর তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।চোখে কৌতুহলী দৃষ্টি।জাবিন বললো “মা, এই চিঠিটা আর ফুলগুলো শেষবারের মতন বাবার পক্ষ থেকে তোমার জন্যে”। চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো ঝুমুর…
প্রিয় ঝুমুর,
কেনো জানি তোমার সাথে মানিয়ে ওঠতে পারছি না।সংসারের বারো বছর পর এসে সবকিছু কেনো জানি গুলিয়ে ফেলছি।তোমার আর আমার ভুলগুলো মিশ্রিত হয়ে বিরাট একটা দূরত্বের দেয়াল তৈরি হচ্ছে।কিন্তু আমি কখনোই ভুলগুলো শুধরে দেয়ার চেষ্টা করি না।বরং তোমার সাথে তর্কে জড়াই।সংসারে দুজনেরই অবদান আছে এটা আমাদের দুজনের কেউই স্বীকার করে নেই না।অথচ বাবা-মা কে আমি বলেছি তোমাকে যতেষ্ট খুশি রাখবো আর তোমার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করবো।তোমার সাথে যতই সমস্যা থাকুক তোমার-আমার বিচ্ছেদের চিন্তা আমার হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে তীব্র এক যন্ত্রনার সৃষ্টি করে।আমি তোমাকে হারাতে চাই না বরং সমস্যাগুলো সমাধান করে তোমার সাথে মানিয়ে নিতে চাই।সুখ আর দুঃখগুলো ভাগ করে নিতে চাই।কিন্তু প্রচন্ড ইগো আমাকে বাঁধা দেয়।আমি কি আসলে কখনো তোমাকে বলতে পারবো যে আমি তোমাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসি।
ইতি
তৈমুর
ঝুমুর পাগলের মত দৌড়ে গেলো স্বামীর কাছে।কাঁধে টাওয়েল জড়িয়ে মুখ মুছছিলো তৈমুর।তাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে ঝুমুর বললো আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই নি।আমার ইগো আমাকে বাধ্য করছিলো নোংরা কাজটা করতে।তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।
অদূরে দাড়িয়ে থাকা জাবিন ডিভোর্স পেপারটা একটানে ছিঁড়ে দুভাগ করে ফেললো।স্ত্রীর মাথায় আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিলো তৈমুর।আহ, মানবীয় সম্পর্কগুলো কতই না অদ্ভুত!ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়।কেউ বা মুহূর্তেই পায় আবার কেউ বা মুহুর্তেই হারায়।