‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা মানুষ কেনো আত্মহত্যা করছে সেটা আমরা অনুভব করতে পারি না।প্রতিটা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রটা এক নয়।আত্মহননে সংকল্পবদ্ধ একজন মানুষকে খুব সহজে আয়ত্ত্বে আনা যায় না,কোনো কিছু বোঝানো যায় না। আত্মহত্যার কারণ নির্ণয় করাটাও বেশ কঠিন ব্যাপার। মানুষের ভেতরের কষ্টগুলো যখন খুব গভীরভাবে হৃদয়ে আঘাত করতে থাকে তখন বাহ্যিক কোনো বিষয়ের ওপর তার মায়া কাজ করে না।হোক সেটা পরিবার কিংবা অন্য কোনো বিষয়।কেউ সম্পর্কের কষ্ট থেকে, কেউ বা জীবনের ওপর হতাশ হয়ে,কেউ বা সমাজের সম্মানহানিকর কোনো ব্যাপার থেকে বাঁচার জন্যে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে।কিংবা এমনও কারণ থাকতে পারে যা অন্য কেউ সাধারণত জানতে পায় না।
এক্ষেত্রে আমাদের উক্ত বিষয়টাকে খুবই সেন্সিটিভ দৃষ্টিতে দেখতে হবে।আত্মহত্যা প্রবণ একজন মানুষের কাছে জাগতিক সব বিষয় তুচ্ছ মনে হয়।তবে আমাদের করনীয় কি হতে পারে?
সর্বপ্রথম ঐ মানুষটার ইমোশন বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আপনার প্রথম চেষ্টা হওয়া উচিৎ তার ইমোশনের সাথে এটাচ হয়ে যাওয়া। যেকোনো ভাবে মানুষটাকে বোঝাতে হবে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের দায় অবশ্যই তার নয়। তাকে নৈতিকতার দেয়ালে আবদ্ধ করবার চেষ্টা করুন।তাকে আল কোরআন কিংবা হাদিস শরীফের বাণী পৌঁছে দিন।বোঝাবার চেষ্টা করুন আত্মহত্যার পর মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তার কোনো আর্জি স্রষ্টার দরবারে গৃহীত হবে না বরং তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে,হয়তো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।কেননা স্বয়ং আল্লাহ তা’লা আত্মহনন এবং আত্মহত্যাকারীকে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন।আত্মহত্যা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে,
“তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না।”(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫)।
আল্লাহর প্রিয় রাসূল মুস্তাফা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্মহত্যার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।আত্মহত্যার প্রতিফল সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের এক ব্যক্তি আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। সে একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এরপর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। এ ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।” (বুখারি ও মুসলিম)।
সব ধর্মেই আত্মহত্যা সম্পর্কে কঠোর নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছে।সহজ কথায় সব ধর্মেই বলা হয়ে থাকে “আত্মহত্যা মহাপাপ”।আপনাকে যদি হতাশা আবদ্ধ করে রাখে এবং প্রতিদিন আপনার মানসিক কোনো কষ্ট থেকে যদি প্রতিনিয়ত অশ্রু ঝরিয়ে থাকেন তবে তাতে আপনার কোনো ফায়দা নেই।বরং আপনি প্রচন্ড মনোকষ্ট নিয়ে রাত্রি দ্বিপ্রহরে অথাৎ শেষরাতে ওযু করে নিন।তারপর জায়নামাজটা ফ্লোরে বিছিয়ে অল্প আলো জ্বালিয়ে নামাজে দাড়িয়ে যান এবং সিজদায় কন্টিনিউয়াসলি কাঁদতে থাকুন।আপনি স্রষ্টার সাথে আপনার কষ্টগুলো শেয়ার করতে থাকুন।কেননা আল্লাহ ঘোষনা দিয়েছেন,
“তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।”(সুরা : সাজদা, আয়াত : ১৬)
সুতরাং আপনার যত মনোকষ্ট,আপনার জীবন নিয়ে যত হতাশা সবকিছু নিয়েই স্রষ্টার দরবারে হাজিরা দিন।আপনি কখনোই নিজের পাপ কিংবা চাওয়া-পাওয়া নিয়ে হতাশ হবেন না।বরং নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এর সাথে সাথে মধ্যরাতে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে বারবার স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাইতে থাকুন।তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাকারী যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।আপনার মানবীয় অপূর্ণতাগুলো তিনিই পূর্ণ করে দেবেন।আপনি যদি আপনার অপূর্ণতাগুলো স্রষ্টার কাছে শেয়ার না করেন তবে কীভাবে আপনি পূর্ণতা পাবেন?আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্রষ্টার দুয়ারে মাথা অবনত করার জন্যে।আপনি যত বেশি মাথা অবনত করবেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবেন স্রষ্টার স্বত্তা ঠিক ততটাই বিগলিত হবে।
মহান রব আরো বলেন,
“তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৭)
হাদিস শরীফে এসেছে,
“আল্লাহ তা’লা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব…!”(বুখারি ও মুসলিম)
আপনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া মনেই স্রষ্টার সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করা।কেনোনা আল্লাহ তা’লা আপনার মৃত্যুর সময়টা নির্ধারিত করে রেখেছেন।সেই সময়টা যদি আপনি স্বইচ্ছায় নির্ধারিত করতে চান তবে আপনার মনে প্রশ্ন আসা উচিত নয় কি?যে আপনি সরাসরি সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাড়িয়ে কেবল নিজের সিদ্ধান্তটুকুই বাস্তবায়ন করলেন।তাতে নিশ্চই তিনি চরম অসন্তুষ্ট হবেন।
আর আপনি আত্মহত্যা করা মানে আপনার চিরশত্রু শয়তানকে জিতিয়ে দেয়া।কেনো না আপনার সাথে যা ই ঘটুকনা কেনো শয়তান সেটার এডভানটেজ নিয়ে সহজেই তার কুপ্রবৃত্তিগুলো আপনার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে।আর আপনি সহজেই হার মেনে নিলেন!নিজের সাথে এবং শয়তানের সাথেও।হাল ছেড়ে দেয়া উচিৎ নয়।আপনার গড় বয়স ৭০-৭৫ কিংবা বড়জোড় ৮০।সাময়িক কিছু অসুবিধা কিংবা হতাশার জন্যে আপনি হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে এত অল্প সময়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার কোনো প্রয়োজন নেই।বরং নিজের সাথে করে কিছু আমল নিয়ে যান যাতে কাল হাশরের ময়দানে স্রষ্টার দরবারে আবদার করে বলতে পারেন,
“হে মালিক আমি কষ্ট পেয়েছি,পাপও অহরহ করেছি কিন্তু তোমার দরবারে সেজদা দেয়া থেকে কখনো বিরত হইনি।আমি তোমার কাছে উপযুক্ত প্রতিদান চাই।”
ভালো থাকুক পৃথিবীর সর্বপ্রান্তের প্রতিটা মানুষ।