||১||
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট। হিজরী হিসেবে পবিত্র রমজান তখন চলমান। এই মাসের ২৭ তারিখ পবিত্র রজনীতে নতুন করে লেখা হলো মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। ১৩ ই অাগষ্ট বৃটিশ ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন করাচী যান এবং ১৪ অাগস্টের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানের গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে পাকিস্তানের গভর্নর কায়েদে অাজম মুহাম্মদ অালী জিন্নাহর নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণের পর জিন্নাহ জাতির উদ্দেশ্য ইংরেজীতে ভাষণ দেন রাত ১২টায়।…এই ভাষণ শুনার জন্য তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে ছুটে আসে। PBS (পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্বিস) থেকে সরাসরি ভাষণটি শুনানো হয়েছিল।
১৪ ই অাগস্টের আলো-আঁধারির মধ্যে হয়তোবা কেউ ঘুম থেকে উঠে দু রাকাত সলাত পড়ে অাল্লাহর দরবারে শুকরিয়া অাদায় করেছিল। ১৯০ বছরের যে কালো মেঘ মুসলমানদের জীবনকে গ্রাস করে ধ্বংসের অতল গহ্বরে এনে দাঁড় করিয়ে ছিল, আল্লাহ সেই অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিয়েছেন। যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিংস্রতার জাতাঁকল উপমহাদেশের মুসলমানদের কুরে কুরে শেষ করে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল। একইসাথে তার থেকেও মিললো মুক্তি। এজন্যই এটি ছিলো এক নতুন যুগ ও সময়ের অভিযাত্রা।
যদিও জিন্নাহর ইন্তেকালের কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মের উপর ভিত্তি করে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রটি অচিরেই তার লক্ষ্য থেকে বিপথে যাওয়া শুরু করে। যে চিন্তার উপর ভিত্তি করে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনরা লড়াই করে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল কিছু দিন না যেতে তাদেরকেই আবার পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে দেশ বিরোধী অভিযোগ শুনতে হয়েছিল। কিন্তু, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অবস্থা তখন কেমন ছিল ?
কলোনিয়াল পিরিয়ডের শেষ দিকে এসে এসে কিছু মুসলমানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ফিরে আসলেও তার উন্নয়ন চিন্তা প্রভাব ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক। কারণ, তারা সবাই ছিলেন অবাঙালী পশ্চিমের লোক। তাই স্বাধীন পাকিস্তানের সুউচ্চ ইমারত পূর্বে না হয়ে পশ্চিমে দেখা গিয়েছিল। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশে এমন কোন শিল্পপতি বা শিল্পের কোন খাতই তখন গড়ে ওঠে নি। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান তার শিশু অবস্থা থেকে কিভাবে যাত্রা শুরু করেছিল তার গল্পটাই কিছুটা আপনাদের শুনাবো।
||২||
দেশ ভাগের পর সারা শহর (ঢাকা) জুড়ে চলছিল খুশির অামেজ। নজরুল, ফররুখ, তালিম কিংবা নাজির আহমদের লেখা গানের মনমাতানো সুরের রংচটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেটি অতীতের দিনগুলিতে খুজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। দুই শতক ব্যাপী ইংরেজ ও তাদের লুটেরা সহযোগীদের কাছ থেকে মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতকতা আর ভাই হত্যার করুণ দৃশ্য দেখা ব্যতীত কিছুই পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি । ৮০০ বছর পাশাপাশি বসবাস করার পরও মুসলমানরা ইংরেজ অাশ্রিত হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে এভূমির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। কারন দীর্ঘকাল পূর্বে আসা ব্রাহ্মণরাই এই ভূমির একমাত্র রক্ষক বলে নিজেদের দাবী করতো। যদিও হিন্দুস্তানে তারা নিজেরাও ছিলো পরবাসী।
এখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুষের উপর জাতিভেদ প্রথা নামক দাসত্বের শৃংখল লাগিয়ে তারা বসেছিলেন প্রভুর আসনে। মুসলমানরা যখন সাম্যের বাণী নিয়ে ভারতে হাজির হয়। এইসব ব্রাহ্মণদের নিজ স্বার্থ- সিদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টি হওয়ায় তারা একযোগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথমত নিরব ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠেছিল। আর যার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল কংসোর রাজ আসন গ্রহণের মাধ্যমে। যেটি (ষড়যন্ত্র) ভারত বিভাগের অাগের দিন পর্যন্ত ও বিরাজমান ছিলো। সেজন্যই ১৪ আগষ্টের দিনটি মুসলমানদের কাছে ছিলো ঈদ উৎসবের চাইতেও অানন্দের বরং তুলনা করা চলে হাদিসে অাসা সেই ব্যক্তির ন্যয়, যে জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে নিজ মালামাল বোঝাইকৃত উটকে হারিয়ে অবসন্ন হৃদয়ে শুকনো মুখে রিমজিম হয়ে বুক ভরা অাশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, হঠাৎ জেগে উঠে উটটিকে নিজের পাশে দেখতে পেয়ে সে যতটুকু খুশি হয়, ঠিক ১৪ই অাগষ্ট দিনটি পুর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য এমনই ছিলো।
উট হারানো লোকটি উটকে পেয়ে যেমন খুশি হয়েছিল মুসলমানরা কিন্তু তাদের সেই হারানো সম্পদ ফিরে পেয়ে খুশি হলেও আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে নি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ব্যতীত বাকি সবগুলো প্রদেশই ছিলো মোটামুটি উন্নত। অপরদিকে দু’ শ বছর কলকাতা কেন্দ্রীক টাওয়ার বাংলার শোষণ ও লুন্ঠন ক্ষেত্ররুপে ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলা একেবারেই পিছিয়ে পড়েছিলো। পুর্ব পাকিস্তান প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত ঢাকার অবস্থা ছিলো তখনো পুরো ভংঙ্গুর প্রায়।
||৩||
১৯৪৭ পযন্ত ঢাকা ছিলো বৃহৎ একটি জেলাশহর মাত্র। সেই জেলা শহরকে রাতারাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত করা মোটে ও চাট্রিখানি কথা ছিলোনা। যদি প্রশ্ন করি,পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা কি সেদিন না পাওয়ার বেদনায়, শোষণের যন্ত্রণায় হাত পা গুটিয়ে বসে পড়েছিল ?
যদি তাই মনে হয় তাহলে অামাদের করা অনুমান সম্ভবত ভুল। কারণ, তাদের (মুসলমানদের) পূর্বসুরিরা যে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য ইংরেজ ও লুটেরা সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো। সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন ভোরে শূন্য হাতে তারা দেশকে নবনির্মাণের পথযাত্রায় নেমে পড়েছিলেন। আসুন তার কিছু চিত্র দেখে আসি।
দুই বাংলা বিভাগের পর দেখা গেলো যে, প্রশাসন বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবই গড়ে উঠেছে কলকাতায়। অফিস-আদালত কিংবা পার্লামেন্ট বসানোর জন্য কোন ভবন নাই। টেবিল-অাসবাব পত্র নাই। দু টুকরো কাগজ একসাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য আলপিন পর্যন্ত নেই। তবু্ও,কোন কিছুই থামিয়ে দিতে পারেনি পূর্ব বাংলার নবজাগরণের প্রেরণা। পিন -অালপিনের বদলে বাবলা কাঁটা আর মেহেদী কাটা সম্বল করে, টেবিল-চেয়ারের পরিবর্তে মাদুর বিছিয়ে শুরু হয় অফিস আদালতের কাজ। সদ্য সমাপ্ত হওয়া মেয়েদের ইডেন কলেজ বিল্ডিংকে করা হয় সচিবালয়। যদিও ইডেন বিল্ডিংকে সরকারি ভবন না বানিয়ে মেডিকেল কলেজ বানানোর কথা তৎপূর্বে একবার উঠেছিল। কিন্তু কোন উপায় না থাকায় পূর্ব মতেই স্থির থাকতে হয়। প্রথম দিকে ইডেন বিল্ডিং চত্বরে একটাই ছোটো বিল্ডিং ছিলো। সেক্রেটারীয়েটের জন্য বাকি সব অফিস করা হয়েছিল পলাশি বা নীলক্ষেতে ব্যারাকের মতই মুলি বাঁশের দো’ চালা ঘরে। ঘরের চালই যে শুধু মুলি বাঁশের ছিলো তা নয় বেড়াও ছিল মুলি বাঁশের শুধু নিচের মেঝে ছিল পাকা। পর্যাপ্ত পরিমান চেয়ার -টেবিল না থাকায় বহু সংখক কর্মকর্তা- কর্মচারি মেঝেতে পাটি বিছিয়ে প্রথমদিকের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন ।
পুর্ব পাকিস্তান অাইন সভার (লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলি) নয়াবাড়ি তখনো তৈরি না হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সাময়িকভাবে আইনসভার অধিবেশন চলে। ঢাকা কলেজে হলো হাইকোর্ট। রেডিও স্টেশনটি নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো বাড়ীতেই থেকে গেল (এখন যেখানে শেখ বুরহান উদ্দিন কলেজ অবস্থিত)। অনেক জোড়াতালি দিয়েও যখন ঢাকায় সরকারের সবগুলো দপ্তরের জায়গা হলোনা তখন কিছু দপ্তর পাঠানো হয় চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের ভাগ্যে ও পড়ে ছিল কয়েকটা দপ্তর। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, এ সকল অফিস -আদালতে কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার মত তখন নূন্যতম যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তা খুজে পাওয়া যায়নি।
দেখা যায় পাকিস্তানে বহু কৃষিজীবী অাছে। কিন্তু, শিক্ষিত পেশাজীবী নেই। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে কার্যরত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিলো প্রায় এগার শ’ । এতে মুসলমানের সংখ্যা ছিলো ১০% (৮০-৯০জন)। এসব কর্মকর্তার মাঝে মাত্র ১০ জন ভারত সরকারের সেক্রেটারিয়েটে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিন জন যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করতেন। অারো দুঃখজনক কথা হচ্ছে, এদের মাঝে ৩জন ছিলেন জন্মসূত্রে বাঙ্গালী আর একতৃতীয়াংশই জন্মসূত্রে পাঞ্জাবী। তৎকালীন বাঙালী মুসলমানের মাঝে পাশ করা কোন অাইসিএস অফিসার ও ছিলোনা। কিছু অবাঙ্গালী মুসলিম অফিসার এদেশে এসে বিনা স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে তোলেন। পুলিশ সার্ভিস ও রেলওয়ে সার্ভিস গড়ে তোলার পিছনে তাদের অবদান ছিলো সমধিক। উচ্চপদে মুসলমান কর্মকর্তাদের ঘাটতি পুরন করতে তখন ভারত ত্যাগ করতে যাওয়া ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অাহ্বান করা হয়। তাদের মাঝে অর্ধেক সংখ্যক অফিসার (১৩৫জন) চুক্তির ভিত্তিতে পাকিস্তান চাকুরিতে যোগদান করেন।
এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় তখন বাসস্থান সংকট তীব্র অাকার ধারন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বহু মুসলমান কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে অাসায় অনেকের কোথাও একটু মাথা গুঁজিবার জায়গা ছিলোনা। কেউ কেউ অাত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে গিয়ে ফরাস বা ঢালা বিছানা করে শুয়ে থাকতো। মেয়েরা একঘরে, পুরুষদের অন্য ঘরে শুতে হতো।
এ সময়ই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে চলছিলো ইতিহাসের বীভৎসতম মুসলিম নিধন। সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের হাতে যে কত মুসলমান নর-নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল তার কোন সীমা নাই। হিন্দুদের ভয়ে তখন হাজার হাজার অসহায় মুহাজির নিঃস্ব হয়ে ভারত থেকে এসে ঢাকা শহর ছেয়ে যায়। তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ঢাকার প্রত্যেকটা স্কুলকে রিকুইজিশন করা হয়। বিভিন্ন পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে ও তাদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়। এসব মুহাজিরদের বিরাট অংশই ছিল উর্দুবাসী। তখন কিন্তু ভাষাটা অামাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি।কেননা পাকিস্তান হয়েছিল মুসলিম জাতিসত্তার উপর ভিত্তি করে। তাই, আমরা তাদের আপন করে নিতে পেরেছিলাম। এই সকল মুহাজিররা প্রতিদিন সকালে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের শীর্ষে থাকা বিরাট পাকিস্তানি পতাকাকে দীর্ঘক্ষন ধরে সালাম করতো। বলতে দ্ধিধা নেই সেদিন পাকিস্তানকে ভালোবেসেই তারা এখানে তাদের নতুন অাশ্রয় নির্মান করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নাম দিয়ে একটা সময় মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নির্বাসনে পাঠানোর পাশাপাশি এদেরকে ও তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশকে করা হয় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা।
অপরদিকে ১৯০৫-১১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা থাকা কালীন রমনা এলাকায় কিছু সরকারী দালানকোঠা নির্মিত হয়েছিল। তাতে মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কিছু অফিসারদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য সরকারী কর্মচারিদের জন্য মুলি বাশের ছাউনি দিয়ে রাতারাতি থাকার ঘর গড়ে তোলা হয় পলাশী ও নীলক্ষেত এলাকায়। এই অস্থায়ী ঘর গুলোই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে পলাশী ব্যারাক ও নীলক্ষেত ব্যারাক নামে। অাজিমপুর, ধানমন্ডি, গুলশান তখন অাদৌ হয়নি। ধানমন্ডি যেতে মানুষ ভয় পাইতো। গুলশান ছিলো জঙ্গলা গ্রাম। অাজিমপুরে সামান্য কয়েক ঘর গেরস্ত পরিবার ছিল। সেখানে বাঁশের বেড়ায় ব্যারাকের মত করে অনেক গুলো ঘর তৈরি হয়েছিল। মুলি বাঁশের এসব ঘরের মধ্যে যেমন ছিল একতলা ঘর, তেমনি ছিলো দোতলা ঘরও। এধরণের দোতলা ঘরের উপরতলা থেকে কালেভদ্রে চা পড়লে নিচের তলার বাসিন্দারা তাকে পেশাব সন্দেহ করে কিভাবে কোন্দলে লিপ্ত হতো তার এক সরল চিত্র পাওয়া যায় মুনীর চৌধুরীর ‘পলাশী ব্যারাক’ শীর্ষক নাটিকায়। প্রশাসন কর্মচারীদের কষ্টকর অবস্থার কথা বিবেচনা করে দ্রুত অাজিমপুর গভর্মেন্ট কোয়ার্টারস করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এক বৎসরের মধ্যে কিছু দালানকোঠা নির্মাণ হওয়ায় অফিসারদের দুঃখ-কষ্টের কিছুটা লাঘব হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন দালানটি অাসাম বেঙ্গল সরকারের সেক্রেটারীয়েটের অফিস হবে বলে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং পাকিস্তান হওয়ার মাত্র তিন বৎসর পুর্বে এখানে মেডিকেল কলেজ খোলা হয়। কিন্তু, কলকাতা মেডিকেল কলেজের জিনিষপত্রের অর্ধেক অংশীদার হয়ে ও অামাদের প্রাপ্য জিনিষপত্র সেখান থেকে অানা হয়নি বলা যায় আমাদের দেওয়া হয়নি। মেডিকেল কলেজের কোন ডিপার্টমেন্টেই জিনিষপত্র ছিলনা। তার উপর প্রফেসরের অভাব। একই প্রফেসর দুই তিন বিষয়ে লেকচার দিতেন এবং ওয়ার্ডগুলিতে রাউন্ড দিতেন। যিনি এক্সরে করতেন তিনিই আবার মেডিসিন, ফার্মাকোলজি পড়াতেন। অাবার, মেডিকেল ছাত্রদের জন্য কোন অালাদা ছাত্রাবাস ছিলনা। তারা মেসে কিংবা অাত্মীয় – স্বজনের বাড়ীতে থাকতো। যেসব ছাত্ররা কলকাতা থেকে এসেছিল তারা সবাই সৈনিকদের পরিত্যাক্ত বাঁশের ব্যারাকে থেকে পড়াশোনা করতো। এই ছিলো মেডিকেল কলেজের অবস্থা।
সাতচল্লিশ সালের অাগে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ অবকাঠামো ছিলো খুবই নাজুক অবস্থায়। দূর -দূরান্তের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিলো নৌকা ও লঞ্চ। ঢাকায় তখন বড় কোন রাস্তাঘাট ছিলো না। ছোটখাট যাও ছিলো ভাঙ্গাচুরা কিংবা গর্তবহুল। এয়ারপোর্টের রাস্তায় কাওরান বাজারের নিকট ছোট একটি পোল ছিল। এর উপর দিয়ে গাড়ি নেওয়ার সময় পোলটি নড়াচড়া করে উঠতো।গাড়িতে বেশী লোক থাকলে কয়েকজনকে অাগেই নেমে যেতে হতো।
সমগ্র পুর্ব বাংলায় সড়কের দৈর্ঘ ছিল মাত্র ৭৫৭ মাইল। যানবাহনের অবস্থা ছিল মান্ধাতা অামলের। তখন ঢাকা কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের অবস্থাও ছিল খুবই নাজুক। পরবর্তীতে রানী এলিজাবেথের ঢাকা অাগমন উপলক্ষে এয়ারপোর্ট এবং রাস্তা দুটোরই সংস্কার করা হয়।
১৯৪৭ সালের অাগে ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলায় কোন শিল্প নগরী গড়ে ওঠেনি। যদিও সে সময়ে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাধিক পাট পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত হতো। কিন্তু, এ পাট সম্পদের মাধ্যমে শিল্প ও অর্থনীতির যা কিছু বিকাশ ঘটে সবই ছিলো কলকাতাকে ঘিরে। অার, পূর্ব বাংলা ব্যবহৃত হতো কলকাতায় কাঁচামাল সরবারহের হিন্টারল্যান্ড হিসেবে।কারন,সবগুলো পাটকল স্থাপিত হয়েছিল ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে। ৪৭’ সালে বাংলাকে এমনভাবে ভাগ করা হয় যার ফলে প্রায় সবগুলো শিল্প- কারখানা ভারতের অংশে পড়ে যায়। সে সময় পূর্ব বাংলায় মাত্র তিনটি বস্ত্রকল ও দুটি চিনি কল ছিল। ছাতক সিমেন্ট কারখানায় তখন বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৭৫ হাজার টন যা ছিল সময়ের তুলনায় খুবই নিম্ন পর্যায়ের। স্বাধীনতার পর কিছু মুসলিম শিল্পপতি তাদের সামান্য পুঁজি নিয়ে ঢাকায় অাসেন যাদের সবাই ছিলেন অবাঙালী। আদমজি, ইস্পাহানী, বাওয়ানী প্রভৃতি কয়েকটি শিল্প উদ্যোক্তা পরিবার এদেশে এসে শিল্প কাঠামো গড়ে তোলেন।
এদিকে ১৯২১ সনে ঢাকার বুকে জেগে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অাগ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নজর বন্দী হয়ে থাকে। একে এফিলিয়েটিং এর মর্যাদা না দিয়ে কার্যত পঙ্গু করে রাখা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে এক সরকারী অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ব বাংলার সকল কলেজকে অধিভুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাস হতো কার্জন হলে, অার অার্টস ফ্যাকাল্টির ক্লাস হতো ঢাকা মেডিকেল কলেজের যেখানে এখন যে ইমসর্জেন্সী বিভাগ তার সাথের লাগোয়া অংশে। শুধু অার্টস ফ্যাকাল্টির ক্লাসই নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও অবস্থিত ছিল এর এক অংশে। জগন্নাথ হলের এক অংশে অবস্থিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অফিস। কত কষ্টই না তাদের করতে হয়েছিল!!
স্বাধীনতা পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিক্ষা ক্ষেত্রে যে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয় তারই প্রেক্ষিতে নতুন শহর অাজিমপুরে সরকারি কর্মচারীদের বাসভবনের কাছে গড়ে তোলা হয় নিউ মার্কেট। স্কুল কলেজের বই নয় সাধারন পাঠকদের রুচি অনুযায়ী বই বিক্রি করাই ছিল বিক্রেতাদের প্রধান লক্ষ। কিন্তু, তারা যে বই পড়তে চান তার শতকরা ৯০ভাগই ছিল কলকাতায় প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের বই।এগুলো কলকাতা থেকে অামদানি করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ৪৮’ সালে বাংলাবাজারে একটি গলিতে অনেক গুলো বইয়ের দোকান ছিল। যেখানে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ছাড়া কারো বই বিশেষ দেখা যেতোনা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি অনেক গুলো নতুন দোকান হয় ; যারা সাধারন পাঠকের বই পড়ার খোরাক মেটাবার জন্য বাংলা বইয়ের পাশাপাশি ইংরেজী বই অামদানী শুরু করেন। কিন্তু আরবি ভাষায় বই কিংবা ইসলাম বিষয়ে কোন বই হাতের নাগালে পাওয়াটা ছিল অনেকটা দুষ্কর।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কোন দৈনিক পত্রিকাতো ছিলোইনা, দৈনিক পত্রিকা মুদ্রণ উপযোগী কোন ছাপাখানা ও ছিল না। ঢাকায় চাবুক, সোনার বাংলা প্রভৃতি নামে দু’ একটি পত্রিকা ছিল, তবে তার সবগুলোই ছিল হিন্দুদের। বাঙালি মুসলমানদের যে দুইটি দৈনিক পত্রিকা ছিল অাজাদ ও ইত্তেহাদ —-পত্রিকা দুইটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো।পাকিস্তান স্বাধীনতার পর দৈনিক অাজাদের অফিস কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে ঢাকেশ্বরী রোডে নতুন বাড়ি নির্মাণ করে তাতে স্থাপন করা হয়।এর মাধ্যমেই ঢাকায় মুসলিম সাংবাদিকতার সূচনা হয়।
সর্বশেষ অামরা বলতে চাই, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নানা বাধা- বিপত্তি সত্ত্বেও ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলার খামার বাংলা এক নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে ওঠেছিল। গড়ে ওঠে অার্থ-সামাজিক অবকাঠামো। শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতিতে দেখা দেয় নতুন জাগরণ। গড়ে ওঠে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পত্তনের সামর্থ।
ষাটের দশকে জেগে ওঠা বাঙালি সেক্যুলারদের আস্ফালন মুসলিম জাতি ধর্মের চিন্তাকে মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সফল ছিল বলা গেলেও সেটা ছিল শহুরে শিক্ষিত স্বার্থের লাগি এক শ্রেণির মানুষের চিন্তার পরিবর্তন। যা গ্রামীণ জনপদে থাকা কাঙাল চাষার হৃদয়ে লুকায়িত ধর্মের চিন্তায় পরিবর্তন সাধিত করতে পারে নি। তাছাড়া, ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনে চিন্তার পরিবর্তন ঘটলেও, ৪৭’র চেতনাকে ভুলিয়ে দিলেও বাংলাদেশের স্থাপত্যকলা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর উপস্থিতি এখনো সাক্ষ্য দেয়, “এদেশে এক সময়ের আলো-আঁধারির মাঝের হাড়ভাঙা উন্নয়ন, পরবর্তীতে দূর্নীতির আঁচলে ঢাকা চেতনার স্বাধীনতার আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি এক হয়ে ওঠে নি।”