আযাদী আন্দোলন সাময়িক ভাবে ব্যর্থ হলেও এর ফল ছিল সুদুরপ্রসারি। এ আন্দোলন ছিল ১৭৫৭ সাল থেকে পরবর্তী মুসলমানী ক্ষোভের চলমান প্রক্রিয়া। এই ক্ষোভ জড়ো হয়ে ছিল অনেক বিষয়কে কেন্দ্র করে। যে মুসলমান শাসনামলে তাদের করুনা লাভের জন্য ব্রিটিশদের প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হতো। সেই ব্রিটিশই তখন হয়ে গেল শাসক আর শাসক হয়ে গেলো তাদের হাতের মোয়া। তৎকালীন পরিবেশের খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল।
ক্ষমতার দন্ড হাতে নিয়েই আটলান্টিকের ওপার থেকে আসা ভাইকিংস জলদস্যুদের উত্তরসূরী ইংরেজ বেনিয়ারা বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে। ফলে, মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক প্রদত্ত সকল প্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারিতে পরিণত করে।এর অল্পকিছু কাল না পেরুতেই আবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইনের দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী,(যা টুকু ছিল) তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে তারা হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর খুব দ্রুত পতন্মুখ হয়ে পড়েন।
ব্যবসা বানিজ্য ও শিক্ষার অঙ্গন থেকেও মুসলমানদেরকে বহুদূরে নিক্ষেপ করা হয়৷ ব্যবসা ও শিল্প ক্ষেত্রে ইংরেজ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের ফলে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। এবং অধিকাংশ শিল্পই ধ্বংস হয়ে যায়। মুসলমানদের প্রতি বেইনসাফী, তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, চাকরি থেকে বাদ দেওয়াসহ মুসলমানদের ভাষাতত্ত্বের উপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভাবেই আক্রমণ পরিচালনা করার মাধ্যমে গড়ে ওঠা মুসলমানদের স্বাধীনচেতা কঠিন জওয়াবের বহিঃপ্রকাশ ছিল ৫৭’র আযাদী আন্দোলন।[০১]
এ আন্দোলন সফল না হওয়ার পিছনে ছিল নানাবিধ কারণ। তন্মধ্যে, ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মোকাবেলায় বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরাতন ও অসময়োপযোগী। দেশীয় সৈন্যদের মধ্যে ছিল ঐক্য ও শৃংখলার অভাব। চট্টগ্রাম, ঢাকা, ব্যারাকপুর, ও বহরুমপুর থেকে আরম্ভ করে দিল্লি পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লব শুরু হলেও তাদের ছিলনা কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সকলের মধ্যে কোন পারষ্পরিক যোগাযোগ ছিল না।
এগুলোর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় ডেঞ্জারাস আকার ধারণ করেছিল। হিন্দু বাবু শ্রেণি কর্তৃক ব্রিটিশদের প্রবল তোষামোদ। অবশ্য হিন্দুদের এই মনোভাব ব্রিটিশ সরকার ভালোভাবে জানতেন বিধায়ই, সে সময়ের সকল আক্রোশ মুসলমানদেরকেই বহন করতে হয়েছিল। যদিও এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল সিপাহীদের বিদ্রোহের মাধ্যমে। কিন্তু এটার সমাপ্তি এখানেই স্থির ছিল না। বিদ্রোহী সিপাহীদেরকে যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই মারা হয়েছে। তার সাথে রক্ষা পায় নি, নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ও মুসলিম শ্রেণির বিপ্লবীরাও। বিপ্লবের ছোঁয়া পূর্ব বাংলায় হালকা স্পর্শ করলেও এখানকার(হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গায়) ব্রিটিশ আগ্রাসনে প্রাণ দেওয়া মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম ছিল না। গুটিকয়েক সিপাহি ব্যতীত কেউ নিজেদের প্রাণে রক্ষা করতে পারে নি।
বিশেষ করে,পুরো হিন্দুস্তানের জনপদ ভেসে গিয়েছিল মুসলমানদের তাজা রক্তে। শুধু দিল্লিতেই একসাথে পাঁচশত সেরা আলেমকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল। তৎকালীন সারা হিন্দুস্তানের বিবরণ লিখতে গিয়ে এডওয়ার্ড টমাস লিখেছেন, “একমাত্র দিল্লি শহরে পাঁচশ শ্রেষ্ঠ আলেমকে শূলবিদ্ধ করা হয়েছিল। জল্লাদদের বাধ্য করা হতো তারা যাতে বেশি সময় পর্যন্ত লাশ শূলের উপর টাঙিয়ে রাখে। ময়দানে প্রতিষ্ঠিত শূলদণ্ডগুলে থেকে বারবার লাশ নামানো হচ্ছিল। আর তা দেখে সাম্রাজ্যবাদী শাসক ইংরেজদের কলিজা ঠান্ডা হচ্ছিল।”[০২]
তখনকার দিনগুলোতে মুসলমান মানেই ছিল ছাড় পাবার যোগ্য নয়। যেখানেই তাদের উপস্থিতি পাওয়া যায় সেখানেই সব উড়িয়ে দিতে হবে৷ যে ভূমিকে মুসলমানরা আপন আলয় হিসেবে গড়ে তুলেছিল সেই মুসলমনাদেরই তখন কঠিন অবস্থা। সারাজীবন যাদেরকে ইনসাফের প্রতিফলন স্বরুপ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সময়ে এসে তাদের প্রবল হিন্দুত্ববাদী বিষক্রিয়ার যের মুসলমানদেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছিল। দিল্লির বুকে দাড়িয়ে তৎকালীন সময়ে মীর্জা গালিব শোকাতুর কন্ঠে সাক্ষ্য দিচ্ছেন,
“দিল্লি আর সেই মহানগরী নেই। তার দুর্গ,তার শহর,তার দোকানপাট, তার ফোয়ারা সব কিছুই গেছে। হিন্দু মহাজনেরা আছে কিন্তু ধনী মুসলমান আর নেই বললেই হয়। চেনা জানাদের মধ্যে এত লোককে হত্যা করা হয়েছে যে, আজ যদি আমার মৃত্যু ঘটে, শোকে চোখের পানি ফেলবে এমন কেউ আর নেই।”
সারা হিন্দুস্তান যখন বিপ্লবের আগুনে দাউ দাউ করছে, তখন পূর্ব বাংলার ঢাকাও এর বাহিরে ছিল না। যদিও এখনকার আন্দোলন তার হুল ফোঁটানোর আগেই তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক দিক থেকে মুসলমান বিপ্লবীদেরকে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করতে হয়েছে, অন্যদিকে দেশীয় রাজাকার ও হিন্দুত্ববাদীদেরও বিরোধিতা করতে হয়েছিল। যদ্দরুন, অসহায় বিপ্লবীরা বিদ্রোহের অনল ধরালেও তার আলোচ্ছটা বেশিদূর যেতে পারে নি। “হৃদয়নাথ মজুমদারের তথ্য মতে, ঢাকা শহরের হিন্দুরাও সিপাহীদের বিরোধিতা করেছিল এবং মুসলমান সম্প্রদায় বিদ্রোহের পক্ষে ছিল। শাহ আহসানুল্লাহ’র (র) বক্তব্যও একথাই সমর্থন করে। তিনি বলেন,”আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুগণ আমাদের সাথে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া আমাদিগকে বিপদে ফেলিয়া দিয়াছিলেন, সে ভয়াবহ দৃশ্য এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই।”
কেউ কেউ হৃদয়নাথ মজুমদারের বক্তব্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করার যে প্রয়াস পেয়ে থাকেন তা সঠিক বলে প্রমানিত হয় না। (এছাড়াও, সেসময়কার ব্রিটিশ ইতিহাস লিপিকারদের লেখাও তাই প্রমাণ করে)।[০৩] যদিও প্রথম দিকে হিন্দু মুসলিম সকলেই ব্রিটিশ বিরোধী ছিল। কিন্তু, পরে অনেক হিন্দু বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশ পক্ষ অবলম্বন করে।.. এছাড়াও সাধারণ হিন্দু কর্মচারিগণ ইংরেজদের সহযোগীতা করেছিল।[০৪]
কিছু অমুসলিম আহতের সংবাদের প্রেক্ষিত তাদের গুটিকয়েকের অংশ গ্রহণের কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। অন্যদিকে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিপ্লব পরবর্তী সকল চাপ এসে লেগেছিল মুসলমানদের ঘাড়ে। আন্দামানে বন্দীদশায় থাকাবস্থায় শহিদ হওয়া মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী তার আত্মকথায় লিখেছেন যে, “স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে একথা প্রমাণ হলেই শুধু কোন হিন্দুকে ধরা হতো,কিন্তু পালাতে পারে নি এমন কোন মুসলমান সেদিন বাঁচে নি।”[০৫] সারা ভারতেই একটা কঠিন পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে মুসলমানদেরকে যেতে হয়েছিল।
সিপাহি বিদ্রোহকে নিছক সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। শুধু ভুল না এর রাজনৈতিক মাত্রা ও তাৎপর্যকে উপেক্ষা করা হবে৷ এ বিদ্রোহের কারণ ধর্মীয় হলেও সিপাহীরা চেয়েছিল বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে, মুঘল সম্রাটের শাসনে প্রত্যাবর্তণ করতে। বিদেশি শাসকদের অবজ্ঞা অবহেলা বৈষম্য ও বঞ্চনা সিপাহিদের মনে জন্ম দিয়েছিল এমন এক বোধ, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে দেশাত্মবোধ। মুঘল সম্রাটের উদার ও অসাম্প্রদায়িক শাসনের স্মৃতি ভারতীয় সিপাহীদের করেছিল ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত। সোনালী অতীতকে তাই ফিরিয়ে আনার জন্য তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
আযাদী সংগ্রামের পরবর্তী সময় থেকেই মুসলমান সমাজের রাজনীতি ও সংস্কৃতি ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়। এই নতুন রাজনীতির পথচলাই তাদের পৌঁছে দেয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯০৬ সালের মুসলিম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শেকড় সন্ধানী আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে, উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের। শুরু হয় ধর্ম,সমাজ জীবন চর্চা ও সংস্কৃতির আলোকে মুসলমান সমাজের আত্মানুসন্ধান ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে উদ্ভব ঘটে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের। তার কিছুকাল পরেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভারসাম্যহীন ক্ষমতায়ন প্রেক্ষিত ধর্মের জাল ছিড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে উদ্ভব ঘটে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।
ষাটের দশকের এই বাঙালিয়ানা রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ মুসলমান মানস চিন্তায় ভর করে সামনে উঠে আসে হিন্দুত্ববাদের কালো খোলস। যার চিন্তাকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করা হয় ধর্ম নিরেপক্ষতার মুখোসের আড়ালে বাঙালিয়ানার বীজ। তাই বলে মুসলমান ঐতিহ্যের ধারক-বাহকগন যে একেবারে বসে খেলে সময় কাটিয়েছেন বিষয়টা এমন নয়। বরং, রাজনৈতিক চাদরের ঢাকা যে তত্বায়ন পাঠ্যবই থেকে শুরু করে সিম্বলিক আকারে সর্বস্থানে হাজির করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সর্বদা তারা ন্যয়ের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা চালিয়েছেন।
কিন্তু, তারা ছিলেন গুটিকয়েক। রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করতে না পারায় গলা উঁচু করতে পারেন নি। ছড়িয়ে দিতে পারেন নি তাদের আত্মপরিচয়ের সংবাদ মানুষের কর্ণকুহরে। তাই বলে কি এই সংগ্রামের ধারা কি এখানেই শেষ হয়ে যাবে .? আপনি আপনার আইডেন্টিটির জন্য যদি না লড়ে যান তাহলে কারা বাকি কাজগুলো গুঁছাবে.? ৪৭’এ তোলা সাংস্কৃতিক চিন্তার উন্নয়নে আপনার কি কোন অবদান রাখার ইচ্ছে নেই.? এসব চিন্তা করার দায়িত্ব আপনার আমার সবার।
তথ্যসুত্রঃ-
০১| বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-
০২| উদ্ধৃত, ফাহমিদুর রহমান(সম্পাদিত), পৃষ্ঠা -৭৯
০৩| দে. নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, পৃ-১২৪,
০৪| প্রাগুক্ত, পৃ-১২০,
০৫| মাওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী, আযাদী সংগ্রাম’১৮৫৭, অনুবাদঃ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা-১৭