১৭৫৭ সালের ২৩ই জুন পলাশীর আম্রকাননে সিরাজের পরাজয়ের পরবর্তী শুরু হওয়া ইতিহাসই বাংলার মুসলমানদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের ইতিহাস। আর এই পুনরুদ্ধার আন্দোলনের প্রথম নায়ক ছিলেন মীর কাশিম। শুরুর দিকে ইংরেজ বেনিয়ারা তার দ্বারা কিছুটা উপকৃত হলেও তার নবাব হবার পরবর্তী কালে ইংরেজদের আসল মতলব বুঝে ফেলতে তার বেশি বেগ পেতে হয় নি। এমনকি সে ধারাবাহিকতায় বিদেশি শক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যেও তিনি একাধিক বার ইংরেজদেরর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বাংলার মুসলমানদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার আন্দোলনের প্রথম নায়ক ছিলেন মীর কাশিম; Image Source: bn.wikipedia.org
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের রাজণ্যবর্গের প্রতি উদার্থ আহ্বানও জানিয়েছিলেন। যথাসময়ে তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায়, একাকি সংগ্রাম চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাড়াতে হয় তাকে। যার শেষ পরিণতি ঘটে করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এত বিপদসংকুল পরিবেশ পাড়ি দেওয়ার পরও তিনি ইংরেজদের সাথে সন্ধির কথা কল্পনা করেন নি। বরং তার মনের ভিতর জেগে উঠা সাহসী চেতনার পাশাপাশি উদ্ধেলিত বিশ্বাসের বিচ্ছুরণ ঘটে তার কর্মে। তিনি হার মানেন নি। বরং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হার না মানা সংগ্রামের আমানত গচ্ছিত রেখে যান।
মীর কাশেমের পর মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকীর বিপ্লব, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার আন্দোলন, হাজী শরীয়ত উল্লাহ ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন, দক্ষিণ ভারতের টিপু সুলতানের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বাধীন জিহাদ আন্দোলন প্রভৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশের নীল বিদ্রোহ ও কৃষক বিদ্রোহে নির্যাতিত মুসলমানদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। এসব বিদ্রোহ সংগ্রামের পটভূমিতেই সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব।
সিপাহী বিদ্রোহের একটি চিত্রকল্প; Image Source: bn.wikipedia.org
এই বিপ্লবের আগুন প্রথমত বাংলাতে দেখা দিলেও এর সাথে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের অংশগ্রহণের সম্পর্ক ছিল কদাচিত। দক্ষ নেতৃত্বের অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, দেশীয় জমিদারদের ইংরেজ প্রীতি ও যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতাই এর অন্যতম কারণ। অন্যদিকে, এই বিপ্লবের অনল প্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ভারতের অন্দরে কন্দরে। ভারতবর্ষের শেষ রাজধানী তখন দিল্লি হওয়াই ছিল এর মূল কারণ। দিল্লি অধিকার করে সেখানে শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে পুনরধিষ্ঠিত করাই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তাছাড়া, মীরাটে ছিল বৃহত্তম সেনানিবাস। সেই মীরাটে ই সিপাহীদের বিদ্রোহ এবং অযোদ্ধায় তা গণবিদ্রোহের রুপ গ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল।
অযোধ্যার সিংহাসনচ্যুত নবাব সৈয়দ ওয়াজিদ আলী শাহ তখন কলকাতার গার্ডেনে একটা বাড়িতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। প্রায় দুই হাজার সিপাহি তার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। পরিকল্পনা হলো ২৭ ই জানুয়ারি তারিখেই তারা লাটবন, টাঁকশাল, ট্রেজারী ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেবে। দুর্ভাগ্যক্রমে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সব কিছু ভণ্ডুল হয়ে যায়। ইংরেজরা সৈয়দ ওয়াজিদ আলী শাহকে গ্রেফতার করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে আটক রাখে।
সৈয়দ ওয়াজিদ আলী শাহ; Image Source: bn.wikipedia.org
সে সময় উত্তর ভারতের এক বাহ্মণ তণয় সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে তখন ব্যারাকপুর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। তিনি এনফিল্ড বন্দুকে কার্তুজে ধর্মনাশের আশংকায় তার উর্ধতন এক ইংরেজ এডজুটেন্টকে হত্যা করে বিদ্রোহের সূচনা করেন। তাকে সামরিক বিচারে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয় ( পরবর্তীতে ব্যরাকপুরে একটি পার্ক করা হয়, ঐ পার্কের নাম করা হয় মঙ্গল পান্ডে পার্ক)।[০১] ব্যারাকপুরের ঘটনা দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চারদিকে সিপাহিরা দেশীয় জনতাকে সাথে নিয়ে বিক্ষোভ গড়ে তোলেন। সে বিক্ষোভের রেশ বঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলেও পৌঁছে যায়। এই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লীর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। পরে ইংরেজরা সম্রাটের সব পুত্রকে হত্যা করে এবং বিচার করে বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়৷ সেখানেই তিনি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রাণত্যাগ করেন।
বাংলাদেশে প্রথম বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। তারপর ঢাকায়। মূলত, ঢাকার পরিবেশ তখন খারাপ থাকলে ও বাঙালি সিপাহীরা সেদিন বুঝতে পারেনি। ফলে বিনা অপরাধে তাদের জীবন দিতে হয়। তবে ব্যারাকপুরে বিদ্রোহের শুরুর দিন থেকেই ঢাকার পরিবেশ ছিল থমথমে। সি.ই. বাকল্যাণ্ড বলেন, বঙ্গীয় সরকারের অধিনে এমন একটি জেলাও ছিল না যাহা প্রত্যক্ষ বিপদের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে নি অথবা যেখানে ভয়ংকর বিপদের আশংকা ছিল না।[০২]
লালবাগ কেল্লায় তখন ৫৩ তম ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর দুটি দল ছিল। গোলন্দাজ সৈন্যসহ দেশী সিপাহিদের সংখ্যা ছিল ২৬০ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশই পাঠাণ । কিছু শিখ সৈন্য ও ছিল। এরা কালা সিপাহি নামে ঢাকা বাসীর কাছে পরিচিত ছিল।[০৩] ইংরেজ সিপাহিদের বলা হত গোরা সিপাহি। কালা সিপাহিরা ছিলেন শক্তি সামর্থ্যে অমায়িক। এজন্য শহরের মুসলমানদের মাঝে তারা খুব জনপ্রিয় ছিলেন। অন্যান্যদের সাথেও তাদের সম্পর্ক খারাপ ছিল না।[০৪]
মে মাসে মিরাটের বিদ্রোহের সংবাদ ঢাকায় পৌঁছালে, ঢাকায় জনজীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, এসময় বাংলাবাজারে ধর্ম প্রচার কালে সিপাহিদের পক্ষ থেকে মিশনারীদের কিছুটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।[০৫] এ প্রতিরোধ সরাসরি ছিলনা বরং প্রচন্ড ভয় থেকে তারা নিজেদেরকে ধর্ম প্রচার থেকে কিছু সময়ের জন্য বিরত রেখেছিল। বাংলাবাজার ফিমেল স্কুল ও এসময় ছাত্রীশূণ্য হয়ে পড়েছিল। কারণ, গুজব রটেছিল সিপাহিরা নাকি স্ত্রী শিক্ষা পছন্দ করে না। মে মাসের শেষে এবং জুন মাসের শুরুতে ‘৭৩-এর দুটি কোম্পানি জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল বদলি হিসেবে। তারা নাকি সিপাহীদের সাথে নিয়ে চারদিকে লুটপাট আরম্ভ করেছিল। যদিও এগুলো ছিল গুজব।
পরবর্তীতে, ১৮৫৭ সালের আগষ্ট মাসে লেফটেন্যান্ট লুইসের অধিনে একশ নৌসেনা দুটি চৌদ্দ ইঞ্চি কামান নিয়ে, ‘ক্যলকাটা’য় করে পৌঁছেছিলেন ঢাকায়। রতনলাল চক্রবর্তী সরকারি নথি উদ্ধৃত করে অবশ্য বলেছেন যে, লুইসের অধিনে ছিলেন দেড়শ নৌসেনা, আর তারা ঢাকা এসে পৌঁছেছিলেন ‘জেনোবিয়া’ ও ‘পাঞ্জাবে’। সেনা কমবেশি হতে পারে, জাহাজের নামের গরমিল থাকতে পারে, তবে মূল কথা হলো ঢাকায় ইউরোপীয়দের রক্ষার্থে (বা ঢাকা রক্ষার্থে) পাঠানো হয়েছিল লুইসকে। লুইস সৈন্য দের নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন, ব্যপটিস্ট চার্চের উল্টো দিকে এক বাড়িতে। কুমারটুলির এলিসের বাড়িটি মাসিক আশি রুপিতে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তাদের সেনা হাসপাতাল করার জন্য। [০৬]
৩০ জুলাই, ঢাকায় বসবাসরত অধিকাংশ ইউরোপীয়(প্রায় ষাট জন) ও স্থানীয় লোকদের নিয়ে একটি সভা হয়। একটি পদাতিক ও একটি অশ্বারোহী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মেজর স্মিথ পদাতিক বাহিনীর ও লেফটেন্যান্ট হিচিন্স অশ্বারোহী বাহিনীর সৈন্যাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।[০৭]
ইতিমধ্যে, ঢাকা ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান অনেক আর্মেনিয়ান। এদিকে ইউরোপীয়রা চিন্তা করছিল ‘ফলির মিল’কে দুর্গের মত দুর্ভেদ্য করার। অথচ, এসব কিছুর কানাকড়িও নেটিভরা বুঝতে পারে নি, বিলাতী সাহেবরা কেন এত উত্তেজিত বা স্বেচ্ছাসেবকরাও এত কষ্ট করে কেন রাতে টহল দিচ্ছে, কোন কিছুই নেটিভদের চিন্তাকাশে সেদিন নাড়া দিতে পারে নি। মি. ব্রেনালডের ডায়েরি থেকে জানা যায়, সেসময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সিপাহি বিদ্রোহের কথা ঢাকাবাসীকে জানতে দেওয়া হতো না, তারা শুধু জানতো যে, গোরা আর কালার লড়াই শুরু হয়েছে।… কেননা সিপাহি বিদ্রোহের কিছুদিন আগে ঢাকার লালবাগ কেল্লা সেনানিবাসে বাঙালি অবাঙালি সিপাইদের মধ্যে এক লড়াই হয়। চল্লিশজন অবাঙালি সিপাই একশত জন বাঙালি সিপাইকে আক্রমণ করে। এ ঘটনার ফলে অবাঙালি সিপাইদের নেতা ওমরাও সিংকে ইংরেজরা একশত টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ছয় মাস কারাদণ্ড প্রদান করে।[০৮]
২১ নভেম্বর গোয়েন্দা সূত্রে চাটগাঁর সিপাহি বিদ্রোহের খবর ঢাকায় পৌঁছলে লে. লুইস সামরিক ও বেসামরিক এক বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন যে, ঢাকায় দেশি সিপাহিদের নিরস্ত্র করা হবে। ২২ নভেম্বর সকাল পাঁচটায় জড়ো হতে বলা হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবকদের আন্টাঘড় ময়দানে। ঠিক সময়ে কমিশনার, জজ, কিছু সিভিলিয়ান এবং কুড়িজন স্বেচ্ছাসেবক মিলিত হয়েছিলেন। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও।লে. লুইস, লে. ডডওয়েল ও উইলিয়াম ম্যাকফারসন অগ্রসর হয়েছিলেন লালবাগের দিকে। একই সময়ে লে. রিন্ড, ফরবেস, হ্যারিস, স্বেচ্ছাসেবী নলেন পোগজ, স্যামুয়েল রবিনসন ও জন জারকাস রওয়ানা হয়েছিলেন সরকারি কোষাগারের দিকে, প্রহরীদের নিরস্ত্র করার জন্য। তোপখানায় তখন প্রহরা দিচ্ছিলেন জন পনের সিপাহি। তাদের অনেকেই ঘুমোচ্ছিলেন তখন। ঘুম থেকে তুলে যখন তাদের নিরস্ত্র করা হচ্ছিল তখন শোনা গেল লালবাগ থেকে গুলিগোলার শব্দ। ইংরেজ স্বেচ্ছাসেবীরা হঠাৎ এই গুলির আওয়াজে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেল, তোপখানার প্রহরীরা সে সুযোগে পালিয়ে যায়।
এদিকে নৌসেনারা লালবাগ যখন পৌঁছালো, তখন সবেমাত্র মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠে আজান ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল। অনেকেই আশুরার রোজা পালনের জন্যে সেহরি খেয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। কেউবা ফজর নামাজ আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনি সময় অতর্কিতে দূর্গের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের ভাঙা প্রাচীরের কাছ দিয়ে ইংরেজ সেনাগণ আক্রমণ চালালো। মাত্র গুটি কতক সৈন্য রাত্রি জাগা ঢুলুঢুলু চোখে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উচ্চকিত হয়ে উঠলেও অন্য সিপাহীগণ অতর্কিত আক্রমণের প্রচন্ডতায় দিশেহারা হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো।
ইংরেজ সেনাগণ পরিষ্কার দেখতে পেলো সিপাহীরা নেতৃত্বের অভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছুটাছুটি করছে। কেউ বা পালাবার চেষ্টা করছে। পালাতে গিয়ে অনেকেই পঞ্চাশ ফুট কেল্লার প্রাচীর থেকে পড়ে গিয়ে ভীষণ ভাবে আহত হয়ে পড়ে। ইংরেজদের সাথে ছিল দুটি কামান ও এনফিল্ড রাইফেল। ফলে, সুযোগ বুঝে ইংরেজ নৌসেনারা কেল্লার কামান টিকে দখলে নিয়ে ঘুরিয়ে দেয় সিপাহীদের দিকে। বিভ্রান্ত সিপাহীকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের ব্যারাকের মধ্যে। ইংরেজ সৈন্যরা সেখান থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেছিল তাদের। এরপরই শুরু হয় মরণপণ লড়াই। কিছু সংখ্যক বীর সিপাহি বীর বিক্রমে তাদের সম্মুখে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। এক সিপাহি প্রহরীর গুলিতে ইংরেজ পক্ষের একজন শুরুতেই মারা যায়। কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। যখন ইংরেজ সেনারা লক্ষ্য করলো একদিক থেকেই সব গুলি ধেয়ে আসছে, এবং তাদের উপর আঘাত হানছে। তারা সেদিকে সচকিত হলো। এবার পরিষ্কার বুঝতে পারলো যে, পরি বিবির সমাধি সৌধের ভিতর থেকে কে যেন নির্ভিক চিত্তে অবিরাম গুলি চালাচ্ছে। ইংরেজ সেনারা চতুর্দিক থেকে সমাধিসৌধ ঘিরে ফেললো। এতো এক মহিলা!! ধরা হলো তাকে। সেদিন সফল হতে পারে নি কেল্লার সিপাহীরা।[০৯]
পরি বিবির সমাধি সৌধ; Image Source: bn.wikipedia.org
এক এক করে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছিল। পুরো সংঘর্ষে ৪০ জন সিপাহি শহীদ হয় এবং অনেকে আহত হয়। ইংরেজদের পক্ষে একজন নিহত হয় ও ৪ জন গুরুতর রুপে আহত হয়ে পরে মারা যায়। আরো অনেকে আহত হয়। সংঘর্ষের পর অনেক সিপাহি জলপাইগুড়ির দিকে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিল আরো তিনজন সিপাহি।[১০]
সিপাহিরা এধরণের আক্রমণ কখনো আশা করে নি। নিরুদ্বেগ হয়ে ঘুমিয়েছিল তাদের অধিকাংশ। গুলিবর্ষণের শব্দে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন দ্রুত তারা নিজেদেরকে রেডি করে নিয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল দশ রাউন্ড গুলি,যা দিয়ে প্রতুত্তর দিতে হয়েছিল তাদের। অস্ত্রাগারের চাবি ছিল সুবাদারের কাছে। সিপাহিরা তাকে অস্ত্রাগার খুলে দিতে বললে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি। সুবাদারের স্ত্রীও(পরী বিবির কবর থেকে উনিই গুলি চালিয়েছিলেন।) প্রত্যাখাত হয়েছিলেন অনুরোধ জানিয়ে। সিপাহিরা এ পর্যায়ে সুবাদারকে হত্যা করে চাবি চিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা তখন প্রবল হয়ে ওঠার ফলে আর অস্ত্রের অভাবে অনেক সিপাহিকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। [১১]
দেশীয় সিপাহিরা অবশ্যই এধরনের কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু এটি এতসকাল ঘটবে তার জন্য তারা হয়তো প্রস্তুত ছিল না। ইংরেজরা বিনা প্ররোচনায়, অতি আতঙ্কের কারণে দুর্গ আক্রমণ করে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল নিরপরাধী দেশীয় সিপাহিদের। কেল্লার অভ্যন্তরে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের অনেকের লাশ কেল্লার ভিতরের পুকুরে ফেলা হয়েছিল এবং কতক লাশ কেল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পুকুরের লাশ গুলো সম্পর্কে জানা যায়, গোকুলচর নিবাসী ‘সোনা মিয়া’ পাঁচটি নৌকা দ্বারা লাশ সেখান হতে উঠিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। অন্যান্য লাশগুলো সমাহিত করা হয়েছিল গোড়ে শহীদ এলাকায়। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদ সিপাহিদের এখানে দাফন তথা কবর দেওয়া হয়েছিল বলেই এই এলাকাটি গোড়ে শহীদ নাম ধারণ করে ছিলো বহুবছর। এ ঘটনার কিছুকাল পর থেকেই সিপাহি শহীদদের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্র এ নামের বিকৃতি সাধন করে ‘ঘোড়া শহীদ’ বলে প্রচার করতে থাকে। এ সিপাহিদের মধ্যে অনেক আল্লাওয়ালা তথা বুযুর্গ ছিলেন। গোড়ে শহীদ তথা নবাব সলিমুল্লা এতিমখানার দক্ষিণ পূর্বে যে কটা কবর বা মাজার দেখা যায় তার সবই ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের শহীদ সিপাহিগণের৷[১২] পরবর্তীতে এ কবরগুলোকে মানুষ সেবা ও সম্মান করতে করতে একসময় এগুলোর কয়েকটি পরিণত হয় মাযার শরীফে।
বিদ্রোহে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতারকৃত সিপাহীদের কোনরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বিচারপতি জজ এম্বারকোম্বি (নিরপরাধ সিপাহীদের) ফাঁসীর দন্ড ঘোষণা করেন।[১৩] দন্ডপ্রাপ্তদেরই একজন নেতা পাতলা খাঁনকে ইংরেজরা হাতির পায়ের তলায় নিষ্পেষিত করে। সিপাহির মধ্যে ১১ জনকে ফাঁসী দেওয়া হয়েছিল বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কে, যা তখন পরিচিত ছিল আন্টাঘর ময়দান নামে। বাকী ৯ জন সিপাহিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। স্থানীয় ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা নিউজে এসব খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। আন্টাগর ময়দানে ফাঁসী দেওয়া সিপাহিদের লাশ বহুদিন পর্যন্ত গাছের ডালেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল । সে লাশ পঁচে গলে কাক চিল শকুনে খেয়েই শেষ করেছিল। শেষ পর্যন্ত, তাদের কোথাও কবর দেওয়া হয়েছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। [১৪]
এদিকে ঢাকায় সিপাহীদের নিরস্ত্রকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চট্টগ্রামে সিপাহীদের বিদ্রোহের সংবাদ শোনার পর। সেখানকার সিপাহীরা ১৮ই নভেম্বর রাত নয়টায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে। ইতস্তত গুলি বর্ষিত হতে থাকে। সর্বত্র ভীতির সৃষ্টি হয়। সিপাহীরা কারাগারের চাবি গ্রহণ করে বন্দীদের মুক্ত করে দেয়। অবসর প্রাপ্ত ঠাকুর বক্সের নির্দেশে বিপ্লবীরা ব্যারাক ও অস্ত্রাগার ভস্মীভূত করে। এবং দ্রুত ঢাকায় সিপাহীদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। কিন্তু পথিমধ্যে ঢাকার ব্যর্থ বিপ্লবের খবর পেয়ে তারা মনিপুর বা নেপালের লক্ষ্যে ফেনী নদী অতিক্রম করে। বিপ্লবীদের কর্তৃক মুক্ত ২০২ জন কয়েদির মধ্যে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়। ১৮৫৮ এর ১৭ ই এপ্রিল পর্যন্ত বিপ্লবী সিপাহীদের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বিপ্লবীদের একাংশ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।…..তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা সদর ছিল কুমিল্লা। কিন্তু এখানে কোন দেশীয় সিপাহি ছিল না বিধায় সরাসরি কুমিল্লা বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিল না।
চট্টগ্রাম বিপ্লবী সিপাহিদের ভয়ে ভীতু ত্রিপুরার কালেক্টর এডওয়ার্ড স্যান্ডি দাউদকান্দিতে অবস্থিত বৃটিশ জাহাজে অবস্থান গ্রহণ করেন। কুমিল্লার নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় করে ইউরোপীয় নাগরিকগণ তাদের স্ত্রী পরিজনদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকায় তখন আর বিদ্রোহ নেই। কুমিল্লা কোষাগারের অর্থও ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের এ পথে আগমনের সংবাদ পেয়ে স্ট্যাম্প কাগজ পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিপাহীদের আশা ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজা মাণিক্য বাহাদুর স্বাধীনতা ব্রতী সিপাহীদের আশ্রয় ও নেতৃত্ব দিবেন। কিন্তু তাদের আশা ভঙ্গ হলো। তিনি ঢাকার ইংরেজ সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ২রা ডিসেম্বর সৈন্য পাঠালেন ।…. অবশেষে বিপ্লবীরা বিবির হাঁটের ৫ মাইল ও কুমিল্লার ২০ মাইলের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে বিপ্লবী সিপাহীরা সবকিছু জেনে ফেলে এবং বিলের মধ্যে দিয়ে সিলেট অভিমুখে যাত্রা করে। কুমিল্লায় ধৃত একজন বিপ্লবীর জবানবন্দির সারমর্ম ১৮৫৮ সালের ২ রা জানুয়ারীর ‘ঢাকা নিউজ’ পত্রিকায়(পৃ.২) প্রকাশিত হয়। It would be better for them to fight to death rather than loose their caste and that the padshah(Badshah) would send (them) more them enough aid.
…. পরবর্তীতে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অভ্যুথানের পর বাংলাদেশের একমাত্র সিলেট জেলাতেই ব্যপক সংখ্যক দলত্যাগী ও বিদ্রোহী সিপাহীরা জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি ও তৎপরতার জন্যে এখানেও বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব হয় নি। ফলে এদের অনেকেই সিলেট অঞ্চলে ধৃত হয়৷ কেউ কেউ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে গোপনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।[১৫] এছাড়াও দিনাজপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর ও নোয়াখালীতেও ছোট খাটো বিদ্রোহের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও এতটা প্রভাবশালী কোন ঘটনা এসব অঞ্চলে ঘটার সংবাদ পাওয়া যায় নি।
ইংরেজ কর্তৃক বিভিন্ন উপায়ে নিগৃহীত হওয়া ভারত-বঙ্গের সাধারণ ও নিম্নবৃত্তের হিন্দু কৃষক শ্রেণির অংশবিশেষও সিপাহি বিপ্লবে অংশগ্রহন করে। যার সাক্ষ্য পাওয়া যায় সুপ্রকাশ রায়ের কথায়। তার মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী হিন্দুদের যে অংশটি জড়িত ছিল, তারা ছিল নিতান্ত নিম্নবৃত্তের কৃষক ও সিপাহি। তবে তাদের সংখ্যা যে নগন্য ছিল তা সাময়িক পত্রেই উল্লেখ রয়েছে। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা এ সম্পর্কে লিখে, কিন্তু আনন্দের বিষয় এই যে, এতাদৃশ বিষমতর বিদ্রোহ বিধায়ক বিলাপ বিঘটিত বিষাদ বিশিষ্ট বিপদের ব্যপারে এক ব্যক্তিও বাঙ্গালি(বাঙ্গালী মানে শুধু হিন্দু বুঝিয়েছে) বিযুক্ত হয় নাই এবং বিদ্রোহী দলভুক্ত হিন্দুর সংখ্যা ও অতি অল্প। [১৬]
তথ্যসহায়িকা-
Feature Image Source: en.wikipedia.org
০১| মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭, ফাহমিদুর রহমান(সম্পাদিত), বদ্বীপ প্রকাশন, ২০০৯,পৃ- ১৭
০২| আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত ইতিহাস, দে. নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, পৃ-১১৪, ইসলামী ফাউন্ডেশন।
০৩| নাজির হোসেন, কিংবদন্তির ঢাকা, ৩য় সংস্করণ ১৯৯৫, থ্রিষ্টার কো-অপারেটিভ মাল্টি পারপাস সোসাইটি লিঃ, পৃ- ৪৩০,
০৪| Hridayanath Majumdar. Reminiscences of Dacca,Calcutta 1926. মুনতাসিব মামুন, হৃদয়নাথের ঢাকা শহর, ঢাকা, ১৯৯৪ (২য় সং)। পৃ- ৮২,৮৩ ; ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ : ঢাকায়, মুনতাসীর মামুন, ঢাকা সমগ্র ০১,পৃ-৬৯
০৫| মুনতাসির মামুন, ব্রেনান্ড সাহেবের রোজনামচা ; মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ও ফওযুল করিম অনুদিত, ঢাকা : ক্লের ডায়রী, ঢাকা ১৯৯০, পৃ. ৪৯-৬৩
০৬| উদ্ধৃত, মুনতাসীর মামুন, পৃ-৭১
০৭| এম. এ. রহিম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস(১৭৫৭-১৯৪৭),১৯৯৪, আহমদ পাবলিশিং হাউস, পৃ- ৯৫ ; ড. আহমদ হাসান দানী, কালের সাক্ষী ঢাকা : অনু, আবু জাফর, ২০০৫, খোশরোজ কিতাব মহল, পৃ-৫৬
০৮| ঢাকার কথা, রফিকুল ইসলাম, ২০০৫,ঐতিহ্য, পৃ-১০৪
০৯| উদ্ধৃত, নাজির হোসেন, পৃ- ৪৩৪,
১০| উদ্ধৃত, মুনতাসীর মামুন, পৃ-(৭৩-৭৪) ; এম এ রহিম, পৃ- ৯৫
১১| প্রাগুক্ত, পৃ-৭৪
১২| উদ্ধৃত, নাজির হোসেন, পৃ- ৩৬৯,
১৩| উদ্ধৃত, ফাহমিদুর রহমান(সম্পাদিত), পৃ- ২৭৭,
১৪| উদ্ধৃত, নাজির হোসেন, পৃ- ৩৬৮, মোঃ খালেকুজ্জামান, বিজন জনপদ থেকে রাজধানী ঢাকা, ২০০২, দিব্যপ্রকাশ, পৃ- ১৫৮.
১৫| উদ্ধৃত, দে. নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, পৃ-১২৭-১৩১,
১৬| সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।