সম্প্রতি আজারবাইজানের তাভুশ সীমান্ত এলাকায় আর্মেনিয়া সেনাদের হামলায় জেনারেলসহ ১২ জনের মত আজারবাইজান সেনা নিহত হয়েছে। পাল্টা হামলায় প্রায় ১০০ জনের মত আর্মেনীয় সেনা নিহতের দাবী করে আজারবাইজান। কেন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সংঘর্ষ? কী তাদের ইতিহাস? চলুন তাদের ইতিহাস, যুদ্ধ, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেই।
ম্যাপের ব্যাখ্যা:
ইতিহাস জানার আগে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার ম্যাপটা আগে দেখে নেওয়া যাক। এতে ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয় বুঝতে সুবিধা হবে।
১ম ম্যাপ: আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সীমানা দেওয়া আছে। ম্যাপের গাঢ় হলুদ ও লাল অংশ আজারবাইজানের, তবে তা আর্মেনিয়া দখল করে রেখেছে ১৯৯২ সাল থেকে। লাল অংশটার নাম ‘নাগোর্নো কারাবাখ’, এখানে ৯৫% আর্মেনিয়া বাস করে। যার জন্যে নাগোর্নো কারাবাখের বিদ্রোহীরা আর্মেনিয়াতে যোগ দিতে চায়। কিন্তু আর্মেনিয়া সেই সুযোগে নাগর্নো কারাবাখসহ আশেপাশের ৭ টা আজারবাইজানের জেলা দখল করে (গাঢ় হলুদ অংশ)। এরিয়া হিসাবে এটা প্রায় ১৫% এর মত।
১ম ম্যাপ
২য় ম্যাপ: সম্পূর্ণ আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার স্পষ্ট সীমানা দেখানো আছে, এবং নাগোর্নো কারাবাখও আলাদা করে দেখানো আছে।
২য় ম্যাপঃ
৩য় ম্যাপ: এই ম্যাপে সম্প্রতি সীমান্তে যে সংঘর্ষ হয়েছে, সেই তাভুশ এরিয়া চিহ্নিত করা আছে।
৩য় ম্যাপঃ
৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য মুসলিম বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলটি আরব মুসলিম জয় লাভ করেছিল, এরপরে এই অঞ্চল খলিফার দ্বারা অনুমোদিত স্থানীয় গভর্নর দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ১৫তম শতাব্দীতে, কারাবাখের অঞ্চলটি কারা কয়ুনলু এবং আক কোয়েনলু তুর্কি উপজাতিদের দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৮শ ও ১৯শ শতকে ককেশীয় এই দেশটি পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্যদেশের শাসনাধীন ছিল। রুশ গৃহযুদ্ধের সময় ১৯১৮ সালের ২৮ মে তৎকালীন আজারবাইজানের উত্তর অংশটি একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু মাত্র ২ বছরের মাথায় ১৯২০ সালে বলশেভিক লাল সেনারা এটি আক্রমণ করে আবার রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
এরপরে ১৯২২ সালে দেশটি আন্তঃককেশীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়াতে ভেঙে দেওয়া হয়। তখন থেকেই আজারবাইজানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকার খ্রিস্টান আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব্বের সূত্রপাত।
এরপরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে ১৯৯১ সালের ২০শে অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করে। নাগোর্নো-কারাবাখের জনগণ আর্মেনিয়ার সাথে একত্রিত হতে চায়। এরপরেই এই দ্বন্দ্ব্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে নতুনভাবে স্বাধীন দেশটির প্রথম বছরগুলি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবনতি এবং নাগোর্নো-কারাবাখের যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। সেই সময় আর্মেনিয়া সেনাবাহিনী নাগোর্নো-কারাবাখ ও আরও ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের সামরিক নিয়ন্ত্রণে নেয়।
১৯৯৪ সালের মে মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনীয়রা যুদ্ধে ক্ষান্ত দেয়। ১৯৯৫ সালে আজারবাইজানে প্রথম আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐ বছরই সোভিয়েত-উত্তর নতুন সংবিধান পাস করা হয়।
কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি থাকলেও নাগোর্নো-কারাবাখসহ আরো ৭টি আজারবাইজানি জেলা এখনো আর্মেনিয় দখলে আছে। কিন্তু কেন আজারবাইজান এখনো এই এরিয়া দখল করতে পারতেছে না? আর্মেনিয়ার সামরিক শক্তি কতটুকু? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আজারবাইজান এশিয়া মহাদেশের ককেসাস অঞ্চলের একটি দেশ। ইরান, রাশিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও তুরস্কের সাথে সীমানা আছে। কাস্পিয়ান সাগরের সাথে বিশাল একটা সমুদ্রে সীমা আছে। আজারবাইজানের ‘নাকিচেভান’ নামের একটা প্রদেশ মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা (ম্যাপে আকাশি রং এর অংশ)। এই নাকিচেভানের সাথে তুরস্কের সাথে মাত্র ১১ কিলোমিটার সীমানা আছে।
আয়তন—৮৬,৬০০ বর্গ কিলোমিটার।
জনসংখ্যা—প্রায় ১ কোটি।
৯৭% মানুষ মুসলিম। আর মুসলমানদের মধ্যে ৬৫% শিয়া ও ৩৫% সুন্নি মুসলমান।
৯৫% মানুষ জাতিগতভাবে আজারবাইজানি।
আর্মেনিয়া:
আর্মেনিয়াও এশিয়া মহাদেশের ককেসাস অঞ্চলের একটি দেশ এবং ইরান, জর্জিয়া, আজারবাইজান ও তুরস্কের সাথে সীমানা আছে।
আয়তন—২৯,৮০০ বর্গ কিলোমিটার।
জনসংখ্যা—প্রায় ২৯.৫ লক্ষ।
আর্মেনিয়ার ৯৬% মানুষ খ্রিস্টান।
আজারবাইজান
GDP—৪৭.৫ বিলিয়ন ডলার
মাথাপিছু আয়—৪৭০০ ডলার
আয়—তেল, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস।
আজারবাইজান সবচেয়ে বেশি রফতানি করে বেশি ইটালিতে, এরপর তুরস্কে। এবং
আমদানি করে রাশিয়া থেকে ১৭.৭% ও তুরস্ক থেকে ১৫%
আর্মেনিয়া
GDP—১৩.৫ বিলিয়ন ডলার
মাথাপিছু আয়—৪৫০০ ডলার
আয়-মাইন প্রোডাক্ট, ইন্ডাস্ট্রি প্রোডাক্ট।
সবচেয়ে বেশি আমদানি ১ম-রাশিয়া এবং ২য়-ইরান। রফতানিতেও ১ম রাশিয়া এবং ২য় ইরান।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের র্যাংকিং অনুযায়ী আজারবাইজান ৬৪ নাম্বারে ও আর্মেনিয়া ১১১ নাম্বারে আছে। বাকি প্যারামিটারগুলোর তুলনামূলক চিত্র, ১ম সংখ্যা আজারবাইজানের, তারপরে স্লেস ( /) দিয়ে আর্মেনিয়ার সংখ্যা।
সামরিক বাজেট— $২.৮০৫/১.৩৮৫ বিলিয়ন।
মোট সেনা সংখ্যা— ৪.২৬/২.৪৫ লক্ষ
এক্টিভ— ১.২৬ লক্ষ/ ৪৫ হাজার
রিজার্ভ— ৩/২
ট্যাংক সংখ্যা— ৫৭০/ ১১০ টি
মোট বিমান সংখ্যা—১৪৭/ ৬৪ টি
ফাইটার জেট— ১৭/৪ টি
মোট হেলিকপ্টার— ৮৮/৩৭ টি
এটাক হেলিকপ্টার—১৭/২০ টি
আজারবাইজানের ইসরাইলি অত্যাধুনিক বারাক এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ও রাশিয়ান S-300 মিসাইল সিস্টেম আছে। এছাড়া বাক মিসাইলও আছে। আর্মেনিয়ারও আপডেটেড রাশিয়ান S-300 মিসাইল আছে। এছাড়াও শর্ট- মিডিয়াম এবং রেন্জের বাক এবং টর মিসাইল রয়েছে।
আর্মেনিয়াকে সাপোর্ট করে রাশিয়া এবং ইরান। অন্যদিকে আজারবাইজানকে সাপোর্ট করে তুরস্ক। ১৯৯১ সালে আর্মেনিয়া আজারবাইনের প্রায় ১৮% এরিয়া দখল করে নেয়। তবে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের সামরিক সম্পর্ক অনেক শক্তিশালী। এতে আজারবাইজান ধীরে ধীরে অনেক শক্তিশালী হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে কি আজারবাইজান তার দখল করা এরিয়া মুক্ত করতে পারবে।