কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনায্যভাবে শেষ হয়েছিল।কোনকিছুর মিমাংসা হয়নি, শুধু একটু সাময়িক প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ীপক্ষ পরাজিত পক্ষের সাথে প্রায় পাঁচটি চুক্তি করে, তার একটি ছিল ভার্সাই চুক্তি। জার্মানির সাথে করা এই চুক্তিতে জার্মানির প্রায় ৬৫ হাজার বর্গকিমি ভূমি বিজয়ীশক্তি ভাগজোগ করে নেয়।
নিজেরা যা নিতে পারেনি তা আশেপাশের ছোট ছোট দেশগুলোকে দিয়ে যায়, যারা জার্মানির ভূমি দখল তো দূরে থাক, কোনদিন চোখ তুলে তাকানোরও সাহস হত না।
জার্মানির ডানজিগ বন্দর ছিনিয়ে নেওয়া হয়। খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ ‘য্যার’ উপত্যকা ফ্রান্সকে দিয়ে দেওয়া হয়। আরও এত এত দুষ্কর্ম করা হয় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একটি টার্ম চালু হয় ‘প্লাইটস অব জার্মানি’ তথা জার্মানির দুর্দশা।
এই অপকর্ম বিজয়ীপক্ষ প্রায় সবগুলো দেশের সাথে করেছে। তাই সকলেই বুঝতে পারছিল আরেকটি যুদ্ধ অত্যাসন্ন, কবে হবে সেটাই অপেক্ষা শুধু। এক্ষেত্রে জার্মানির ভাগ্য ভাল, মাত্র ১৪ বছরের মাথায়ই তারা হিটলারকে পেয়ে যায়।
হিটলার প্লাইটস অব জার্মানি বিমোচনের স্বপ্ন দেখিয়ে জার্মানদের বৈধ ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছিল। রাতের আঁধারে ক্যু ঘটিয়ে না। জার্মানদের মনোভাব আর ক্ষোভ বুঝার জন্য এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বমোড়লদের নির্বুদ্ধিতা, সীমাহীন জিঘাংসা আর লোভ পৃথিবীকে কী পরিমাণ ভুগিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
একই ধরনের আরেকটি চুক্তি হয়েছিল তুরস্কের সাথে। সেভার্স চুক্তি।
কিন্তু সেটি ১৯২৩ সালে বাতিল করে নতুন চুক্তি করা হয়- লুজান চুক্তি। লুজান চুক্তি ছিল তুরস্কের ‘ভার্সাই ট্রিটি’। এতে ১৪৩ টি ধারা ছিল।
এসব ধারাবলে ইয়ামেন, হেজায, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, সুদান, লিবিয়াসহ আরও বহু দেশ বানরের কলাভাগের মত বিজয়ীপক্ষ ভাগজোগ করে নেয়। যেগুলো নিজেরা নিতে পারেনি সেগুলো জার্মানির মতই আশেপাশের ছোট ছোট দেশগুলোকে দিয়ে যায়।
তারা জানত এসব দেশ সদ্যপ্রাপ্ত এসব ভূখণ্ড রক্ষা করার মুরোদও নেই, তাই ব্রিটিশ রণতরী দিয়ে এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সোজা কথায় একটা সাম্রাজ্যকে ‘দেশে’ পরিণত করা হয়। অনেকটা উর্দু প্রবাদ দরিয়া কো কোজে মে ডালনা’র মত। সাগরকে পেয়ালায় পরিণত করা।
লুজান চুক্তির দুটো ধারা থেকে বর্তমান সমস্যার সূচনা।
এক হচ্ছে সিপরাস, এই ভূখণ্ডটি খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকেই বিভিন্ন সাম্রাজ্যের হাতে হাতে ঘুরেছে। ১৫৭১ থেকে পরবর্তি ৩০০ বছর এটি ছিল উসমানি খেলাফতের অধীনে। ১৮৭৮ সালে বৃটিশরা এটি দখল করে নেয়। কিন্তু খিলাফত এই ভূখণ্ডের দাবি ত্যাগ করেনি। অবশেষে সেভার্স ও লুজান চুক্তির মাধ্যমে এখানে তুরস্কের দাবি উঠিয়ে নিতে বাধ্য করে।
উল্লেখ্য এই দ্বীপরাষ্ট্রটির ১৮% জনগণ তুর্কি সিপরিওট। ১৯৫৯ সালে এটি বৃটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে এ্যাজিয়ান আইল্যান্ডস।
ভূমধ্যসাগরের এ্যাজিয়ান সি জুড়ে আছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলোকে একত্রে ডোকেনিজ দ্বীপ বলা হয়। ১৫ টা বড় বড় দ্বীপ ও প্রায় ১৫০ টি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। বর্তমানে এটি গ্রিসের অধীনে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই দ্বীপমালার বেশকয়েকটি দ্বীপ তুরস্কের একদম নিকটে, কিন্তু গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে শত শত মাইল দূরে। বিগত এক মাস ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে ক্যাস্টেলোরিজো দ্বীপ নিয়ে। এটিও ডোকেনিজ দ্বীপমালার অন্তর্ভুক্ত, তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে ২ কিমি তথা এক মাইল দূরে, কিন্তু গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ছয়শ কিমি দূরে!
পাশাপাশি ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুযায়ি দ্বীপটি ‘ডিমিলিটারাইজড’ জোন হিশেবে থাকবে। গত সপ্তাহে গ্রিস এখানে ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ সৈন্য মোতায়েন করেছে। তুরস্কের এক সাংসদ মন্তব্য করেছেন- এক মাইল দূর থেকে কেউ তুরস্কের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখবে, আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব, তা হওয়ার নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রি থেকে শুরু করে সবাই এখন এ নিয়ে সরব।
জার্মানরা যেখানে ২০ বছরের মাথায়ই অধিকার আদায় করে নিয়েছে, তুরস্ক ১০০ বছরেও পারেনি।
সমুদ্রসীমা বন্টন আইন
জাতিসংঘের দ্য ল’ অব দ্য সি ১৯৯৪ সাল থেকে কার্যকর। এই আইন অনুযায়ী কোন দেশের উপকূলের ১২ নটিক্যাল মাইল সেই দেশের মূল ভূখণ্ড হিশেবে বিবেচিত হবে। ২০০ নটিক্ক্যাল মাইল সেই দেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন হিশেবে বিবেচিত। অর্থাৎ এই অংশের সমুদয় প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক সেই দেশ। বাকি অংশ আন্তর্জাতিক জলসীমা।
তুরস্ক এই আইন স্বাক্ষর করেনি। কারণ তার দুই কিমির ভিতরেই, নটিক্যাল মাইলে হিশেব করলে এক নটিক্যাল মাইলেরও কম, গ্রিস শাসিত দ্বীপ। এখানকার বন্টন কিভাবে হবে?
ফলে তুরস্ক কন্টিনেন্টাল শেল্ভ থিওরি ফলো করে।
কন্টিনেন্টাল শেলফ কী? একদম সহজ কথায় বললে সাগরতীরে একদম শুরু থেকেই গভীর সমুদ্র শুরু হয় না। প্রথমে অগভীর, তারপর গভীর। তো এই অগভীর অংশকে বলা হয় কন্টিনেন্টাল শেলফ। তুরস্ক এই থিওরি অনুযায়ী তাদের কন্টিনেন্টাল শেলফের অভ্যন্তরে থাকা জলসম্পদ দাবি করে থাকে।
সমুদ্রসীমা বণ্টন বিষয়ে বেশকিছু আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, একটা আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক। সাধারণত তুরস্ক যেটা ফলো করে থাকে সেটা হচ্ছে ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ নিকারাগুয়া ও কলাম্বিয়ার মাঝে দ্বন্দের রায়ে বলেছিল যেহেতু কলম্বিয়ার দ্বীপগুলো নিকারাগুয়ার কন্টিনেন্টাল শেলফের ভেতরে, তাই এসব দ্বীপগুলো আলাদা সমুদ্রসীমা দাবি করতে পারবে না।
এখানে উল্লেখ্য সিপরাস তুরস্কের কন্টিনেন্টাল শেলফে অবস্থিত, এবং সিপরাস একটি দ্বীপরাষ্ট্র। ইউরোপিয়ান দেশগুলো চাচ্ছে এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ব্যবহার করে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করতে। তুরস্ক চাচ্ছে কন্টিনেন্টাল শেলফ থিওরি অনুযায়ী সম্পদ আহরণ করতে। ফলে একই সীমানায় দুইপক্ষ দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে।
সমস্যা আরও গভীর হয়েছে সিপরাস ১৯৭৪ সাল থেকে দুইভাগে বিভক্ত। দক্ষিণাংশ গ্রিস শাসিত, উত্তরাংশ তুরস্ক শাসিত। তো ২০১৪ সালে তুরস্ক উত্তর সিপরাসের সাথে চুক্তি করে যে তারা উভয়ে কন্টিনেন্টাল শেলফ থিওরি অনুযায়ী জলজসম্পদ আহরণ করবে। এবং এই চুক্তিনামা জাতিসংঘে সাবমিট করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গতবছরের ডিসেম্বরে তুরস্ক লিবিয়ার জিএনএ সরকারের সাথে যে চুক্তি করেছে সে্টাও কন্টিনেন্টাল শেলফ থিওরির ভিত্তিতে। উভয়েই এই থিওরিতে একমত হয়েছে।
এগুলো ছিল ব্যাকগ্রাউন্ড, এই ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো জানা না থাকলে পূর্ব-ভূমধ্যসাগর ঘিরে সাম্প্রতিক যে উত্তেজনা তা বোঝা যাবে না।
বর্তমান সমস্যার সূত্রপাত ২০১৮ সাল থেকে। ইতালির একটি কোম্পানি পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে গ্যাসের সন্ধান পায়। এতে গ্যাসের পরিমাণ ৩.৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার!
এই গ্যাস উত্তোলনের জন্য ইস্ট মেডিটেরেনিয়ান (ইস্টমেড) গ্যাস ফোরাম গঠিত হয়। এতে যোগ দেয় সিপরাস, গ্রিস, ইজরায়েল, জর্দানসহ আরও কিছু দেশ। কিন্তু বাদ যায় তুরস্ক। অথচ এই অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে বড় উপকূল তুরস্কের।
সম্মিলত ফোরাম এই গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি করার জন্য পাইপলাইন নির্মান-চুক্তি করে। একে বলা হয় ইস্টমেড পাইপলাইন। মিশর গ্রিসের সাথে ইস্টমেড ফোরামে যোগ দেয়।
প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনভাবে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য তুরস্ক লিবিয়ার সাথে চুক্তি করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তারা কন্টিনেন্টাল শেলফের ভিত্তিতে যৌথ মেরিটাইম জোন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এই জোন উপরোক্ত ইস্টমেড ব্লকের জন্য গলার ফাঁস।
কারণ তাদের পাইপলাইন তুর্কি-লিবিয়া ব্লকের ভিতর আটকে যায়। এরপর এইবছরের মে মাসে ফ্রান্স এই অঞ্চলে বিমানবাহি রণতরি পাঠায় ‘তেল গ্যাস অনুসন্ধানের’ জন্য!
একটা মজার বিষয় অনেকেই মিস করে যায়।
সেটা হচ্ছে লিবিয়াতে তুরস্ক জিএনএ সরকারের সাথে। রাশিয়া হাফতারের সাথে। কিন্তু দেখা গেল জিএনএ’র সাথে চুক্তির পর রাশিয়া পুরো ভদ্র ছেলের মত সেই চুক্তি মেনে নেয় এবং লিবিয়া থেকে তাদের ভাড়াটিয়া গুণ্ডা সরিয়ে নেয়।
কেন? পুতিন এত গুডবয় হল কবে? আসল বিষয় হচ্ছে ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ইউরোপে তেল-গ্যাস রপ্তানির জন্য তুরস্কের সাথে চুক্তি করেছে। তুরস্ক হয়ে এই পাইপলাইন যাবে ইউরোপে। আবার ওদিকে গ্রিস-ফ্রান্স ভূমধ্যসাগরের গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে নিতে চাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমানো।
সোজা বাংলায় এই পাইপলাইন বাস্তবায়িত হলে সবচেয়ে বড় ধরাটা খাবে রশিয়া। ফলে তুরস্ক যদিও লিবিয়ায় রাশিয়ার প্রতিপক্ষ জিএনএ সরকারের সাথে চুক্তি করেছে। কিন্তু এর ফলে গ্রিস-ফ্রান্স-মিশরের পাইপলাইন ব্যাহত হবে, লাভ কার? রাশিয়ার।
তাই পুতিন তড়িঘড়ি করে তুরস্কের চুক্তি মেনে নিয়েছে এবং এমন ভাব করেছে যেন জিএনএ’র সাথে নয়, তুরস্ক চুক্তি করেছে রাশিয়ার মিত্র হাফতারের সাথে। জটিল রাজনৈতিক খেলা। শত্রু-মিত্রের ততোধিক জটিল অংক।
দিন দিন ভূমধ্যসাগর উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হচ্ছে, এই অঞ্চল ঘিরে রাজনৈতিক হিশেব-নিকেশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তুরস্ক চাচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। কারণ এক্ষেত্রে তার শত্রুদের দল অনেক ভারি। বাট শক্তি প্রদর্শনেও পিছপা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু ইউরোপিয়ানরা এখনো সেই আগের মত বর্গি লুটেরাদের অনুরূপ আচরণ করছে। তারা ভাবছে সেই ১৯২০ এর আইনে বুঝি ২০২০ এর পৃথিবীকেও কান ধরে ঘুরাতে পারবে।
অনেক খুঁজাখুঁজি করেছি, কিন্তু বর্তমান টেনশনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাইনি কোথাও। তাই নিজেই খেটেখুটে, ঘেটেঘুটে লেখাটা দাঁড় করালাম। ভিজ্যুয়াল ক্ল্যারিফিকেশনের জন্য এনিমেশনটা দেওয়া হল।