যারা নিরামিষাশী, তাদের প্রধানদাবি হল লাইফ উইদাউট হার্ম, লাইফ উইদাউট ডেথ। অর্থাৎ আমার জীবন কারো ক্ষতির কারণ হবে না, কারো মৃত্যুর কারণ হবে না।
অনেকেই এক্ষেত্রে শাকসবজি-গাছপালারও প্রাণ আছে, জগদিস চন্দ্র বসু, এই যুক্তিগুলো দিয়ে থাকেন। যুক্তিগুলো খুবই স্ট্রং এবং প্রাণহরণ না করার দাবি নিয়েও তারা অনবরত এসব প্রাণ মেরে চলেছে সে বিষয়ে তাদের সত্যিই কোন ভেলুয়েবল যুক্তি নেই।
কিন্তু কথা হচ্ছে যারা নিরামিষাশী, তারা যেকোনো যুক্তিতেই হোক বৃক্ষতরুলতাকে প্রাণির আওতায় ফেলে না। তাই আমি সেগুলো বলছি না। বরং এমন প্রাণি নিয়েই কথা বলি চলুন যেগুলো গাছের মত ‘জড়’ প্রাণি নয়, বরং আমাদের মতই সচল প্রাণি, পুরোদস্তুর প্রাণি।
আমরা যদি প্রাণি খাওয়া ছেড়ে দেই, তো বাঁচার উপায় হবে একমাত্র শাকসবজি, গাছপাতা, ফলমূল। তাই তো? তো আমরা যখন একটা চারা লাগাই, কী পরিমাণ প্রাণ বধ করি জানেন?
এক টেবিলচামচ পরিমাণ মাটিতে প্রাণি আছে মাত্র এক মিলিয়ন, দশ লক্ষ!! তবে তাদের কেউই বৃক্ষের মত জড় নয়, প্রত্যেকেই অজড়। কোরবানির মাধ্যমে কয় বছরে দশলক্ষ প্রাণি হত্যা করি?
এটা তো মাত্র এক চামচ মাটি। আর এক বর্গমিটার মাটিতে প্রাণির প্রজাতির সংখ্যাই এক হাজার প্লাস। বুঝতে পারছেন তো? প্রজাতিই শুধু হাজারের উপর!
তো এখানে কী কী আছে? এখানে সর্বনিম্ন আছে ১২০ মিলিয়ন নিমাটোড, বারো কোটি!! নিমাটোড কেঁচোর মত এক ধরণের প্রাণি। আছে এক লক্ষ মাইটস, এগুলো দেখতে তেলাপোকার মত। ৪৫ হাজার আছে স্প্রিংটেইল, এগুলোও ডানাওয়ালা এক ধরণের প্রাণি। বিশ হাজার কিটপতঙ্গ আর দশ হাজার মলেস্ক, শামুকের মত। এখন সব মাটিতেই সমপরিমাণ নেই, কমবেশি আছে। বাট আছে। এ তো গেল মাটি। শুধু মাটিতেই তো আর এখন চাষ হয় না, সার দিতে হয়।
নাইট্রোজেন, ফসফরাস আর পটাশিয়াম- এই তিনটিকে বলা হয় থ্রি গডেজ অব গার্ডেন তথা বাগানের তিন দেবী। কারণ এগুলো ছাড়া বৃক্ষ অচল। তো দুইভাবে এসব সার সরবরাহ করা যায়। একটা হচ্ছে অর্গানিক অন্যটা সিনথেটিক।
সোজা বাংলায় সিনথেটিক হচ্ছে আমাদের দেশে গ্যাস থেকে যেসব সার উৎপন্ন হয় সেগুলো। তেল-গ্যাস থেকে তৈরি সার। মূলত এসব সারের হাত ধরেই আধুনিক পৃথিবী কৃষিতে বিপ্লব আনতে পেরেছে। এগুলো উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়েছে প্রায় আড়াইশ গুণ!! কারণ এগুলো খুব দ্রুত কাজ করে।
আমরা যেসব খনিজ তেল-গ্যাস আহরণ করি সেগুলোকে বলা হয় জীবাশ্মা জ্বালানি। কেন? এখানে জীব এলো কোত্থেকে? এসেছে কারণ এসব খনিজ পদার্থ মূলত ‘জীবের’ অবশিষ্টাংশ। বিজ্ঞানিদের ভাষায় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বে যেসব ডাইনোসোর ছিল, তাদের মৃতদেহ মাটিতে পচে এসব গ্যাস তৈরি হয়।
ডাইনোসোর হোক বা না হোক, এগুলো বিভিন্ন প্রাণিরই মৃতদেহজাত এতে সবাই একমত।
তো দেখা যাচ্ছে ‘প্রাণি’ হত্যা এড়ানো যাচ্ছে না। তবে কথা হচ্ছে এখন আমরা ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছি। তাই এসব কৃত্রিম সার ব্যবহার কমিয়ে অর্গানিক সার ব্যবহারে ঝুঁকছি। লিয়েরে কিথ তার বইয়ের প্রথম ভাগ সাজিয়েছেন একজন ভেজিটারিয়ানের আলোচনার মধ্য দিয়ে।
সে বিশ বছর ধরে ভেজিটেরিয়ান ছিল। পরে ধীরে ধীরে মাংসভোজি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ‘তথ্য’ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। তার ভাষায় যত বেশি তথ্য আসছিল, আমার ভেজিটারিয়ান বিশ্বাস ততই ভেঙ্গে পড়ছিল।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছিল যেদিন প্রাণির দেহাংশ থেকে তৈরি বলে সিনথেটিক ফার্টিলাইজারে পরিবর্তে সে অর্গানিক ফার্টিলাইজার কিনেছিল। এর লেবেলটা পড়তে গিয়ে দেখে লেখা- ব্লাড মিল, বোন মিল, ডেড মিল!!
অর্থাৎ তার অতি সাধের অর্গানিক সারগুলো সরাসরি প্রাণির রক্ত, হাড়, ছাই, পাথর ও বিভিন্ন প্রাণির মৃতদেহ থেকে তৈরি। এটা বোকাও জানে যে পোল্ট্রির বিষ্টা, পাখনা, রক্ত আর দেহ থেকে তৈরি হয় ‘অর্গানিক’ ফার্টিলাইজার! এজন্যই ইংরেজিতে প্রবাদ আছে –মাই গার্ডেন ওয়ান্টেড টু ইট এনিম্যাল, ইভেন ইফ আই ডিডন্ট। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এসব অর্গানিক সার কোম্পানিগুলো কবুতরের পাল পালত। যেন প্রাণি আর কষ্ট করে মারতে না হয়।
আমি নিজে একটা আঙ্গুর গাছ লাগিয়েছিলাম, যার থেকে চারা এনেছি তিনি বলে দিয়েছিলেন গাছের গোড়ায় নিয়মিত চা পাতা আর মুরগির রক্ত দেওয়ার জন্য। নয়তো আঙ্গুর টক হবে। এই কারণেই বলা হয়- My tree eats animal before I ate it.
আপনি পশুপ্রেমি হয়ে গাছের দিকে ঝুঁকেছেন, বাট আপনার গাছ তো পশুপ্রেমি না, তার নিয়মিতই ‘জান’ লাগে।
মাটির টপসয়েল বলে একটা জিনিস আছে- চাষযোগ্য অংশ, উপরিভাগ। এটা ছাড়া গাছ জন্মে না। তো অতিরিক্ত চাষাবাদের ফলে এগুলো ক্ষয়ে যায়, মাটি অনুর্বর হয়ে যায়।
এছাড়াও মাটির ক্যালসিয়াম দরকার হয়। নয়তো বৃক্ষ বাড়ে না। তো ক্যালসিয়ামটা আসে কোত্থেকে? প্রাণির মৃতদেহ থেকে। সবচেয়ে বেশি আসে আপনার আমার অর্থাৎ মানুষের মৃতদেহ থেকে!! গোরস্থানের গাছগুলো কেমন নাদুস নুদুস হয় দেখেছেনই তো। নিষ্ঠুর গাছ নিরীহ মানুষকেও ছাড়ল না!!
তাই লাইফ উয়িদাউট ডেথ সাইফাই মুভিকেও হার মানানো একটা চরম মাত্রার মিথ। বাস্তবতা হচ্ছে কিয়েরে লিথের ভাষায়- For someone to live, someone else has to die.
দিস ইজ দ্য রিয়েলিটি।