ভগবদগীতায় আছে, একবার মুনি-ঋষিগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা ত্রিদেব তথা ব্রহ্মা, শিব এবং বিষ্ণু এই তিন দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট দেবতা কে হবেন, তা যাচাই করবেন। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল মহর্ষি ভৃগু’র কাঁধে। কাজ পেতেই দিলেন ছুট। প্রথম গেলেন ব্রহ্মার কাছে। গিয়েছেন ঠিক, কিন্তু, ব্রহ্মাকে কোন সম্মান করলেন না ভৃগু।সম্মান না পেয়ে অপমানবোধ করে ব্রহ্মা গেলেন ক্ষেপে। কিন্তু ভৃগুর তার ক্ষমতা দিয়ে ব্রহ্মার ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে সক্ষম হয়। এরপর ক্ষমা চেয়ে চললেন যান মহাদেব শিবের কাছে। শিবের কাছে গিয়েও একইভাবে সম্মানতো জানালেন না, উল্টো তাকে ক্রোধান্বিত করতে আজেবাজে কথা বলতে লাগলেন। হলও তাই; মহাদেব ক্রোধান্বিত হয়ে ত্রিশূল নিক্ষেপ করবেন, ঠিক সেই সময় অনেক কষ্টে পার্বতী এসে মহাদেবের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করেন। ভৃগু সেখান থেকেও নিরাপদে চলে গেলেন। এরপর ভৃগু গেলেন বিষ্ণুর কাছে। ক্ষীর সাগরে শায়িত বিষ্ণু। ব্রহ্মা এবং শিবের মত বিষ্ণুকেও ক্রোধান্বিত করতে ঘুমন্ত বিষ্ণুর বক্ষস্থলে জোরে এক পদাঘাত করে বসলেন ভৃগু। জাগ্রত হল বিষ্ণু। চোখ খুলতেই ক্রোধান্বিত হওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ, দাসের মত মহর্ষি ভৃগুর সেবা করতে লাগলেন। মহর্ষি ভৃগুর সেই চরণ হাতে তুলে নিলেন ভগবান বিষ্ণু। পদসেবা করতে করতে বললেন, “হে মহর্ষি, আমার বক্ষস্থল কঠোর- আপনার কোমল চরণ ব্যাথা তো পায় নি? সেই চরণে কোন চোট তো লাগেনি?”
হতবাক ভৃগু বিষ্ণুর বিনম্রতা ও সহিষ্ণুতা দেখে তাকে সর্বশ্রেষ্ট দেবতা হিশেবে স্বীকার করলেন (Pouranik abdhidhan: A mythological dictionary)।
সমাজে একটা বাক্য বেশ প্রচলিত, আর তা হল- ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই প্রচলিত বাক্যটা যতটা প্রচলিত, মনে হয় না ততটা আমলকৃত।কেননা, আজ বাংলাদেশে শান্তি প্রিয় মুসলিমরাই অশান্তির সবচেয়ে বড় নমুনা। তাই আজকের দিনে লিখতে এসে মনের ঘরে বসে চিন্তিত হয়ে পড়ি, নিজেকে অযথাই প্রশ্ন করি, ইসলাম কি আসলেই শান্তি ধর্ম? মলাটে বন্দি অতীতের ইসলামকে পড়লে মনে হয়, নিঃসন্দেহে ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু আজ, এই সময়ে এমন কী হল, যার ফলে ইসলামের গায়ে ‘শান্তির ধর্ম’ ট্যাগটা মানাচ্ছেনা? আমি বলছিনা যে, মুসলমনরা সবাই আজ জঙ্গী। কিন্তু প্রত্যেকের হৃদয়টা যে, একেকটা জঙ্গী ক্যাম্প হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এটা না মেনে উপায় নাই যে, মুসলমানরা আজ দল-উপদলে বিভক্ত। কিন্তু আমি বলি কী, শত না হাজার দলে বিভক্ত হলেও কীভাবে মুসলমানরা উগ্রপন্থী হতে পারে? আজ মুসলমানদের কাছে বিধর্মীরা অতটা অনিরাপদ নয়, যতটা মুসলমান নিজেরাই নিজেদের কাছে অনিরাপদ। নতুবা কোন এক মুসলমান দলের শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুর দিনকে কীভাবে কেউ উৎসবের দিন মনে করতে পারে? এটা কেবলই যে আল্লাম শফি’র বেলায় হয়েছে তা কিন্তু না। উনারটাতো ভাই স্বভাবিক মৃত্যু।
‘চ্যানেল আইয়ের’ উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে ঘরে ঢুকে পরিবার পরিজনের সামনে জবেহ করা হয়েছিল। আজ যারা আল্লামা শফির বেলায় বিরুপ মন্তব্য দেখে ব্যাথিত, তাদের অনেকেই সেদিন বলেছিল,
“বেদাতিরা এমনিতেই যাবে জাহান্নামে, এতে অত শোকের কী?”
এই যে বিপরীত মতবাদের কারো মৃত্যুতে উৎসবের মেন্টালিটি, এটা হৃদয়ে জন্মাতে থাকা জঙ্গীবাদের একটা রূপ ভিন্ন কিছু নয়। আর জনসাধারণের এই মেন্টালিটি নিশ্চয় একদিনে তৈরি হয় নি। আর সাধারণ ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পূর্ণ আলেম নির্ভর। তাহলে বলুনতো, হৃদয়ে বেঁধে ওঠা সেই জঙ্গি ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা কারা? আজ মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছেলেপেলে (মুসলমান হিশেবে যারা সবচেয়ে উত্তম) রাস্তায় নেমে জনসম্মুখে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়,
‘ধর ধর বেদাতি(মিলাদুন্নবী উদযাপনকারী) ধর, ধরে ধরে জবাই কর’।
মনে পড়ে, নুরুল ইসলাম ফারুকীকে কিন্তু কুপিইয়ে, জবাই করা হয়েছিল। অথচ, মুসলমানদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
কাফিরদের উপর কোঠোর এবং পরস্পরের মধ্যে সহানুভূতিশীল (৪৮ঃ২৯)।
এতো গেল, একই ধর্মের ভিন্নমতাদর্শীদের একে অন্যের কাছে অনিরাপদ থাকার নজির। অনেক সময় নিরাপদ থাকার জন্য মতাদর্শ একই হওয়াটাও যথেষ্ট হয় না। যেমন দেখুন, ‘আল্লামা শফি সাহেবকে হত্যা করা হয়েছিল’ এমন দাবি করে রাউজানের একদল মুসলমান মানবন্ধন ও র্যালি করে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত অনলাইনে নিউজ চ্যানেল ‘সি প্লাস’ খবরটি কাভার করে। সেই আন্দোলনে মুসলিমদের একে অন্যের জন্য ব্যবহৃত স্লোগান কি ছিল জানেন? ‘একটা একটা দালাল ধর, ধরে ধরে জবাই কর’। নাস্তিক, উগ্রহিন্দু এইসবের বিরুদ্ধে স্লোগানের কথা আজ আর নাই বলি।
আলাউদ্দিন জিহাদী সাহেবের পেইজ থেকে আল্লামা শফি সাহেবের ইন্তেকাল নিয়ে এমনই জঙ্গি ভাবাপন্ন একটা পোস্ট শেয়ার করা হয়। যার বিরোধীতায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খোদ জিহাদী সাহেবই একখানা পোস্ট দিয়ে বসেন এবং পূর্বের স্ট্যাটাসের জন্য লিখিত ও ভিডিয়ো বার্তার মাধ্যমে ক্ষমা চান। সাথে এও জানান যে, এই পোস্টটা তার এক এডমিন দিয়েছে এবং অবশ্যই সে একটা জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু, এতক্ষণে জিহাদী সাহেবের পোস্ট হয়ে যায় স্ক্রীন শট এবং এই স্ক্রিন শট বনে যায় হাজার জনের পোস্ট। ফেটে পড়ে আল্লামা শফি সাহেবের অনুসারীরা। যেটা শতভাগ যৌক্তিক ছিল। এই ক্রোধানলে দগ্ধ হওয়া জনগণ জিহাদী সাহেবের ক্ষমা চাওয়াকে কোন আমলেই নিলনা।
ক্রোধান্বিত একজন সমর্থক ক্ষমার কথা জানতে পেরে বলল, “মানুষকে হত্যা করে, সরি বললে হবে নাকি?”
বাস, হয়ে গেল কেইস। এখন জিহাদী সাহেব জেলে। পুরো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর উপলব্ধি করতে পারলাম যে, এরা সেই মুসলমান, যারা নবীযুগে থাকলে মক্কা বিজয়ের আগের রাতে আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ক্ষমা করার দায়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। সমর্থক গোষ্ঠীর কাছে জানতে চাই, ইসলাম পূর্বে আবু সুফিয়ান নবীজিকে যা কষ্ট দিয়েছে, আলাউদ্দীন জিহাদী কি তার চেয়েও জঘন্য কিছু করেছে? সেদিন আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে ক্ষমা ছিল। কিন্তু আজ আপনাদের কাছে এর কোন ক্ষমা নেই। অথচ, আপনারাও কিন্তু সেই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’রই অনুসারী।
ক্ষমা চাইতে পারাটা আপনাদের কাছে ভীষণ সহজ মনে হচ্ছে? অথচ, আল্লাহ তায়ালা’র কাছে ক্ষমা চাওয়া ব্যক্তির মর্যাদাই সবচেয়ে বেশি। তাই তো হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন-
আমি ঐ সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ। যদি তোমরা গুনাহ না করতে তবে আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে ধ্বংস করে এমন এক সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করতেন, যারা গুনাহ করে আবার ক্ষমা প্রার্থনা করে (সহিহ মুসলিম শরিফঃ ২৭৪৯)।
ক্ষমা চাইতে যেমন পরিষ্কার হৃদয়ের প্রয়োজন হয়, তেমনই ক্ষমা করার জন্য একটা উদার হৃদয় এবং সেই হৃদয়ে জমানো সৎ সাহসের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলছেন-
যে ধৈর্যধারণ করেছে এবং ক্ষমা করেছে, তবে এটা অবশ্য সৎ সাহসের কাজ(৪২ঃ৪৩)।
এ ছাড়া ক্ষমা করা আল্লাহ তায়ালা’র গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম; আল গফুর। আল্লাহ তায়ালা তো এইজন্যই বলছেন-
যদি তোমরা অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তবে জেনে রেখো আল্লাহ নিজেও ক্ষমাকারী, মহাশক্তিমান(৪ঃ১৪৯)।
পৃথিবীর যে কোন ধর্মে, যে কোন মতবাদেই সহিষ্ণুতাকে সর্বোচ্চ মর্যাদার চোখে দেখা হয়। ক্ষমাকারীকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা হয়। যেমনটা প্রথমে উল্লেখিত পৌরাণিক গল্পে দেখা যায়। ভৃগুর পদাঘাতে পালনকর্তা বিষ্ণু ভগবান হয়েও কোন ক্রোধ যে দেখাননি তার দুইটি কারণ। আর এর মধ্যে রয়েছে দুইটি শিক্ষা। প্রথম কারণ, ভৃগুতো বিষ্ণুর শত্রু ছিলেন না। বরং ঋষিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আর বিষ্ণু জানতেন, ঋষিগণ কোন দিনই দেবতাদের শত্রু না। [শিক্ষাঃ যে তোমার শত্রু না, তাকে ক্ষমা করতে শিখ। তার উদ্ভট কর্মের পেছনে যদি কোন কৌশল লুকায়িত থাকে, তাহলে তুমিই লাভবান হবে। আর, কিছু না থাকলেও ক্ষতি কোথায়?
দ্বিতীয় কারণ, ভৃগুর পদাঘাতে বিষ্ণুর কোন ক্ষতিই হয়নি তাই তিনি ক্রোধান্বিত হননি। বেশিতে ঘুম ছুটেছিল। বরং, বিষ্ণুকে অধিক জোরে আঘাত করলে, ভৃগু নিজেই ব্যাথা পেত। [শিক্ষাঃ কারো অপচেষ্টার ফলে তোমার যদি ক্ষতি না হয়, তাহলে ক্ষমা করে দাও। বরং, তোমার ক্ষতি করতে গিয়ে যদি তার নিজেরই ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করাটাও তোমার কর্তব্য।]
অনেকতো বকলাম, এখন শেষ করি। আমাদের মুসলিমদের মধ্যে হাজার দল থাকুক। লক্ষ-কোটি মতভেদ থাকুক। এগুলো যেন, আমাদের হৃদয়ে কোন জঙ্গি ক্যাম্প তৈরি করতে না পারে। আমরা এক মতবাদের সমাজ গড়তে না পারি, সহনশীলতার সমাজও কি গড়তে পারবো না? কিছুদিন আগে পাকিস্তানের করাচিত ‘আযমতে সাহাবা কনফারেন্স’ নামক সেই বিশাল জমায়েতের খবর দেখেছিলেন নিশ্চয়? সেখানে শুধু সুন্নিরা ছিল মনে করে বসে থাকলে ভুলের মধ্যে আছেন। সেইদিন করাচির সেই জনসমুদ্রে দেওবন্দি, আহলে হাদিস, ব্রেলভী সবাই একই সাথে নদীর স্রোতের মত এসে জমা হয়েছিল। একটু দূরে দূরে প্রত্যেকের আলাদা স্টেইজ ছিল। আজকের এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের মাঝেও এই সহনশীলতা প্রয়োজন। আজ জিহাদী সাহেবের জেলে যাওয়া দেখে অনেকেই খুশি, আনন্দিত আর স্বাবাভিকভাবে আমরা রাগান্বিত, ব্যাথিত। আল্লাহ না করুক, কিছুদিন পর কওমিদের কোন বড় আলেম জেলে গেলে আমাদের কেউ এমন করে খুশি উদযাপন করবেনা তার গ্যারেন্টি কী? যারা ধর্মকে বাচবিচার ছাড়াই আঘাত করে দিন শেষে তারাই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। আর আমরা অজান্তেই তাদের ভৃত্য হয়ে, তাদের কাজ করছি। আমরাই প্রমাণ করছি, ইসলামতো শান্তির ধর্মই না। অথচ বিনা পয়সার এই গোলামী সম্বন্ধে আমাদের কোন মাথা ব্যাথাই নেই।
“কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয় লাভ করাতে বীরত্ব নেই। বরঞ্চ, ক্রোধ ও রাগের মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের পরিচয়।”
এই চমৎকার উক্তিটা আমার না, যাঁর শিক্ষাকে মান্য করায় আমরা মুসলমান বা শান্তি কামনাকারী হিশেবে দাবি করছি, সেই হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অমূল্য উক্তি (বোখারি শরিফ, অধ্যায়ঃ আচার-ব্যবহার, হাদিস নং- ৫৫৭১, ইফা)