আয়া সোফিয়া বিতর্কের ফলে সবাই মোটামুটি জেনে গেছে ইস্তাম্বুল বিজয় করেছেন সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ, তাই শিরোনাম দেখে একটু খটকা লাগা স্বাভাবিক। প্রতিটা বিজয়ের পিছনে কিছু কুশলী থাকে, তেমনি প্রতিটা পরাজয়ের অন্তরালে থাকে কিছু কালপ্রিট, যারা সবসময় পর্দার আড়ালেই থেকে যায়।
দামেশকে জন্ম নেওয়া শামসুদ্দিন সেকালের আর দশটা ভাগ্যান্বেষী যুবকের মতই দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। অবশেষে বাবার সাথে আঙ্কারায় গিয়ে থিতু হলেন। মুসলিম খেলাফাতের অন্যতম এই প্রাণকেন্দ্রে পা রাখার কদিন বাদেই শামসুদ্দিনের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে।
তার জ্ঞানের নাম-যশ শুনে শাহযাদা মুহাম্মদের গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গায়েবি ইশারায় হোক কিংবা নিজের অন্তর্দৃষ্টিবলে, শামসুদ্দিন পিচ্চি মুহাম্মাদের মনে গেঁথে দিয়েছে যে মুহাম্মাদ (সা) যে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন ইস্তাম্বুল বিজিত হবে, সেই সেনাবাহিনি ভাগ্যবান, এর সেনাপতিও ভাগ্যবান- এই সেনাপতি তুমি। পিচ্চি মুহাম্মদ।
বারবার তিনি বলতেন এই হাদিসের ‘মিছদাক’ তথা প্রয়োগস্থল তুমি। সেই থেকে পিচ্চি শাহযাদার দিলে ইস্তাম্বুল বিজয়ের প্রতীজ্ঞা শিকড় গেড়ে বসে।
ধীরে ধীরে, দিনে দিনে তা পল্লবিত-সুশোভিত হয়। ইস্তাম্বুল অভিযানের জন্য সুলতান আড়াই-লাখের যে বিশাল বাহিনি গড়ে তুলেছেন, সেটার মনোবল চাঙ্গা করা, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করার দায়িত্বেও ছিলেন এই আকা শামসুদ্দিন।
…………
রাষ্ট্রের পাশা-উজিররা সবাই চিন্তিত, কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত বদনে বসা। যতটুকু সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে সবাই যার যার উষ্মা প্রকাশ করছে। শুধুমাত্র একজন শায়েখের কথায় গোটা সেনাবাহিনিকে এভাবে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া উচিৎ হয়নি। সেনাবাহিনি ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধসরঞ্জাম ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার উপর ভয়াবহ সংবাদ হল সুলতানের নৌ-বাহিনির ব্যারিকেড ভেঙ্গে চারটি জাহাজ ইস্তাম্বুলে পৌঁছে গেছে।
শুরু থেকে আশা ছিল ইউরোপের ক্যাথলিকরা অর্থোডক্সদের সহায়তায় আসবে না, পোপ তো একদমই না। তাই সরকারিভাবে ইউরোপ থেকে তেমন সহায়তা আসেনি। কিন্তু কিছু স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা এসেছে। এসেই সালতানাতের নৌবাহিনির অবরোধের মুখে পড়েছে। কিন্তু আজকে তারা সে অবরোধ ভেঙ্গে চারটি জাহাজ ইস্তাম্বুলের বন্দরে ভিড়াতে পেরেছে। শহরের অধিবাসিদের মনোবল উত্যুঙ্গে, সুলতানের বাহিনি হতোদ্যম।
ক্ষীণ আশার বাতিটা ক্ষীণতর হয়ে গেল।
………
উজিরদের ইচ্ছা শামসুদ্দিনকে জবাবদিহির জন্য ডাকা হোক। তার উদ্ভট কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়েই সুলতান এই আত্মঘাতী যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওলিউদ্দিন পাশাকে শায়খের নিকট পাঠালেন, সংক্ষিপ্ত জবাব নিয়ে ফিরে এলো- আল্লাহ নিশ্চয়ই বিজয়ের করুণা বর্ষণ করবেন।
ওজির-নাজির তো নয়ই, খোদ ভক্ত সুলতানও এই জবাবে তুষ্ট হতে পারেননি। ওলিউদ্দিন পাশাকে পুনরায় পাঠালেন। আকা খুব চমৎকার ‘বালিগ’ একটি চিটি লেখেছেন। (বালিগ তথা বালাগাতসম্পন্ন, আরবি ভাষায় অলংকারশাস্ত্র নামে আলাদা একটি শাস্ত্র রয়েছে, একে ইলমুল বালাগাত বলে। ছয়টি ভাষা একটু আধটু শিখেছি, কিন্তু এত স্ট্রং এবং প্রিসাইজড অলংকারশাস্ত্রের ধারণাও অন্য কোথাও পাইনি।)
চিঠিটির ভাঙ্গাচোরা অনুবাদ, “তিনি মুয়িজ, শক্তিদাতা। তিনি নাসের, সাহায্যকারী। সামান্য ক’টা যুদ্ধজাহাজ মনোবল ভেঙ্গে দিল, নিজেদেরকে পরস্পর লেলিয়ে দিল। অথচ কাফেরদের দিলে খুশি ও বিদ্রূপের বন্যা বইয়ে দিল। আল্লাহর চিরস্থায়ী নীতি হচ্ছে- বান্দার প্রচেষ্টা, ক্ষমতা আল্লাহর, সিদ্ধান্তও আল্লাহর। … আল্লাহর অনুগ্রহের নিদর্শন পরিস্ফূট হয়েছে। সুসংবাদ এত বেশি আসছে যা আগে কখনো আসেনি।”
চিঠিতে আমির-উমারা-সৈন্য সবার মন শান্ত হয়। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। সুলতান শায়খের তাবুতে যান, তাঁর হস্তচুম্বন করেন। তাবু থেকে বেরিয়ে এসে চূড়ান্ত হামলার নির্দেশ দেন।
………
সুলতানের ইচ্ছা ছিল এই হামলায় শায়খ তার পাশে থাকুক। লোক মারফত সংবাদ পাঠালেন। শায়খের উত্তর এল- ‘না’। ক্রুদ্ধ সুলতান নিজেই চলে এলেন। খাদেমরা পথ আটকে দিল, এখন বারণ। কেউই যেতে পারবে না। শায়খের নিষেধ।
এসব নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে সুলতান। খঞ্জর বের করে তাবুর পর্দা ফেঁড়ে ফেললেন। শায়খ সাজদায়, দোয়ায়। তার পাগড়িটা অগোছালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সুলতান যুদ্ধের নেতৃত্বের স্থানে ফেরত গেলেন। দেখেন ইস্তাম্বুলের বিশ্ববিখ্যাত অপরাজের প্রাচীরগাত্রে অসংখ্য ফুটো, সেসব দিয়ে বানের পানির মত সুড়সুড়িয়ে ঢুকে যাচ্ছে সালতানাতে উসমানিয়ার সৈন্যরা!
………
শায়খের কারিশমায় সুলতান এতই বিমুগ্ধ ছিল যে তিনি তাঁর সাথে ‘খালওয়াতে’ যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। খালওয়াত হচ্ছে সুফিদের বিশেষ পরিভাষা। শাব্দিক অর্থ নির্জনবাস। এতে গুরু-শিষ্য একান্তে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনায় নিমগ্ন হয়। শায়খ প্রত্যাখ্যান করলেন। সুলতান আবার অনুমতি চাইলেন, আবারো প্রত্যাখ্যান। এভাবে বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হবার পর সুলতান রেগে গেলেন।
– যে কেউ এসে একবার বললেই আপনি তাকে খালওয়াতের অনুমতি দেন, আমি এতবার বলছি তাও কেন প্রত্যাখ্যান করছেন?
: তুমি যদি খালওয়াতে যাও, মজা পেয়ে বসবে। তুমি তোমার সালতানাত ভুলে সাধনা-মগ্ন হয়ে যাবে। দেশ শাসনই তোমার ইবাদত। খালওয়াতের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘আদালাত’ বা ন্যায়-প্রতিষ্ঠা। তুমি তোমার রাজ্যে ন্যায়-প্রতিষ্ঠা করো, এটাই তোমার খালওয়াত, এটাই তোমার জালওয়াত।
……………
শায়খ আকা শামসুদ্দিন (রহ) নিজে একজন ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ঝানু কৃষিবিদ ছিলেন। ছোঁয়াচে রোগ ও বৃক্ষ-লতার রোগব্যাধি নিয়ে তার একাধিক রচনাও ছিল। সুলতানের আত্মার চিকিৎসক তো বটেই, তার শারীরিক ডাক্তারও ছিল শায়খ নিজে!
সুলতানের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতেন, তুখোড় সমরবিদও ছিলেন। দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে তিনি জাতির রাহবার ছিলেন।
প্রথম দিকে উসমানি সালতানের অভূতপূর্ব উন্নতি, অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি যার ভয়ে ইউরোপের সম্রাট-সম্রাজ্ঞীরা ঠিকমত বাচ্চা জন্ম দেওয়ারও সময় পেত না, তার মূলে ছিল সুলতানদের ধর্মীয় সচেতনতা, ইসলামের দিকনির্দেশনা।
যে জাতি স্বেচ্ছায় প্রজা হতে চায়, তারা কখনো রাজার সিংহাসন পায় না। যে জাতি সজ্ঞানে-স্ব-হাতে দাসত্বের শিকল গলায় লাগায়, সে কখনো প্রভুত্বের আসনে যেতে পারে না।
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির বিন্দু পরিমাণও পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের পরিবর্তন করে’- সূরা রা’আদ, ১১