১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায়। এমনটাই আমরা জেনে এসেছি বা বিশ্বাস করি।ইংরেজদের চলে যাবার ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের জনগণ আলাদা পতাকা বা কথিত স্বাধীন রাষ্ট্র পায়। আচ্ছা, ইংরেজরা তো যুদ্ধ করে দেশ দখল করে কলোনি গড়ে তুলেছিলো, রাইট? তাহলে ব্রিটিশরা আপাত স্বেচ্ছায় কলোনিসমূহ থেকে বাহ্যিকভাবে বিদায় নিলো কেন?
ইংরেজদের ভারতবর্ষ ছাড়ার কারণ হিসেবে অনেকে অনেক কারণ উল্লেখ করতে পারেন, বলতে পারেন অসহযোগ আন্দোলনের কথা । একধাপ এগিয়ে কেউবা বলতে পারেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের মানুষেরা ইংরেজদের সমর্থন দিয়েছিলো তাই তারা স্বাধীনতা দিয়েছে। এগুলোকে মৌলিক কারণ ধরলে প্রশ্ন এসে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থাৎ ১৯৪৫ থেকে পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ফ্রান্সসহ সারা পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্র তার কলোনিসমূহকে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়, কিন্তু তা কেন? সেটাও কি ভারতবর্ষের অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে! আসলে ইংরেজদের কলোনি ছাড়ার পেছনে এগুলো মৌলিক কারণ নয়, আসল কারণ অন্য জায়গায়।
কলোনি সমূহের স্বাধীনতার প্রকৃত কারণ জানতে হলে আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নজর দিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ছয় বছরব্যাপী সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে আমেরিকা প্রথমে অংশগ্রহণ করেনি। তারা দূর থেকে নজর রাখছিলো কিভাবে এখান থেকে নিজেদের সর্বোচ্চ স্বার্থ হাসিল করা যায়। ১৯৪১ সালে জার্মান যখন ফ্রান্স দখল করে বৃটেনের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস নিচ্ছিলো এবং জার্মানির মিত্র জাপান ব্রিটিশদের থেকে মায়ানমার দখলে নেয়, তখন কোনঠাসা ব্রিটেন যুদ্ধে সাহায্যে পেতে আমেরিকার সাথে একটি চুক্তিতে আসতে সম্মত হয়।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপের কাছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ‘বুকেপ্রিন্স অফ ওয়েলস’ নামে একটি যুদ্ধজাহাজে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের নামে কলোনি-বিরোধী ধারাসহ ৮ দফা সূত্র সম্বলিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি ‘আটলান্টিক সনদ’ (Atlantic charter 1941 ) নামে পরিচিত। এই সনদে যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সকল আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত হয়। এই চুক্তির একটি দফা ছিলো, ‘স্বনির্ভর জাতি তার জনগণের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীন সরকার গঠন করবে’ অর্থাৎ আমেরিকার সাহায্যে যুদ্ধে বিজয়ী হলে যুদ্ধেরপর কলোনিসমূহকে স্বাধীনতা দিতে হবে, কলোনিসমূহ রিপাবলিক তথা প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের অপর মিত্র, সোভিয়েত নেতা স্টালিন এবং চীনের নেতা চিয়াং কাইশেক ওই একই চুক্তির ড্রাফটে আমেরিকা ইংল্যান্ডের সাথে মিলে চার রাষ্ট্র স্বাক্ষর করে ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। এই চার রাষ্ট্রের চুক্তিটাকেই আবার জাতিসংঘ জন্মের ঘোষণা বলা হয় ।
অর্থাৎ ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও জাপানসহ সকল দেশের কলোনিসমূহ রিপাবলিক তথা প্রজাতন্ত্রে রূপ দেয়া হয়। আর সদ্য স্বাধীন হওয়া রিপাবলিক রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমেরিকা ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে জাতিসংঘ। কলোনি থেকে সদ্য প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহকে দেয়া হয় জাতিসংঘের সদস্যপদ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বছরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে বছরের অক্টোবরে ঘোষণা করা হয় জাতিসংঘ চার্টার। আর আমেরিকারসহ ২য় বিশ্বযুদ্ধের তার অপর চার মিত্র (ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন) রাষ্ট্রের কাছে রাখা হয় ভেটো প্রদানের ক্ষমতা।
ভেটো হচ্ছে এমন ক্ষমতা, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্র মিলেও যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় আর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা সম্পন্ন পাঁচটি রাষ্ট্রের যে কোন একটি রাষ্ট্র সে প্রস্তাবে অসম্মতি জানায় তা আর গৃহীত হবে না। দারুণ এক বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্র্যাটেজি! এক জাতিসংঘ বানিয়েই সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিলো আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এটাই হলো ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের চলে যাবার প্রকৃত কারণ। ব্রিটিশরা দীর্ঘ শাসন আমলেই তৈরি করেছিলো নিজেস্ব ভাবাদর্শের রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী । যাদেরকে প্রভুর সভ্যতার এনলাইটমেন্ট আলো (পড়ুন অন্ধকার) এতটাই চোখ ঝলসে দিয়েছিলো যে পশ্চিমা প্রভুদের সব কিছুই সুন্দর ও তা রক্ষা করা একান্ত দায়িত্ব মনে করেছে এই এলিট শ্রেণী নামক মানসিক দাসরা। তাদের একান্ত অনুগত সামরিক কর্মচারীদের দেয়া হয় অফিসার য্যাংক । তাদের হাতে গড়ে উঠে সদ্য প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনী, আর এদের হাতেই পড়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভার। আমেরিকায় অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অর্থনীতি হয়ে যায় পশ্চিমা নির্ভরশীল ও নিয়ন্ত্রিত। এককথায় বলতে গেলে ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য ছেড়ে স্বশরীরে চলে গেলেও প্রতিষ্ঠা করে যায় নব্য সাম্রাজ্যবাদী স্বায়ত্তশাসন ।
বিচারব্যবস্থা, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গান হয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত দাসদের নিয়ন্ত্রিত। তাই এই রিপাবলিক রাষ্ট্রগুলো কখনোই পশ্চিমা আইন-কানুন চিন্তার বাইরে পরিচালিত হতে পারেনি। রাষ্ট্রগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য গড়ে তোলা হয় নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইন। আর যারাই এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আদর্শিক সংস্কারের স্লোগান তুলে রাষ্ট্রের সিস্টেম এর ভিতরে ঢুকে সিস্টেম পরিবর্তনের সচেষ্ট হয়েছে, হয় তারা সময়ের আবর্তে আদর্শ ভুলে সম্রাজ্যবাদের ক্রিয়ানড়কে পরিণত হয়েছে নয়তোবা কারারুদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত আদর্শিক সমাজ দেখতে হলে আদর্শিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। কেননা সার্জারির রোগীকে তো আর সংস্কার-বিনির্মাণের পেরাসিটেমলে সুস্থ করা যায় না। তাই নব্য উপনিবেশবাদের চরিত্র বোঝা জরুরী, পেটি বুর্জোয়া সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সাথে তাল মিলিয়ে পরাধীনতাকেই স্বাধীনতা মনে করা আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ কিছু নয়। আর যারা মানসিক দাসত্ববরণ করে তাদের ভাগ্যাকাশে কখনো স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয় না।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন