সৈয়দ মুজতবা আলী—বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র এলাকার স্রষ্টা। তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে একমাত্র পিএইচডিখানা যিনি করেছেন তিনি থিসিসে বিসমিল্লা করেছেন এভাবে: “কবি নজরুল ইসলামের পর উভয় বঙ্গে সমান সমাদৃত লেখক নিঃসন্দেহে সৈয়দ মুজতবা আলী।”
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অধ্যাপনা করেছেন বারোদা ইউনিভার্সিটিতে; ইসলামিক স্টাডিজে কাজ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তিনিকেতনে। অর্থাৎ তাঁর শিক্ষকতা-জীবন ধর্মতত্ত্বের উপরে; কিন্তু এ ব্যাপারে ‘প্রামাণিক’ (তাঁর ভাষায়) কোনো কেতাব তিনি লিখেননি। কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন—এগুলো একত্রিত করলেই একটা ধর্মতত্ত্বের কেতাব করা সম্ভব। এ বিষয়ে তাঁর সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি: “আমার গবেষণার বিষয় ধর্ম। পড়তে গিয়ে বুঝেছি ধর্ম শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, তার চর্চাও ধর্ম, এবং সেই ধর্মপালনের মধ্য থেকেই চেনা যায় সেই ধর্মকে যা লোকসাধারণের ব্যবহারের নিয়ামক। তাই আমি শুধু কোরাণ শরীফই পড়িনি, ইসলামী দেশ—যেমন মিশর দেখেছি। তার লোকের আচার আচরণ নিষ্ঠা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। গেছি ইজরায়েলে—তাদের ধর্ম সম্বন্ধে আমি জেনেছি বিশ্ববিখ্যাত বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ‘কালে’র কাছে। তাদের আচরণ দেখেছি ইজরায়েলে। আর হিন্দুধর্ম তো এইভাবে দেখেইছি। তার নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ব্রাহ্মধর্মেরও প্রকাশ দেখেছি শান্তিনিকেতনে। খ্রীস্টধর্ম দেখেছি জার্মানিতে, ফ্রান্সে, ইতালিতে। অথচ ধর্ম সম্বন্ধে এই দৃষ্টি দিয়ে প্রামাণিক একখানা বই লিখলাম না, সারাজীবন ভাঁড়ামি করেই কাটালাম।”
পাঠক হিসেবে তাঁর ধারেকাছেও কোনো বাঙালিকে রাখা যায়? অনেকে অনেক সাহিত্য পড়েছেন, গিলেছেন; কিন্তু মুজতবা আলীর শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে, তিনি ফার্সী সাহিত্য ফার্সী ভাষায়, ফরাসি সাহিত্য ফরাসি ভাষায়, রুশ সাহিত্য রুশ ভাষায়, ইংরেজি সাহিত্য ইংরেজি ভাষায়, সংস্কৃত সাহিত্য সংস্কৃত ভাষায়—এভাবে তিনি তাবৎ দুনিয়ার সাহিত্য গিলেছেন মূল ভাষায়। এবার বলুন, পাঠক হিসেবে তাঁর ছায়া মাড়ানোর যোগ্যতা আর কোন্ বাঙালির আছে? তাঁকে (যার আছে) আমার প্রণাম।
তাঁর অন্তরঙ্গ সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন: “আলীসাহেব একসঙ্গে অন্তত পাঁচ-ছটা বই পড়তেন। প্রতিটি বইতে page mark দেওয়া থাকত। জীবনে বহু জ্ঞানীগুণীর সঙ্গ করে কৃতার্থ হয়েছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত পাঠাভ্যাস আর কখনো কারও ক্ষেত্রে দেখিনি।” গজেন্দ্রকুমার মিত্র জানাচ্ছেন: “ওঁর স্ত্রী থাকতেন রাজশাহীতে, উনি বোলপুরে। অথচ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন অপ্রীতির লেশমাত্র ছিল না। ছেলে দুটি ছিল বুকের মানিক—তা বড় ছেলে মুশারফ্ বা ফিরোজকে লেখা চিঠি থেকেই প্রমাণিত—তবু একা এখানে পড়ে থাকতেন কেন? এ প্রশ্ন স্বতঃই মনে জাগে। একদিন তা করেও ফেলেছিলাম, ‘দাদা—এমন এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা ব্যবস্থা কেন, ওখানে গিয়ে বাস করলেই তো পারেন। ওদেশের সরকার আপনাকে পেলে মাথায় করে রাখবে। চলে যান না ওখানে।’ উত্তর এল, ‘তুমি ক্ষেপেছ ব্রাদার। ওখানে বিশ্বভারতী কি ন্যাশনাল লাইব্রেরীর মতো লাইব্রেরী আছে? ওখানে এমন বই পাবো কোথায়, পড়ব কি?” অর্থাৎ, কেবল বই পড়ার জন্য স্ত্রী, পুত্রের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন সানন্দে।
১৯৬০-এ একটি পত্রে লিখেছেন: “আমি অন্তত ১২/১৪ ঘণ্টা পড়ি। ওর মত আফিং নেই।”
অন্যত্র লিখেছেন: “আমি জাগ্রত অবস্থায় কিছু একটা না পড়ে থাকতে পারিনে। জানেন মাথা থাবড়াতে ইচ্ছে করে যখন কেউ বলে, কিংবা তার মুখের ভাব থেকে বুঝতে পারি যে, সে ভাবছে, আমি পড়ে জ্ঞানসমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে ডুব দিচ্ছি। বিশ্বাস করুন, কসম খেয়ে বলছি, জ্ঞান যৎসামান্য একটু আধটু হয়তো মাঝে-সাঝে বাড়ে, আসলে কিন্তু আমি পড়ি ওটা আমার নেশা, নেশা, নেশা।”
আর সেজন্যই তিনি দীপংকর বসুকে লেখা চিঠিতে বলতে পেরেছিলেন: “আমি পৃথিবীর কোনো সাহিত্য আমার পড়া থেকে বড় একটা বাদ দিইনি।”
এমন একজন পাঠক যখন নজরুলের ছেলে কাজী সব্যসাচীর “পিছন থেকে আপনাকে বাবার মতো মনে হয়” কমপ্লিমেন্টের উত্তরে বলেন I think this is the greatest compliment I have ever received in my life, তখন একজন নজরুলপ্রেমী হিসেবে আনন্দে উৎফুল্লতায় উত্তেজিত না হয়ে উপায় থাকে না!