পবিত্র জমজম কূপের বিস্ময়কর ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য: প্রথম পর্ব
পবিত্র জমজম কূপের অনেক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে:
‘জমজম’ শব্দের অর্থ ও নামকরণের কারণ নিয়ে মতভেদ আছে। অর্থ: প্রাচুর্য, সঞ্চিত, গর্জন, অবরুদ্ধ হওয়া, শক্ত করে বাঁধা, পানির শব্দ ইত্যাদি। কেউ বলেন: মা হাজেরা চারদিকে আইল দিলে পানি অবরুদ্ধ করেন; কারো মতে, তিনি গায়েবী গর্জন শুনে কূপটির খবর পান; কেউ বলেন: তিনি ভিস্তিতে পানি সঞ্চয় করছিলেন; কারো মতে, শুরু থেকেই কূপটিতে পানির প্রাচুর্য ছিলো – যা ব্যবহারের কারণে কখনো কমেনি; কেউ বলেন: জারি হওয়ার পর পানির শব্দ হচ্ছিলো – তাই, এর নাম জমজম হয়েছে। ওয়া আল্লাহু ওয়া রাসুলুহু আ’লামু।
জমজম কূপের অনেক নাম রয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে আব্বাস আবু আব্দুল্লাহ আল-ফাকিহী (২১৭-২৭৫ হিঃ) তাঁর ‘আখবারু মক্কা ফী ক্বাদিমিত দাহর ওয়া হাদীছিহি’ কিতাবে কূপটির ৩৪টি নাম উল্লেখ করেছেন। যাহোক, এখানে ৩৬টি নাম দিলাম; যথা- বারাকাতু মুবারাকা, বার্রা, বুশরা, তুকাতাম, হারাম্মাইয়া, হাফীরাতু আব্দিল মুত্তালিব, রকদ্বাতু জিবরাঈল, আদ্দাওয়া, জমজম, সাব্বাক্ব, সালিমা, সিক্কাউল্লাহ, সিক্কাইয়াতুল হজ, সায়্যিদা, শাব্বা’য়াতুল ’ইয়ালি ওয়া শাবউহু, শারাবুল আবরার, শিফাউ সাক্বাম, সফিয়া, তাহিরা, ত্ব’য়ামু তু’য়ম, তয়্যিবা, যাহিরা, যবইয়া, ’আসিমা, ’আফিয়া, গিয়াছ, কাফিয়া, লা তানঝাফ ওয়া লা তুযাম, মাছারাতুল আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালিব, মাজলিয়াতুল বাসার, মাদ্বনূনা, মু’যাবা, মুফাদ্দা, মু’নিসা, মাইমূনা ও নাফা’য়া।
জমজম কূপের কিছু বৈশিষ্ট্য:
১। কূপটিতে ৩টি নালা রয়েছে। প্রথমটি রুকনে আসওয়াদ বরাবর, দ্বিতীয়টি আবু কুবাইশ ও সাফা পাহাড় বরাবর এবং তৃতীয়টি মারওয়া পাহাড়ের তলদেশে (আজরাকী)। প্রথমটি জান্নাতের কূপ থেকে প্রবাহিত হয়েছে (ইবনে উমর ও কুরতুবী)। একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ গোলাম কূপটিতে পড়ে গেলে, ওকে বাঁচাতে কূপের পানি সেচতে গিয়ে ঐ নালাগুলো দেখা যায় (দারে কুতনী)।
২। শেখ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ মক্কী হানাফী তাঁর আল-জাওহারু মুনাজ্জাম ফী ফাদ্বায়িলি মা’য়ি জমজমে লিখেছেন: জমজমের ফজিলত বায়তুল্লাহ শরীফের কারণে নয়, বরং নিজের উৎসের কারণে। ওখানে আরো কূপ থাকলেও তা জমজমের সমকক্ষ হতো না।
৩। দাহহাক বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত জমজম বহাল থাকবে। কিয়ামতের আগে কূপটির পানির উৎস বন্ধ হয়ে তা বিলীন হয়ে যাবে (আজরাকী)।
৪। ইমাম মালিক ও শাফেয়ীর মতে, কূপটি মসজিদুল হারামের অংশ নয়। কিন্তু ইমামে আযম আবূ হানীফার মতে, কূপটি মসজিদের অংশ। রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম।
৫। সম্প্রতি ২৪ জন ডুবুরী কূপটি সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছে মর্মে একটি ভিডিও ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে। ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন………
আবে জমজমের কিছু ফজিলত:
০১। মা হাজেরা (’আলাইহাস সালাম) আবে জমজম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্তন দুধে ভরে গিয়েছিলো (মুহাম্মাদ তাহির আল-কুর্দীর ‘আত-তারীখুল কাবীম লি-মাক্কাতা ওয়া বায়তিল্লাহিল কারীম’)!
০২। হযরত মূসাসহ ইবনে আব্বাসের মতে, ৭০ আর তাঁর ছাত্র মুজাহিদের মতে, ৭৫ জন নবী-রাসুল (’আলাইহিমুস সালাম) কা’বা-চত্বরে তাশরীফ এনেছিলেন। সুতরাং খুব সম্ভব তাঁরা আবে জমজম খেয়ে থাকবেন (আত-তারীখুল কাবীম)।
০৩। নবীজীর (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) ৪ বার সিনা চাক হয়। আর প্রতিবারই তাঁর কলব মুবারক আবে জমজম দিয়ে ধোয়া হয় (আজরাকী ও আত-তারীখুল কাবীম)।
০৪। মহানবী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) সুহাইল ইবনে আমরকে আবে জমজম উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন (আজরাকী)! এই সুহাইল ইবনে আমর ছিলেন মক্কার স্পষ্টবাদী, ধুরন্ধর ও প্রধানতম কুরাইশ নেতা। নবীজী তায়েফ থেকে ফিরে এলে, যারা তাঁকে নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করে, উনি ছিলেন তাদের অন্যতম। হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে প্রথমে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ লিখা হলে, উনি আপত্তি করে বলেছিলেন: রহমানুর রাহীমকে আমি চিনি না, বরং এর বদলে বিসমিকা আল্লাহুম্মা লিখো। নবীজী তা মেনে নেন। এরপর “মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’র তরফ থেকে” লেখা হলে, উনি আবার আপত্তি করে নবীজীর উদ্দেশে বলেন: তোমায় আল্লাহ’র রাসুল বলে মেনে নিলে তো আর আমরা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবো না। কাজেই, এর বদলে ‘মুহাম্মাদ ইবনে আব্দিল্লাহ’ লিখো। বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সুহাইলকে গ্রেপ্তার করলে, হযরত্ উমর (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নবীজীকে বলেছিলেন: “হে আল্লাহ’র রাসুল, আমায় অনুমতি দিন। আমি সুহাইলের মাঝের দু’ দাঁত ছিদ্র করে ফেলবো যেনো আজকের পর থেকে সে আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং কথা বলতে না পারে!” জবাবে রহমাতুল্লিল আলামীন বলেছিলেন: “অবশ্যই না উমর! আমি কাউকে ছেদন করবো না। নইলে, আল্লাহও আমায় ছেদন করতে পারেন; যদিও আমি একজন নবী।” এরপর তিনি উমরকে আরো কাছে ডেকে বললেন: “খুব সম্ভব সুহাইল ভবিষ্যতে এমন কিছু করবে, যা তোমায় খুশি করবে!” নবীজীর ওফাতের পর, সুহাইল ইসলাম গ্রহণ করেন; যদিও তার এক ছেলে হযরত আবু জান্দাল প্রথম দিকে এবং আরেক ছেলে আব্দুল্লাহ জঙ্গে বদরের আগেই মুসলিম এবং নবীজীর অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সাহাবী হয়েছিলেন। খলীফা উমরের আমলে ১৫ হিজরীর রজব মাসে বায়জানটাইন, গাসানিদ ও তানুকিদদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় সংঘটিত ইয়ারমুকের যুদ্ধে সুহাইল মুসলিম বাহিনীতে অংশ নিলে ফারূকে আযম তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। যারা মাতৃভূমি মক্কাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন – সুহাইল ছিলেন তাদেরই একজন। কিন্তু ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হলে, সুহাইল এই বলে তাঁর মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন: আমি আল্লাহ’র রাসুলকে (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) বলতে শুনেছি: ‘“তোমাদের কেউ এক ঘণ্টার জন্যে আল্লাহ’র পথে বের হলে, তা তার সারাজীবন মাতৃভূমিতে কাটানোর চেয়ে শ্রেয়।” আল্লাহ’র কসম! আমি আমৃত্যু আল্লাহ’র পথে থাকবো। তাই, আমি আর কখনো মক্কায় ফিরে যাবো না।’ ১৮ হিজরীতে সুহাইল জেরুজালেমের কাছাকাছি ফিলিস্তিনের আমাওয়াস গ্রামে ইন্তেকাল করেন।
০৫। আবু জ্বর গিফারী (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) নবীজীর (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) সঙ্গে দেখা করতে এলে, কুরাইশদের ঢিল ও হাড়ের আঘাতে তিনি রক্তাক্ত ও বেহুঁশ হয়ে যান। সজাগ হয়ে তিনি জমজম কূপের কাছে এসে তাঁর রক্ত ধুয়ে ফেলেন এবং সেখানে ত্রিশ দিন পর্যন্ত শুধু আবে জমজম খেয়ে কাটিয়েছিলেন (মুসলিম, ‘ফাজাইলে আবু জ্বর’ অনুচ্ছেদ)!
০৬। মহানবী (সল্লাল্লাহুতা’রা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: দুনিয়ার বুকে সেরা পানি হচ্ছে, আবে জমজম। এতে সুস্বাদু খাবার ও আরোগ্য রয়েছে। আর দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পানি হলো, হাদ্ব্রামাউতের (ইয়েমেনের একটি জায়গার) বারাহূত উপত্যকার পানি। এটা টিড্ডির পা’র মতো। এতে সকালে কিছুটা বেগ থাকে; আর সন্ধ্যায় কোনো আর্দ্রতা থাকে না (বাঝঝার, তাবারানী ও ইবনে হিব্বান)। তবে নানা সফরে বা যুদ্ধে বহুবার নবীজীর আঙুল মুবারক হতে যে পানির ফোয়ারা বের হয়েছিলো, ঐ পানির পবিত্রতা আবে জমজমের চেয়েও বেশি বলে বর্ণিত আছে!
০৭। নবীজী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) আরো ফরমান: আবে জমজম যে উদ্দেশে খাওয়া হয়, তা পুরো হয়। তুমি আরোগ্যের জন্যে খেলে, আল্লাহ্ তোমায় শেফা দান করবেন; খিদে মেটাতে খেলে, আল্লাহ্ তোমায় তুষ্ট করবেন; তৃষ্ণা মেটাতে খেলে, আল্লাহ্ তোমায় তৃপ্ত করবেন; কোনো ক্ষতি থেকে বাঁচতে খেলে, আল্লাহ্ তোমায় রক্ষা করবেন। এটি জিবরাঈলের (’আলাইহিসস সালাম) পদাঘাতে সৃষ্ট ফোয়ারা এবং আল্লাহ’র তরফ থেকে ইসমাঈলের (’আলাইহিসস সালাম) জন্যে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা (দারে কুতনী ও হাকিম)।
০৮। রাসুলে করীম (সল্লাল্লাহুতা’রা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবে জমজম দাঁড়িয়ে খেতেন (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, ইবনে মাজা ও তাহাবী)।
০৯। হযরত উমর (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) আবে জমজম খাওয়ার সময়ে বলতেন: হে আল্লাহ্, আমি রোজ হাশরের তৃষ্ণা মেটাতে এটি খাচ্ছি (নাশরুল আ’স ও আল-জাওয়াহিরু মুনাজ্জাম)।
১০। ইবনে আব্বাস (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বলেন: আমরা আবে জমজমকে খিদে নিবারক বলতাম এবং পরিজনদের জন্যে উত্তম সহায়ক ভাবতাম (তাবারানী)। তিনি আবে জমজম খাওয়ার সময়ে বলতেন: হে আল্লাহ্, আমি তোমার কাছে সুশিক্ষা, অফুরন্ত জীবিকা ও সকল রোগ থেকে শেফা প্রার্থনা করছি (হাকিম)।
১১। ইমাম আবু হানীফা (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) আবে জমজম খাওয়ার সময়ে দোয়া করেছিলেন: ‘হে আল্লাহ্, তুমি আমায় সেরা আলেম বানিয়ে দাও’। তাঁর এ দোয়া কবুল হয়েছিলো এবং তিনি দুনিয়ায় ‘ইমামে আযম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন (শেখ গাসসানুল ওয়াইজ আর-রূমির ‘কুররাতুল আইন’)।
১২। ক্বিরাত শাস্ত্রের ১৪ রাবীর অন্যতম আল্লামা আবু বকর ইবনে আইয়াশ (ওফাত ১৯৩ হিঃ) বলেন: আমি আবে জমজম থেকে দুধ ও মধু খেয়েছি (ফাকিহীর ‘আখবারু মক্কা’ ও যাহাবীর ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’)।
১৩। আব্দুল্লাহ নামে এক হিরাতবাসী বর্ণনা করেন: আমি কোনো এক সেহরীর সময়ে জমজম কূপের কাছে এসে দেখলাম যে, একজন শাইখ হাজরে আসওয়াদের দিকে জমজম কূপে একটি পাত্র ফেলে পানি তুলে খাচ্ছেন। তিনি পাত্রটি রেখে দেয়ার পর, আমি বাকি পানিটুকু খেতে পাত্রটি নিলাম। দেখি, তাতে কাজুবাদামের ছাতু পয়দা হয়ে বের হয়ে এলো! এমন সুস্বাদু ছাতু আমি আর কখনো খাইনি! পরের রাতে তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে আমি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একজন শাইখ এলেন। তিনি কাপড় দিয়ে তাঁর মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। তিনি হাজরে আসওয়াদের দিকে পাত্রটি দিয়ে আবে জমজম তুলে খেলেন। পাত্রটি রেখে দেয়ার পর, আমি বাকি পানিটুকু খেতে পাত্রটি নিয়ে দেখলাম, তাতে মধু রয়েছে! এমন সুন্দর পানীয় আমি জীবনেও খাইনি! তৃতীয় রাতে জমজমের দরজায় আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে এলেন। এবারও তাঁর মুখ ঢাকা ছিলো। আমি তাঁর পোশাক ধরে রাখলাম। তিনি যখন আবে জমজম খেয়ে পাত্রটি রাখলেন, আমি তা নিয়ে তাতে মিষ্টি দুধ পেলাম! আমি কখনো এমন দুধ দেখিনি। আমি তাঁর পোশাক ধরে বললাম: কা’বার প্রভুর শপথ! বলুন, আপনি কে? তিনি বললেন: আমি তোমায় এক শর্তে বলতে পারি। আর তা হলো, আমি বেঁচে থাকতে তুমি তা গোপন রাখবে। আমি বললাম: আচ্ছা, আমি কাউকে বলবো না। তিনি বললেন: আমি সুফিয়ান ইবনে সা’দ সওরী, অর্থাৎ বিখ্যাত মুজতাহিদ সুফিয়ান সওরী (হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৭ম খণ্ড)!
১৪। ইমাম হুমাইদী (ওফাত ২১৭ হিঃ) বর্ণনা করেন যে, একদিন আমরা সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার (১০৭-১৯৮ হিঃ) সঙ্গে বসেছিলাম। তিনি এ হাদীছ বর্ণনা করলেন: ‘আবে জমজম যে উদ্দেশে খাওয়া হয়, তা পুরো হয়।’ তখন একটি লোক উঠে চলে গেলো! কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো: আপনার বর্ণিত হাদীছটি কি সঠিক নয়? তিনি বললেন: হাদীছটি সঠিক। লোকটি বললো: আমি উঠে গিয়ে এ উদ্দেশে আবে জমজম খেলাম যেনো আপনি আমার কাছে একশ’টি হাদীছ বর্ণনা করেন! শুনে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা তাকে বললেন: বসুন। আর তক্ষুনি তিনি তাকে একশ’টি হাদীছ শুনিয়ে দিলেন (আবু বকর আদ-দিনওয়ারীর ‘আল-মুজালাসাহ ওয়া জাওয়াহিরুল ইলমি’ এবং ইবনে হাজার আসকালানীর জুঝু ফী হাদীছি মায়ি জমজম)!
১৫। সুয়া’ঈদ ইবনে সায়িদ বর্ণনা করেন: আমি দেখলাম যে, ইবনে মুবারক জমজমের কাছে গিয়ে ফরিয়াদ করছেন: হে আল্লাহ্, ইবনুল মু’মাল আমার কাছে এবং আবু আঝ-ঝুবাইর তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন যে, জাবির (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বলেন: আল্লাহ’র রাসুল (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: হে আল্লাহ্, আমি রোজ হাশরে নিরাপদ থাকতে এটি (আবে জমজম) খাচ্ছি (ফাওয়ায়িদু আবি বকর ইবনিল মুকরী)।
১৬। ইবনে হাজার বলেন; ইমাম শাফেয়ী (’আলাইহির রহমাহ) বলেন: আমি ৩টি নিয়তে আবে জমজম খেয়েছিলাম: প্রথমত, ধনুর্বিদ্যা শিখতে। আর এতে আমি ১০টিতে ১০টিই কিংবা ১০টিতে ৯টি লক্ষ্যভেদ করতে পারি। দ্বিতীয়ত, এলেম হাসিল করতে। আর তোমরা দেখতেই পাচ্ছো যে, আমি কেমন (আলেম)। তৃতীয়ত, জান্নাতে যেতে। আর আমি তাতে যাওয়ার আশা রাখি (ইবনে জাহিরার ‘আল-জাওয়াহিরুল মাকনূনা’)।
১৭। হাফিয ইবনে খুঝাইমাকে (২২৩-৩১১ হিঃ) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো: আপনি এতো এলেম কোথা থেকে আহরণ করলেন? তিনি বলেছিলেন: আল্লাহ’র রাসুল (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: ‘আবে জমজম যে উদ্দেশে খাওয়া হয়, তা পুরো হয়।’ তাই, আমি তখন (আবে জমজম খাওয়ার সময়ে) নিয়ত করেছিলাম: হে আল্লাহ্, আমায় সুশিক্ষা দিয়ে মেহেরবানী করো (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা)।
১৮। মুস্তাদরাক ’আলা সহীহাঈনের লেখক ইমাম হাকিম (৩২১-৪০৫ হিঃ) সেরা লেখক হওয়ার নিয়তে আবে জমজম খেয়েছিলেন। ফলে, তিনি তাঁর যুগের সেরা লেখক হয়েছিলেন। ইবনে খাল্লিকান (৬০৮-৬৮১ হিঃ) তাঁর তারিখে লিখেছেন: হাকিম প্রায় দেড় হাজারের মতো কিতাব লিখেছেন!
১৯। খতিব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) হজ করতে গিয়ে তিনবার আবে জমজম খেয়েছিলেন। আল্লাহুতা’লার কাছে তিনি প্রথমবার দোয়া করেছিলেন যেনো বাগদাদের ইতিহাস লিখে যেতে পারেন; দ্বিতীয়বার দোয়া করেছিলেন যেনো জামিউল মানসুরে তিনি হাদীছ সংকলন করতে পারেন এবং তৃতীয়বার দোয়া করেছিলেন যেনো হযরত বিশর হাফীর (কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ; ১৫০-২৩৫ হিঃ) পাশে তাঁর কবর হয়। আল্লাহপাক তাঁর তিনটি দোয়াই কবুল করেন (ইবনে আসাকীর ‘তারিখে দেমাস্ক’, যাহাবীর ‘তাজকিরাতুল হুফফায’ ও শাওকানীর ‘আল-জাওহারুল মাকনূনা’)।
২০। শেখুল আকবার মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী (’আলাইহির রহমাহ; ৫৬০-৬৩৮ হিঃ) বলেন: আমি ৪৮৯ হিজরীর যিলহজে মক্কা শরীফে ছিলাম। তখন আল্লাহ্ এলেমের কুদরত আমার জন্যে উন্মুক্ত ও সহজ করে না দেয়া পর্যন্ত প্রতিবারই আমি মজবুত এলেম ও ঈমান হাসিলের লক্ষ্যে প্রচুর আবে জমজম খেয়েছি। যাহোক, এক পর্যায়ে আমি এটি খাওয়ার ফজিলতের কথা ভুলে যাই; যদিও শুধু ঐ দু’ কারণে (মজবুত এলেম ও ঈমান হাসিল করতে) এটি খেতাম। এতেই আল্লাহ্ আমার জন্যে ঈমান ও এলেমের দরজা খুলে দিয়েছিলেন এবং এতে তিনি কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করেননি। আর আমার জ্ঞানুরাগ এর কার্যকারিতার চেয়ে বেশি হয়েছিলো। তদুপরি, আমরা আল্লাহ’র মেহেরবানীর খাতিরে নিরাপত্তা ও কামিয়াবী প্রার্থনা করি (আহকামুল কুরআন)।
২১। আল্লামা জাঝারীর (’আলাইহির রহমাহ; ৭৫১-৮৩৩ হিঃ) বাবাও একজন বিখ্যাত আলেম ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ৪০ বছর পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। ইমাম জাঝারী তাঁর জামিউল আসানিদে তাঁর শিক্ষকবৃন্দের নাম লিখতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর বাবাকে রেখেছেন। তাতে তিনি বলেন: বাবা আমায় বলেছেন: ‘আমি হজে গিয়ে এ নিয়তে আবে জমজম খেলাম যেনো আল্লাহ্ আমায় একটি কুরআনী আলেম সন্তান দান করেন। এরপর ৭৫০ হিজরীতে আমি তোমার মাকে বিয়ে করি এবং পরের বছর ২৫শে রমজান তুমি জন্মগ্রহণ করো।’ উল্লেখ্য, ইমাম জাঝারী দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে বড়, নির্ভরযোগ্য ও বহুল পরিচিত দোয়ায় কিতাব ‘হিসনে হাসীন’ সংকলন করেন। এছাড়াও তিনি ক্বিরা’আত, হাদীছ, ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে ৯০-এর বেশি কিতাব লিখেছেন।
২২। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন: আমি হাদীছ শেখার শুরুতে (ছাত্র-জীবনে) কোনো এক অনুষ্ঠানে আবে জমজম খাওয়ার সময় দোয়া করেছিলাম: হে আল্লাহ্, তুমি মেহেরবানী করে হাদীছ মনে রাখার ব্যাপারে আমায় যাহাবীর সমকক্ষ করে দাও। প্রায় ২০ বছর পর, আমি হজ করতে গিয়ে নিজেকে তাঁর (যাহাবীর) চেয়েও বড় আলেম হিসেবে পেলাম – যা আমি আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করেছিলাম (জুঝু ফী হাদীছ মায়ি জমজম)। তাঁর ছাত্র হাফেয সাখাভীও (৮৩১-৯০২ হিঃ) বলেন: আল্লাহুতা’লা তাঁর ঐ ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন এবং এর সাক্ষ্যও রয়েছে (আল-জাওয়াহিরুল দুরার ফী তরজমাতি শাইখিল ইসলাম ইবনে হাজার)।
২৩। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হিঃ) বলেন: আমি হজ করতে গিয়ে কয়েকটি ব্যাপারে আবে জমজম খেয়েছিলাম। এগুলো ছিলো: আমি যেনো ফিকাহ শাস্ত্রে শিরাজুদ্দীন বুলকানী এবং হাদীছ শাস্ত্রে হাফেয ইবনে হাজারের সমকক্ষ হতে পারি (হুসনুল মুহাদারা)। সুয়ূতীর ছাত্র শামসুদ্দীন মুহম্মদ বিন আলী আদ-দাউদী আল-মালিকী বলেন: যার হাতে আমার জান, তাঁর শপথ! আমি যা বিশ্বাস করি এবং আল্লাহ’র রহমত (সুয়ূতী সাবের সোহবত) আমার প্রতি বর্ষিত হয়েছে, তিনি (সুয়ূতী) এলেমের এমন স্তরে পৌঁছেছিলেন যে, তাঁর কোনো শিক্ষকও ঐ স্তরে পৌঁছতে পারেননি। আর তাঁদের ছাত্রদের কথা নাইবা বললাম (আল-জাওয়াহিরুল মুনাজ্জাম)।
মহান আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে আবে জমজম খাওয়ার এবং এর সকল বরকত পাওয়ার তওফিক দান করুক। আমিন। ধন্যবাদ।
সূত্র: ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, বুখারী, ইমাম আজরাকীর (ওফাত ২২২ হিজরী) আখবারু মক্কা ওয়া মা জায়া ফীহা মিনাল আছার, মাদারিজুন নবুয়ত, সীরাত বিশ্বকোষ ইত্যাদি।
Feature Image Soure: english.alarabiya.net
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন