বাংলাদেশ আর ১৯৭১! প্রথম শব্দটি ৫ বর্ণের, দ্বিতীয় সংখ্যাটি ৪ অঙ্কের। ভাষা বা সংখ্যাগত কোনো মিল নেই। মিল নেই ছন্দেও। কিন্তু একটির সাথে অপরটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। একটি যেন অন্যটির পরিপূরক। এদেশে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য মর্মস্পর্শী, বেদনাদায়ক ঘটনা রচিত হয়েছে। তেমনই একটা ঘটনা হচ্ছে— শহিদ আজাদ ও তার মায়ের ঘটনা।
মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই। তার বাবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইউনুস আহমেদ চৌধুরী এবং মা মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগম। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শৈশব কেটেছে নিউ ইস্কাটনের সুরম্য বাড়িতে।
ভীষণ বড়লোকের ছেলে। ঝাঁ-চকচকে পোষাক-আশাক আর দামী গাড়ি করে স্কুলে আসে। বিটলস্, রোলিং স্টোনস্, ডুরস্ আর বব ডিলানের গান শোনে হরদম। সেই ১৯৬৯-৭০ সালে গীতাঞ্জলী থেকে একবারে ১২০০ টাকার গ্রামোফোন রেকর্ড কিনে ফেলার মতো শৌখিন বড়লোক! ধনীর ঘরের দুলাল আরকি।
আজাদ সবসময়েই ছিলেন স্বাধীনচেতা তরুণ। দুরন্ত, গানপাগল, সিনেমা-অন্তঃপ্রাণ আর বইপড়ুয়া হিসেবেই আজাদ পরিচিত ছিল সবার কাছে। তবে পড়ালেখায় খুব বেশি মনোযোগী ছিলেন না। এস.এস.সি’তে সেকেন্ড ডিভিশন নিয়ে পাশ করেন। তারপরে পড়তে যান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখান থেকেই স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপরে ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এম.এ. পাশ করেন।
১৯৭১ সাল, মার্চ মাস, স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে আজাদের মনও চাইছে যুদ্ধে যেতে। বারবার এ কথা মাকে বলতে চাইতেন তিনি, কিন্তু পারতেন না। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে প্রচণ্ডভাবে জর্জরিত হতেন। তাই একদিন বলেই ফেললেন মাকে। মা কী যেন চিন্তা করলেন।
অবশেষে বললেন— ‘আমি কী তোকে শুধু আমার জন্যই মানুষ করেছি। এদেশটাও তোর মা। যা দেশটাকে স্বাধীন করে আয়।’ মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আজাদ গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। শুরু হলো আজাদের নতুন আরেক জীবনযুদ্ধ।
ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন আজাদ। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ২নং সেক্টরের বিখ্যাত আরবান গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন এর সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ এ কি করেছিলো ঢাকা শহরে এই ক্র্যাক বয়েজ? শুধু একটি নমুনা দিবো এখানে—
‘দিজ অল আর ক্র্যাক বয়েজ! ওদের বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা কি-না ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে! ক্র্যাক! মাই ক্র্যাক বয়েজ।’ —অবাক বিস্ময়ে ১৯৭১ সালের ৯ জুন সন্ধ্যায় বিবিসিতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলার খবর শুনে কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ।
তৎকালীন মু্ক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুর্ধর্ষ গেরিলা ফ্রন্ট, তরুণ ক্রাক বয়েজদের প্রতি যাঁর নির্দেশনা ছিলো কেবল ঢাকা শহরের আশেপাশে কিছু গুলি ছুঁড়তে হবে ও গ্রেনেড চার্জ করতে হবে, পুরো বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে হবে— হ্যাঁ! ঢাকাও মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত!
১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই পাকহানাদার বাহিনী পুরো ঢাকা শহরে নিরাপত্তার বলয় তৈরি করেছিলো, এর মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (পরবর্তীতে শেরাটন/ রূপসী বাংলা) ছিলো সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত। এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন দেশী বিদেশী কূটনীতিকরা। পাক বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিলো ঢাকা শহরকে মুক্তিবাহিনী মুক্ত রাখা, ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর যে কোনো আক্রমণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিহত করা, যাতে বহির্বিশ্ব কোনো ভাবেই আঁচ করতে না পারে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা। কিন্তু পাক বাহিনী পারেনি সেটা এই আজাদদের কারনে।
আজাদ ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের আরও কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ পাকহানাদারদের হাতে ধরা পড়েন নিজ বাসভবনে। তাকে ধরে নিয়ে রাখা হলো নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখান থেকে রমনা থানায়।
এরপর ছেলের সাথে দেখা করার জন্য রমনা থানায় ছুটে গিয়েছিলেন আজাদের মা। মাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আজাদ। মা জানতে চাইলেন— ‘কেমন আছো?’ আজাদ মাকে বলেছিলো— ‘এরা খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি।’
হানাদাররা তথ্য জানার জন্য অকথ্য নির্যাতন করত। নির্মম অত্যাচারের মুখেও আজাদ কিন্তু কিছু বলেননি। যখন তার মাকে বলা হয়, ছেলে যদি সবার নাম-পরিচয় বলে দেয়, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা শুনে আজাদের মা ছুটে গিয়েছিলেন আজাদের কাছে। না, ছেলেকে মুক্ত করার জন্য নয়, বরং তিনি আজাদকে বলেছিলেন— ‘বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম যেন বলে দিও না।’
আজাদ তাকে কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন জেলের দুর্বিষহ জীবনের কথা, প্রচণ্ড নির্যাতনের কথা। কিন্তু কারো নাম মুখে আনেননি।
আজাদ আরও বলেছিলেন—
‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।’ আজাদের মা তাকে অভয় ও সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন— ‘কালকে আমি ভাত নিয়ে আসবো।’
পরের দিন মা ভাত নিয়ে যান থানায়। গিয়ে দেখেন ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনদিনও ফিরে আসেনি। ধরে নেওয়া হয়, সেদিনই ঘাতকরা মেরে ফেলেছিলো আজাদকে।
ছেলে একবেলা ভাত খেতে চেয়েছিলেন, মা পারেননি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে। সেই কষ্ট, ইন্দ্রিয়ের সেই যাতনায় সেদিনের পর থেকে যতোকাল বেঁচে ছিলেন, সেই পুরো ১৪টি বছর মুখে একটা ভাতও তুলে নেননি মা সাফিয়া বেগম। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন ১৪ টা বছর ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। বিশ্বাস ছিলো তাঁর আজাদ ফিরবে।
ছেলের অপেক্ষায় শুধু ভাতই নয়, ১৪ বছর তিনি বিছানায়ও শোননি। মেঝেতে শুয়েছেন, শীত-গ্রীষ্ম কোনো কিছুতেই তিনি পাল্টাননি তার এই পাষাণ-শয্যা। হাপাঁনী থাকা সত্ত্বেও শোতেন মাটিতে, মাদুর বিছিয়ে।
এর মূল কারণ ছিলো, তাঁর আজাদ রমনা থানায় আটক থাকাকালে মাদুরে শুতেন। রুপকথার মতো এই বাস্তবতা নিয়ে পরে বরেণ্য লেখক আনিসুল হক তার বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাস রচনা করেন।
১৯৮৫ সালের ৩০ শে আগস্ট, মারা যাওয়ার আগেই আজাদের মা বলে গিয়েছিলেন তার কবরের ফলকে পরিচয় হিসেবে লিখতে ‘শহীদ আজাদের মা’। তাই আজও জুরাইনে একটি কবর দেখা যায়। যাতে লেখা ‘মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা’।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন