আগের পর্ব: অলক্ষে থাকা মর্দে মুজাহিদ বারকে খান
দুর্ধর্ষ মঙ্গল সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে হয়েছিল:
শুরুতেই বলে নেই এ লেখাটি সরাসরি মঙ্গলদের পতন না, বরং প্রথমত তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের পতন ও এরই ধারাবাহিকতায় তাদের পতনের কথাগুলো বলব।
গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি ভালবাসার কারনেই কী করে বারকে খান মঙ্গল ঝড় থামাতে মঙ্গল মরণপত্রে স্বাক্ষ্যর করেছিলেন। সে মরণপত্র পাঠের পূর্বে বিশাল মঙ্গল রাষ্ট্র সমন্ধে জেনে নেয়া যাক। পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তরে সাইবেরিয়া হয়ে ওরাল সাগর হয়ে কৃষ্ণসাগর, উত্তর পশ্চিমে মস্কো, পশ্চিমে কিয়েভ, এদিকে আফগানিস্তান হয়ে, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, সেলজুক সাম্রাজ্য ও আনাতোলিয়া। এমন বিশাল সাম্রাজ্য দেখার আগেই গুরু চেঙ্গিস খানের মরণ হয়। মরার আগে ৩য় ছেলে ওগেদাইকে খাগান নির্ধারণ করে তৎকালীন মঙ্গল-রাষ্ট্র বাকি তিন ছেলে— মঙ্গোলিয়ায় তুলুই, মধ্য এশিয়ায় চাগতাই ও পশ্চিমের বাকি অংশ জসি/জচি এর মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়।
চার ভাইয়ের বংশধরেরা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং মাত্র তিনজন খাগানের পরেই মঙ্কে খান খাগান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন তুলুই বংশের। ক্ষমতায় এসে চীনে দায়িত্বে থাকা ভাই কুবলাই খানকে দেন চীনের দায়িত্ব, পারসিয়ান অঞ্চলে দায়িত্বে থাকা হালাকু খানকে দেন, সে অঞ্চলের দায়িত্ব আর গোল্ডেন হর্দেতো বাটু ও বারকে খান ছিলই। মঙ্কে খান মরার পর নতুন খাগান নির্বাচনে গত পর্বেই বলেছিলাম কুবলাই, হালাকু বারকের জন্য কত বিপদজনক ছিল তাই এবার বুদ্ধি করে তুলুইয়ের ছোট ছেলে আরিক বোকাকেও সামনে নিয়ে আসে বারকে খান।
তাহলে দেখাই যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে বারকে খান সত্যই বলেছেন মুসলিমদের রক্ষায় তাকে মঙ্গল রাষ্ট্রের চূরান্ত সর্বনাশ করতে হয়েছে। দেখুন একই পরিবারের তিনজন যখন একটি চেয়ার নিয়ে লাগে সেখানে তো পতন অনিবার্য। বারকে খানের এহেন চালে এক ধাক্কায় মঙ্গল রাষ্ট্র ৫ খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। আরিক বোকা ও কুবলাই উভয়েই নিজেকে গ্রেট খান দাবী করেন। আরিক বোকা জানতেন যদিও কারাকুরামের মঙ্গল সভা তার নিয়ন্ত্রণে কিন্তু হালাকু-কুবলাই যৌথ জোট তার জন্য মারাত্মক মাথা ব্যাথার কারন।
১২৫৯ সালে মঙ্কে মরার পর এমনিতেই খান নির্ধারণ না হওয়ায় মঙ্গল অংশগুলো খাগান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আলাদা থাকার ইচ্ছা করে। হালাকু-কুবলাই জোট ভাঙ্গতে মধ্য এশিয়ার চাগতাই খায়ানাত আলাদা করে দেয়া হয়। ফলে একিভূত বিশাল মঙ্গল রাষ্ট্র এবার আরিক, চাগতাই, কুবলাই, ইলখায়ানাত ও গোল্ডেন হর্দে বিভক্ত হয়ে যায়। আরিক বোকা আলগুকে চাগতাইয়ের গভর্নর নিয়োগ করেন। কিন্তু আলগুই আরিক বোকার সাথে বেইমানি করলে অবশেষে ১২৬৪ সালে আরিক বোকা কুবলাইয়ের কাছে পরাজিত হন।
ইলখায়ানাত (১২৫৬-১৩৩৫); Image Source: en.wikipedia.org
কুবলাই আবারো কুরুলতাইয়ের সভা আহবান করে কিন্তু হালাকু ও বারকে তখন সীমান্তে তুমুল লড়াইয়ে ব্যস্ত। আলগুও আর কুবলাইয়ের অধীনে থাকতে ইচ্ছুক নয়। তাই অবশেষে মঙ্গোলিয়া ও চীনের অংশকে একিভূত করে ১২৭১ সালে কুবলাই ইয়ান/ইয়াং রাজবংশের সূচনা করলে মঙ্গল রাষ্ট্র চার রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বারকে ও হালাকু খানের দ্বন্দ্ব যেহেতু শুধুমাত্র সীমার ভেতরেই সীমিত ছিল না, তাই তাদের যোদ্ধও চলেছে পরবর্তী ৩৫ বছর।
এই সময়ের যুদ্ধে শুধুমাত্র দুই বীর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বিষয়টি তা নয়, বরং এতে গোল্ডেন হর্দ ও ইলখায়ানাতের শক্তিও মারাত্মক কমে গিয়েছিল এবং সেন্ট্রাল কমান্ডগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলেই মানুষগুলো কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যায় কখনো ধর্মের কারণে, কখনো সিংহাসনের কারণে আবার কখনো আপন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নেশা। এ ক্ষেত যে শুধুমাত্র আমলা কামলাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল বিষয়টা তা নয় বরং বড় বড় ‘নায়ান’গণ আলাদা আলাদা অঙ্গরাজ্য তৈরীর নেশায় পরে যায়, যা মঙ্গলদের চরম আপন ও পরীক্ষিত নায়ান সুবুতাইকেও ছাড়েনি। এভাবেই ধীরে ধীরে ভিতর থেকে মঙ্গল বাহিনী দুর্বল হতে থাকে।
ইলখায়ানাত পরপর তিনবার সিরিয়ার মাটিতে পরাজিত হওয়ার পর মানুষের ভিতরের মঙ্গল ভীতি দূর হয়ে গেলে ইলখায়ানাত মারাত্মক চাপে পরে যায়। ইলখায়ানাতের প্রথম মুসলিম খান গাজান/কাজান মামলুকদের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সিরিয়ায় আসলে সে কাজের সর্বাপেক্ষা বিরোধীতা করেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। এরপরও মঙ্গল ধ্বংসলীলা থেকে সিরিয়া রক্ষা পায়নি। অপর দিকে কুবলাই ইয়ান ডাইনেস্টি গঠন করেই সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পরে মুসলিম সং ডাইনেস্টির উপর। অবশেষে মঙ্গল ধ্বংস লীলায় সংরা পরাজিত হলে কুবলাই বৃহত্তর চীন, মঙ্গোলিয়া ও কোরিয়া নিয়ে ইয়ান ডাইনেস্টি প্রতিষ্ঠা করে।
চেঙ্গিস খানের পর হালাকু ও কুবলাই খান ও তাদের বংশধরদের কাছেই সর্বাপেক্ষা মুসলিম নিধনের স্বীকার হয় ফলে পশ্চিমের ইলখায়ানাত ও পূর্বের ইয়ান উভয় মঙ্গল সাম্রাজ্যই খুব দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগোতে থাকে। ১৩৩৫ সালে আবু সাইদ ইন্তেকাল করলে ইলখায়ানাত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। অপর দিকে ইয়ান ডাইনেস্টিও অভ্যন্তরীণ কোন্দল, হান ও নন-হানদের কোন্দলে দ্রুতই পতনের দিকে এগিয়ে যায়।
অপরদিকে চাগতাই অঞ্চলে ১২৬৫ সালে মুবারক শাহ ক্ষমতায় আরোহন করেন এবং ইসলাম কবুল করে নেন। কিন্তু সুখ বেশি দিন সয়নি, গিয়াসউদ্দিন বারাক কুবলাইয়ের সহযোগিতায় মুবারক শাহকে পরাজিত করে নিজে ক্ষমতায় বসে। বারাক ইলখায়ানাতের খুরাসান দখল করে নিলে আবাকা খান তাকে পরাজিত করে খুরাসান উদ্ধার করে নেয় ১২৬৬ সালে। যুদ্ধে আহত হয়ে গিয়াস উদ্দিন বারাক বুখারায় মৃত্যু বরণ করেন এবং মৃত্যুর পূর্বে ইসলাম গ্রহন করেন। এদিকে এই নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে আবারো আলগুর সেনাপতি কাইদু ক্ষমতা দখল করে। কাইদুও পরবর্তিতে কারাকুরাম আক্রমন করতে গিয়ে কুবলাইয়ের হাতে নিহত হয়।
এদিকে মুবারকের পর প্রথমবারের মত ১৩২৬ সালে মুসলিম হিসেবে তারমাশিরিন ক্ষমতা লাভ করেন। তিনি রাজধানী আমু ও শির দরিয়ার মাঝে অবস্থিত ট্রান্সাজানিয়া থেকে মুগলিস্তানে স্থানান্তর করেন। এর মাধ্যমেই মূলত চাগতাই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ট্রান্সাজানিয়া ও মুগলিস্তান।
শক্তিশালী মঙ্গল রাষ্ট্রগুলোর এহেন ভঙ্গুর অবস্থায় আল্লাহ যেন চূড়ান্ত আঘাত হানলেন ব্লাক ড্যাথ খ্যাত প্লেগের আক্রমণ। এ আক্রমনে ইলখায়ানাত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যার ফলে ১৩৫৭ সালে গোল্ডেন হর্দের কাছে চূড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে ইতিহাস থেকে হালাকুর ইলখায়ানাত বিদায় নেয়। চীনে খরা, প্লেগ ও হানদের ক্রমাগত চাপের মুখে ইয়ান খান তোগান তিমুর টালমাতাল অবস্থায় পরে যান। ১৩৫১ সালে শুরু হয় লাল চরকার বিদ্রোহ, অনেক কষ্টে সামাল দিতে পারলেও মঙ্গল আর্মির মেরুদণ্ড আর থাকেনি ফলে ১৩৬৮ সালে মিংদের হাতে চূড়ান্ত প্যাদানী খেয়ে হালাকুর পর কুবলাই খানের মঙ্গল সাম্রাজ্যও ইতিহাসের পাতায় ঠায় নেয়।
এমনিতেই বিভক্তি তার উপর আবার প্লেগের আঘাতে চাগতাই খায়ানাত বিভক্তি হতে হতে আবারো গোত্রে গোত্রে রুপান্তরিত হয়। ট্রান্সোজানিয়ার এমনি এক তুর্কি মঙ্গল গোত্রে জন্ম নেয় তিমুর/তৈমুর। মুগলিস্তানে মঙ্গলদের আধিপত্য কিছুটা টিকে থাকলেও ট্রান্সাজানিয়া ও অপরাপর অঞ্চলগুলো হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তৈমুরের রাজবংশের মার খেতে খেতে সবশেষে ৩৫ লক্ষ্য কি.মি. এর বিশাল রাজ্য মাত্র ৭০ হাজার কি.মি.তে স্থান করে নেয় বর্তমান তুর্কিস্তান, কাসগর ও শিংকিয়াংয়ের কিছু অংশ নিয়ে তোরপান খায়ানাত যাত্রা শুরু করে ১৪৬৫ সালে আর নিঃশেষ হয় ১৭০৫ সালে।
অপর দিকে গোল্ডেন হর্দের অবস্থা প্রথম দিকে ভাল থাকলেও পরবর্তিতে আর ভাল থাকেনি। ফলে ১৩৬২ সালের ব্লু ওয়াটার যুদ্ধে গ্রেন্ড দাচি অব লিথুনিয়া কিয়েভ দখল করে নেয়। ১৩৮০ সাকে মস্কোর প্রিন্স দিমেত্রী ডিওনস্কি কালিকোভা ফিল্ডের যুদ্ধে মঙ্গলদের হারিয়ে মস্কো ও আশপাশ অঞ্চল দখল মুক্ত করে। গোল্ডেন হর্দের সর্বাপেক্ষা কঠিন সময় পার করে পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন তাদের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ফলে ১৪৪২-১৪৫৩ সালের মাঝে তারা কাজান, ক্রিমিয়া, আস্ত্রাখান, নোগাই হর্দ, শিবির খানায়েত ও কাজাখ খানায়েতে বিভক্ত হয়ে যায়।
এত বিভক্তির পর তাদের পতন রোধ করাতো সত্যিই কঠিন হবে এটাই স্বাভাবিক। ১৫১৪ সালে ৩য় ভেসিলি কাজানের কিছু অংশ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৪৬৫ সালের মাঝেই আইভান দি টেরিবলের সময়ে রাশিয়ার কাছে কাজান থেকে আস্ত্রাখান পর্যন্ত হারিয়ে বসে। ক্রিমিয়া কালক্রমে চলে যায় উসমানী সাম্রাজ্যে, আর সবশেষে সব হারিয়ে আগের সেই স্তেপ অঞ্চলেই মঙ্গলরা ফিরে গিয়ে বর্তমানে মঙ্গোলিয়ান হয়ে বসবাস করছে।
তাদের দেখে কে বলবে এরাই এক সময় পৃথিবীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কোটি কোটি মানুষকে শুধু হত্যাই করেনি বরং যুদ্ধের এমন এক স্ট্রেটিজি তৈরী করেছিল ফলে পরবর্তী শতাব্দিকাল ব্যাপী যুদ্ধ মানেই ছিল ধ্বংসের অপর নাম। আর এ সব কিছুই একজন মানুষের একটি সিদ্ধান্ত কি করে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে তলানিতে ঠেকায় তাই যেন আল্লাহ বারকে খানের মাধ্যমে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন।
Feature Image Source: en.wikipedia.org
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন