নজরুল চরিত্রের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ‘অভিমান’। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর এ অভিমানী দিকটা আমাদের নিকট স্পষ্ট। নজরুল-জীবন থেকে তাঁর অভিমানী ঘটনাগুলো তুলে দিচ্ছি।
ময়মনসিংহ: রুটির দোকান থেকে দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ নজরুলকে যখন ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন তখন নজরুল পড়েন সপ্তম শ্রেণীতে। ১৯১৪ সালে সপ্তম শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়েই ময়মনসিংহের, ত্রিশাল থেকে চলে গেলেন নজরুল। কাউকে কিছু না বলে, কোনো খবর না দিয়ে আচমকা চলে গেলেন কিশোর নজরুল! আর ফিরে যাননি সেখানে।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন: মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সওগাত বের হয়েছে ১৯১৮ সালের নভেম্বর থেকে। নজরুল ১৯১৯ সালে কিছু কিছু লেখা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু ছাপার কোনো নামগন্ধ নেই! নাসিরউদ্দীনের ভাষায়: “নজরুল প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বান্ডিল বান্ডিল লেখা পাঠাতে থাকেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, তার সেকালের প্রায় সবই ছিল আবেগ আর উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। আমি সেজন্য ছাপতে চাইনি।” শেষে বিরক্ত হয়ে নজরুল ‘কবিতা সমাধি’ নামে একটি হাস্যরসাত্মক কবিতা পাঠালেন এবং সাথে লিখে দিলেন: “আর আমি কবিতা পাঠাবো না।” ঠিকই, করাচি থেকে সওগাতের জন্য আর তিনি কবিতা পাঠাননি। এরপর যা লিখেছেন সব সরাসরি।
গ্রামের বাড়ি এবং মা: ১৯২০ সালে পল্টন থেকে কলকাতায় এসে কিছুদিন পর নজরুল গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় গেলেন। প্রায় সপ্তাহখানেক থাকলেন। কিন্তু আর কখনোই সুস্থাবস্থায় তিনি বাড়িও যাননি, মায়ের সাথে দেখাও করেননি। নজরুলকে যখন ১৯২৩ সালে জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন নজরুল অনশন করেছিলেন—সেই অনশন ভাঙানোর জন্য নজরুলের মা এসেছিলেন গ্রাম থেকে, কিন্তু কবি মায়ের আদেশেও অনশন ভাঙেননি। নজরুল-জীবনের প্রধান রূপকার কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন: “নজরুলের গর্ভধারিণী মা, হুগলী এসেছিলেন। মা’র সঙ্গে নজরুলের কি একটা প্রচণ্ড মান অভিমানের ব্যাপার ঘটেছিল। পলটন হতে ফিরে এসে সে একবার মাত্র চুরুলিয়ায় গিয়ে আর কখনও যায় নি। মা’র সঙ্গে নজরুল দেখাও করে নি।”
মোহাম্মদী অফিস: দৈনিক মোহাম্মদীর উপর একবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, ফলে দৈনিক সেবকের বদলে বের হয়েছে দৈনিক সেবক—মওলানা আকরাম খাঁ তখন জেলে। সবকিছু দৈনিক মোহাম্মদীর, কেবল নামটা পরিবর্তন। কবি সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর শুনে নজরুল দৈনিক সেবকের অফিসে গেলেন। তখন
দৈনিক সেবকে কাজ করতেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন। নজরুল নিজেই প্রস্তাব দিলেন যে, কবি সত্যেন্দ্রনাথের উপর পরদিনের সম্পাদকীয় তিনিই লিখবেন। ওয়াজেদ আলী এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন উভয়েই রাজী! নজরুল যথারীতি সম্পাদকীয় লিখে চলে গেলেন। কিন্তু প্রুফ দেখতে গিয়ে ওয়াজেদ আলীর চোখ ছানাবড়া! কেন? নজরুল যে হিন্দুয়ানী শব্দ ব্যবহার করেছে তা যদি পত্রিকায় ছাপা হয় তাহলে নির্ঘাত আকরাম খাঁ ওয়াজেদ আলীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন। অগত্যা কী করা যায়? তার-উপর ‘লেখাটি ভারী সুন্দর। নজরুল ছাড়া এমন সুন্দর লেখা আর কারুর হাত থেকে বেরুতে পারতো না।’ তবুও নিজেদেরকে বাঁচানোর তাগিদে ওয়াজেদ আলী এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন মিলে হিন্দুয়ানী শব্দ সব বাদ দিয়ে লেখার ভাব, ভাষা বদল করে ফেললেন। পরদিন যথারীতি পত্রিকা প্রকাশ হলো। কিন্তু! কিন্তুটা জানাচ্ছেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন: “নজরুল সেদিন অফিসে এলেন না। তার পরদিনও নয়। শুধু তা-ই নয়। এরপর আর তাঁকে ‘সেবক’ অফিসে কোন দিনই দেখা গেল না।”
নার্গিস: নার্গিসের সাথে বিয়ের কথা আর নতুন করে কী লিখবো? সেই-যে ঝড়ের রাতে বের হয়ে এলেন, আর কোনোদিন না নার্গিসের কাছে, না সেই বাড়িতে—কখনোই যাননি। নজরুল সেই ঘটনার পরও কুমিল্লায় গিয়েছেন, কিন্তু সেই বাড়িতে আর গেলেন না।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন