আচ্ছা ট্রেনের ড্রাইভারকে কখনো স্টিয়ারিং ঘুরাতে দেখেছেন। আমি অন্তত দেখিনি। তাহলে ট্রেনগুলো লাইন বদলায় কি করে?
মজার ব্যাপার কি ট্রেনের লাইন বদলে ড্রাইভার সাহেবের কোন ভূমিকা নেই। মুখ্য ভূমিকা রাখে ট্রেনের চাকা। ট্রেনের চাকার এক পাড় ইঞ্চি খানেক উঁচু থাকে, দেখেছেন? একে রেলের ভাষায় ফ্লাঞ্জ বলে। এই ফ্লাঞ্জ আসলে লাইন বদলে কাজ করে। ট্রেনের আর কেউ কিসসুটি জানে না পর্যন্ত।
একটা রেললাইনের ক্রসিং-এ দুপাশের লাইনগুলো ফিক্সড থাকে। মধ্যের দুটো বর্শার ফলার মতো মিশে যাওয়া লাইন নড়াচড়া করানো হয়। একে বলে সুইচ। এই দুটো লাইনের মাথা প্রান্তভাগের দিকে এসে ক্রমশ চিকন হয়ে যায়। লোহার স্থিতিস্থাপকতার গুণের জন্য অল্পচাপেই তাই এর মাথার দিক নাড়ানো যায়। এর সুইচের মাথার দিক নাড়ালে ফ্লাঞ্চের কারণে ট্রেন এক লাইন থেকে আরেক লাইনে চলে যায়।
কিন্তু এই ফ্লাঞ্জ নাড়ায় কে? প্রথম দিকে প্রতিটি ক্রসিং-এ একটি করে লিভার পয়েন্টস থাকত। পয়েন্টসম্যানরা গিয়ে সেটা হাত দিয়ে ওঠা নামনোর মাধ্যমে ট্রেনের লাইন বদল করাতেন। কিন্তু লাইন ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এভাবে লাইন বদল দুরুহ হয়ে পড়ে। ফলে অনেকগুলো পয়েন্ট একটা জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা থেকে সিগন্যাল বক্স করা হলো। এটাকে ইন্টারলকিং প্রযুক্তি বলে। এই্ প্রযুক্তি পরবর্তীতে রেল নেটওয়ার্কের চেহারা পাল্টে দেয়।
একটা ঘরের মধ্যে অনেকগুলো পয়েন্ট লিভার একসঙ্গে থাকে। সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি লিভার উঠানো নামানোর মাধ্যমে লাইনের সুইচ ও সিগন্যাল বাতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কিন্তু লিভার ফ্লাঞ্জ সিগন্যাল বক্স সিস্টেমও একসময় প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল মনে হলো। ব্যক্তির শারীরিক শক্তির মাধ্যমে বিশাল একটি রেল নেটওয়ার্ক চালানো অসম্ভব। এরপর এলো ইলেকট্রনিক সিগন্যাল সিস্টেম। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি জায়গায় বসে সুইচ টিপে ক্রসিং-এর পয়েন্টসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কন্ট্রোলরুমে পয়েন্টসগুলোর নকশা প্রদর্শিত থাকে। প্রত্যেক পয়েন্টে বিভিন্ন রঙের বাতি জ্বলে, তা দেখে বোঝা যায় লাইনের অবস্থা। বাতির পাশে থাকে ছোট ছোট সুইচ। সেখানে চাপ দিলে লাইনের পয়েন্ট বদল হয়ে যায়।
এই প্রযুক্তির সর্বশেষ সংস্করণ কম্পিউটার সেট রেলওয়ে নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল। এখন দেশের এক প্রান্তে বসে প্লেনের ট্রাফিক কন্ট্রোলের মতো পয়েন্টগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। স্টেশন মাস্টার সাহেব চেয়ারে বসেই সব পয়েন্টগুলো মাউসের ক্লিকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে এই উন্নত নেটওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহার করে।
যে আলোয় যুগ যুগ পথ দেখেছে রেলওয়ে
ড্রাইসেল ব্যাটারি তখনও আসেনি। অন্ধকারে ট্রেনকে সিগন্যাল দেখানো, ট্রেনের মধ্যে কিছু দেখা বা লেখার কাজ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য যুগ যুগ ধরে রেলের কর্মচারীরা এই হ্যান্ড ল্যানটের্ন ব্যবহার করে আসছে। এর প্রযুক্তি খুব সাদামাটা। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত। গোল সিলেন্ডারের মতো কন্টেইনারের একদিকে একটা কাচের গ্লাস লাগানো থাকে। যেন ভেতরের কুপি বাতিটা যেন বাতাসে নিভে না যায়। এই কাচের উপর লাল সবুজ কাচ ঘুরিয়ে এনে রাখা যেত। ফলে এক বাতি দিয়ে তির রঙের আলো বেরুত। পথ দেখানোর আলোর কাজের পাশাপাশি দিব্যি সিগন্যালের কাজে করা যেত।
আমার বাবা রেলের কর্মকর্তা ছিলেন। রাতে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে সিটি বেজে উঠত। কিছুক্ষণ পর কন্ট্রোল থেকে একজন কলম্যান পাঠানো হত সাহেবকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কয়েক ধরনের হ্যান্ড ল্যানটের্নের ছবি দেওয়া হলো।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন