আগের পর্ব: চেঙ্গিস খানের আগ্রাসন ও খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন
সমরকন্দ ও বুখারা হারানোর পর সুলতান মুহাম্মদ ও স্বীয়পুত্র উভয়েই বুঝতে পারলেন যুদ্ধে জয় পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি পশ্চিমে পালায়ন করলেন এবং একই সাথে জালালুদ্দিন ফারগানা থেকে আফগানিস্তানের আরও গভীরে কাবুলে পালিয়ে যান। চেঙ্গিস খান সুবোতাই ও জেবেকে আদেশ দিলো যেখান থেকে হোক, যেভাবেই হোক শাহকে জীবিত কিংবা মৃত ধরে আনতে। চতুর দুই সেনাপতি ছুটল এবার শাহের পিছনে।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এই যুদ্ধে পরাজয়ের সম্পূর্ণ দায়ভার বুঝি শাহ ও তার ছেলের ছিল। শাহ নির্দোষ ছিল না, সে অবশ্যই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধী ছিল কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে দেশের বাকি ৯০% জনগণ কি করেছিল তখন? আজকের বিশ্বের দিকেই তাকান, যেখানে, আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, রাশিয়া এমনকি ইন্ডিয়া আগাম এ যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সেখানে আমরা কি করছি?
যাইহোক নিজেদের কৃত কর্মের ফলাফল হিসেবে শুধু রাজা তার রাজ্যছাড়াই হননি, বরং অলুক্ষণে প্রজাকূল নিজেদের চূড়ান্ত সর্বনাশ নিজেদের চোখের সামনেই দেখেছে এবং নিজেরাও ভোগ করেছে। আমু দরিয়া পার হয়ে শাহ কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা চালালেও মঙ্গোল স্পেশাল ফোর্সের সাথে পেরে উঠেনি, ফলে আবারো পালায়ন। জেবে ও সুবোতাই অবশেষে শাহকে ধরতে ব্যর্থ হয়। এই যে ইরান ও আজারবাইজানের বিস্তির্ণ অঞ্চলব্যাপী টম এন্ড জেরি খেলা চললো, যদি মুসলিমরা সচেতন হত তবে জেবে ও সুবুতাইয়ের সঙ্গীন অবস্থা রক্তে রঙ্গিন হতে সময় নিত না।
শাহ অবশেষে কাস্পিয়ান সাগরের নির্জন কোন দ্বীপে আত্মগোপন করা অবস্থায় মারা যায়। আর বড় শিকার হাত ছাড়া হওয়ায় জেবেরা ইরান ও আজারবাইজান অঞ্চলের বাইজাগান, জেব্রক্স, রেই, আরদান, জানযান, কাজিমের মত শহর নগরগুলো দখল করে খাওয়ারিজম অধ্যায়ের চূড়ান্ত পতন নিশ্চিত করে।
এদিকে তুলুইয়ের নির্দেশে কোটাকো জালালুদ্দিনকে শায়েস্তা করতে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওনা করে। জালালুদ্দিন সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তুর্কি সাইফুদ্দিন বারবাক ও আফগান মালিক খানের সম্মিলিত বাহিনীর মুখোমুখি হয় কোটাকো। ভেবেছিল অন্যান্য অঞ্চলের মতই যুদ্ধ বড় সহজ হবে কিন্তু তা হয়নি। মঙ্গলরা সর্বদাই একটি সেনাবাহিনী দেখেই ভয় পেত আর তা হচ্ছে তুর্কি। তুর্কি লিগেসির তাতারদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল গ্রেট মঙ্গোল আর্মি, কিন্তু তাতারদের তথা মধ্য-এশিয় তুর্কিদের পারফরমেন্স এতই ভাল ছিল যে, ফলে চেঙ্গিস খানের বাহিনীকে মানুষ তাতার নামেই চিনেছে।
যাই হোক কোটাকো প্রথম দফায় আক্রমণ চালায় ডান দিকের তুর্কি বাহিনীর উপর, আর এ আক্রমণেই তাতার বাহিনী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হলে কোটাকো তার মূল বাহিনীকেও বামে ও মধ্যবর্তী অঞ্চলে পরিচালনা করলে ঘেরাওয়ের মাঝে পরে গিয়ে প্রথমবাবের মত মঙ্গল আর্মি পরাজয়ের স্বাদ লাভ করে, যেখানে তাদের একজন গ্রেট কমান্ডারও নিহত হয়। যুদ্ধ শেষ না হতেই মুসলিম যৌথ বাহিনীর মাঝে দেখা দেয় ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ, ফলে জোট ফাটতে বেশি সময় নেয়নি। তুর্কিরা জালাউদ্দিনকে ছেড়ে চলে গেলে চেঙ্গিস খান দেখে এত মহা সুযোগ।
তাই সে এবার নিজে সহ সামগ্রিক বাহিনী নিয়ে জালাউদ্দিনের উপর হামলা চালায়। কাবুলে জালাউদ্দিন টিকতে না পারলে লাহোরে পালিয়ে আসে কিন্তু এখানেও চেঙ্গিস খান হানা দিলে সিন্ধুনদ পারি দিয়ে দিল্লী সালতানাতে আশ্রয় নেয়। ইতিপূর্বে খাওয়ারিজম রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘুরী সুলতান ও জালাউদ্দিনের দফায় দফায় যুদ্ধের তাজা স্মৃতির কারনেই ঘুরীরা জালাউদ্দিনকে বন্ধু হিসেবে না নিয়ে শত্রু হিসেবেই দেখে এবং যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে রাজস্থান হয়ে সাগর পথে পারস্যে পালিয়ে যায়।
পারস্যে গিয়েও মুসলিম সাম্রাজ্যকে পূর্ণরূপে বিন্যাস না করেই রাজ্য মালিকানা নিয়ে শুরু হয় ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ আর মঙ্গলরা হচ্ছে বিচারক। জালাউদ্দিন একের পর এক অঞ্চল আক্রমণ করে দখল করতে থাকে। চেঙ্গিসীয় বর্বরতার পর এ সময় মুসলিমরা এবার ক্ষমতা লোভী এক শাসকের পাল্লায় পড়ে আবারো রক্ত ঝড়াতে থাকে। মঙ্গোলরা জালাউদ্দিনকে সতর্ক করলেও সে তা উপেক্ষা করে মঙ্গোল অঞ্চল দখল করলে আবারো মঙ্গল আক্রমণের কবলে পরে কারো মতে যুদ্ধে, কারো মতে হত্যা, মতান্তরে এমনিতেই মৃত্যুবরণ করে। আর এভাবেই পিতা ও পুত্রের করুণ মৃত্যু ও খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
পরের পর্ব: অলক্ষে থাকা মর্দে মুজাহিদ বারকে খান
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন