রেল ও দুর্নীতি
এই ছোট্ট শক্ত কাগজের টিকেটের নাম এডমন্ডসন টিকেট। পাশে যে ক্যাবিনেটটা তাতে রাখার জন্য বিশেষভাবে এই টিকেটটা তৈরি করা। এই টিকেট, টিকেট ক্যাবিনেট পুরোটাই একটা টিকেটিং ব্যবস্থা। এটাকে এমডমন্ডসন টিকেটিং ব্যবস্থা বলা। ১৮৪০ সালে থমাস এডমন্ডসন এই টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগেও এই টিকেটিং ব্যবস্থা চালু আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মেইল ট্রেনগুলোতে এখনো এই ছোট্ট কাগজের টুকরোর টিকেট দেয়া হয়।
শক্ত কাগজের টিকেটের নাম এডমন্ডসন টিকেট এবং রাখার জন্য ক্যাবিনেট
১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট বৃটিশরা বাংলায় বাণিজ্যিকভাবে যাত্রীভাবে ট্রেন চালু করে। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট তারা চলে যায়। ঠিক ৯৩ বছর এই কাগজের টুকরোর টিকেট দিয়ে এরা দোর্দন্ড প্রতাপে রেল-বাণিজ্য করে গেছে। তখন কম্পিউটার ছিল না। ছিল না গণ্ডায় গণ্ডায় শিক্ষিত লোক। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না। কিন্তু কেউ টিকেট কালোবাজারি করেছে এমন ঘটনা শোনা যায়নি। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া রেলওয়ে শেষ বছরও (১৯৪৭ সালে) ১০ কোটি টাকা লাভ করেছিল। আজকের হিসেবে তা হাজার কোটি টাকার সমান। কিভাবে তারা এসব ম্যানেজ করত?
খুব সহজ। তারা দোষীদের শাস্তি দিত। সৎ কর্মীদের পুরস্কৃত করত। এই কাজ দুটো করতে কখনো তারা বিলম্ব করত না। প্রত্যেক বড়ো রেলওয়ে স্টেশনে (এখনও আছে) একজন করে রেল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্টেশন কম্পাউন্ডে সংঘটিত যেকোন অপরাধ তিনি আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক বিচার করতেন। এই শাস্তি ও পুরস্কার প্রথা চালু না করা গেলে রেলওয়েকে বাঁচানো যাবে না।
একটা বলের গল্প
একটা সরল চিন্তা কিভাবে একটা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে পারে নেইলস বল টোকেন সিস্টেম দেখলে বোঝা যায়। ব্রিটিশ ভারতে বেশির ভাগ রেল লাইন ছিল সিংগুল লাইন। তাই মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়া একটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ট্রেনের গতি বাড়ানো যাচ্ছিল না। ভারতের মধ্য প্রদেশে কাজ করা নেইল নামে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ভাবলেন, আচ্ছা এমন করা যায় না, একটা ট্রেন একটা লাইনে ঢোকার পর সেই লাইনে আর কোন ট্রেন ঢুকতে পারবে না। ব্লক হয়ে যাবে। কয়েকজনের কাছে বিষয়টি তিনি বললেন। সবার কাছে ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হলো। তিনি উঠে পড়ে লাগলেন।
রেলওয়ের টেলিগ্রাফ সিস্টেমকে ব্যবহার করে দারুণ একটা কাজ করে ফেললেন নেইল। বিষয়টা এমন: একটা বল থাকবে ট্রেনের ড্রাইভারের কাছে। আরেকটা স্টেশন মাস্টারের হাতে। ড্রাইভার যখন একটা স্টেশনে আসবে বলটা দেবে স্টেশন মাস্টারকে। স্টেশন মাস্টার দেবে ড্রাইভারকে তার বল। ড্রাইভারের বল একটা মেশিনের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা দু মাথা থেকে ব্লক হয়ে যাবে। তারপর ট্রেন ছাড়বে। ড্রাইভার পরবর্তীতে স্টেশনে গিয়ে বল বদলাবদলি করে নেবে। স্টেশন মাস্টার ড্রাইভারের পাওয়া বল মেশিনে ঢোকানোর সঙ্গে আগের স্টেশনের বলটি মেশিন থেকে বেরিয়ে আসবে। পেছনের লাইন খুলে যাবে। সামনের লাইন বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে ট্রেন চলবে। দুর্ঘটনার কোন সম্ভাবনাই নাই।
প্রথম ছবিতে দেখুন এক সঙ্গে দুটো মেশিন। কারণ একটা স্টেশনে আপ ডাউন দুদিক থাকে। তাই দুটো মেশিন।
এই নেলের বল দিয়ে এখনো বিভিন্ন ছোট লাইনে ট্রেন চলে। দেখবেন স্টেশনে ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে গোল একটা রিং-এর মতো জিনিস ড্রাইভারকে দেয়া হয়। আসলে সেখানে ছোট একটা প্যাকেটে বলটা থাকে। ড্রাইভার বলটি নিয়ে নিজের বল সেই রিং-এ দিয়ে দেয়। চলন্ত ট্রেনেও এই বল বদল সম্ভব। এভাবে নেইলের বল শত বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের নিরাপত্তা দিয়ে আসছে।
মোটা চিকন রেললাইন
অনেকেই প্রশ্ন করেন রেললাইন কেন মোটা চিকন হয়। মানে চওড়ায় কমবেশি? রেললাইনের প্রস্থকে গেজ Gauge বা মানদণ্ড বলা হয়। সারা দুনিয়ায় সাধারণত ৪ রকমের গেজের রেল ট্র্যাক আছে। রেললাইনকে রেলের লোক ট্র্যাক বলে। যেমন:
ব্রড গেজ Broad Gauge:যার প্রস্থ হয় সাগে ৫ ফুট থেকে ৫ ফুট
স্ট্যান্ডার্ড গেজ Standard Gauge: প্রস্থ ৪ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি
মিটার গেজ Metre Gauge: প্রস্থ সাড়ে ৩ ফুট থেকে ৩ ফুট
ন্যারো গেজ Narrow Gauge: আড়াই ফুট থেকে দুই ফুট
কথা হলো একটা বেড়ের রেললাইন বানানেলই তো হয়। এতো কিসিমের কেন? প্রশ্নটা আমারও। প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। দেখবেন পাহাড়ী এলাকা ও খনিতে ন্যারোগেজ রেল ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান কারণ এ রেলে অল্প জায়গায় বাঁক নেয়া যায়। পাহাড়ী এলাকায় জায়গার অভাব হয়। এছাড়া ন্যারো গেজের ট্রেন ছোট হয়। তাই উচু জায়গায় টেনে তোলার সুবিধা।
তাহলে বড়ো লাইন কেন করা হয়? লাইন যত বড়ো হয় তত বেশি যাত্রী ও মাল টানা যায়। স্বাভাবিকভাবে খরচ কমে আসে। কিন্তু বেশি বড়ো লাইনেরও বিপত্তি আছে। বানানোর ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি। দুর্ঘটনা ঘটলে জান শ্যাষ। তাই বেশি বড়োও না ছোটও না, মাঝারি গেজের ট্র্যাকই ভালো। সারা দুনিয়ার অর্ধেকরও বেশি ট্র্যাক স্ট্যান্ডার্ড গেজ। সারা ইউরোপ আমেরিকায় স্ট্যাডার্ড গেজ। শুধু সুইজারল্যান্ডের মতো পাহাড়ী এলাকায় ন্যারো গেজ দেখবেন।
এখন কথা হলো ট্র্যাকের গেজের সঙ্গে গতির কোন সম্পর্ক আছে কি-না। সরাসরি না থাকলেও আছে। সাধারণত রেললাইনের প্রস্থের ৭৫% হয় ট্রেনের চাকা। তাই যত বড়ো গেজের ট্রেন তার চাকা তত বড়ো। আর চাকা বড়ো হলে গতিও বেশি বাড়ানো যায়। তাই ভারতের ব্রড গেজের ট্রেন যেখানে ১৩০ কিলোমিটার স্পিডে ছোটে, আমাদের দেশে মিটার গেজে ৮০ কিলো ক্রস করতে কষ্ট হয়ে যায়।
তাহলে ডুয়েল গেজ কি? যে ট্র্যাকে একসঙ্গে দুই গেজের ট্রেন চলতে পারে তাকে ডুয়েল গেজ বলে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এরকম স্টিমারই রেলের যাত্রীদের প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র কিংবা পদ্মা পার করত
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এরকম স্টিমারই রেলের যাত্রীদের প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র কিংবা পদ্মা পার করত। এটা জামালপুরের ছবি। স্টিমারের নাম লক্ষ্মী। আরেকটা ছিল নাম রানী। ৭১-র পরও এসব স্টিমার চলত। যমূনা বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর পরিত্যক্তভাবে পড়েছিল। পরে বিক্রি করে দেয় রেলওয়ে।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন