অ্যাডলফ হিটলার— পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক। কোথায়, ঠিক কোন জায়গায় হিটলারের স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল কিংবা তার বিশাল বহর প্রকৃতির কাছে আটক হয়েছিল, বা ঠিক কোন জায়গায় হিটলার ভুল করেছিলেন এ লেখায় সেটাই বলার চেষ্টা করবো।
নাম যার অপারেশন বারবারোসা!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজ দেশের ইহুদী নিধন এবং ইউরোপে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য তিনি কুখ্যাতি অর্জন করেছেন, সেটা আমরা সবাই জানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। বেসামরিক জনগণের উপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকাস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদিদের উপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
sfsfsfsf
ইউরোপ আক্রমণের শুরুতে বড় সাফল্য পাওয়ার পর হিটলার চেয়েছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাল ফৌজকে পরাজিত করে সোভিয়েত রাশিয়া দখল করে নিতে। জার্মান বাহিনী তাদের সাফল্য বজায় রাখতে রাখতে মস্কোর কাছাকাছি যখন চলে আসে তখন রাশিয়ায় নেমে আসে ডিসেম্বরের তীব্র শীত। যে শীতের সাথে জার্মান বাহিনী অভ্যস্ত ছিল না। ফলে তারা এক প্রকার জমতে থাকে, এবং তখনই সোভিয়েত বাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ফলে জার্মান বাহিনীর মস্কো দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু জার্মান বাহিনীর তখনও বিপুল সংখ্যক সৈন্য এবং যুদ্ধাস্ত্র ছিল। ফলে হিটলার দমে না গিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হোন এবং পূর্ব ফ্রন্টের দায়িত্ব নেন।
১৯৪১ সালের ২১ শে জুলাই অপারেশন বারবারোসার অংশ হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে জার্মান ট্যাঙ্ক; Image Source: britannica.com
এদিকে রাশিয়াতে জার্মান বাহিনীর যত দিন যাচ্ছিল জ্বালানি তত বেশি কমে আসছিল। ফলে হিটলার জ্বালানির নিশ্চয়তা পেতে চাইলেন। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাশিয়ার চেচনিয়ার তেলের খনিগুলো দখল নেওয়ার। তেলের খনির দখল নেওয়ার জন্য তিনি তার ফ্রন্টের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে চেচনিয়া এবং স্ট্যালিনগ্রাদের দিকে পাঠান। কিন্তু জার্মান বাহিনী অনেক দেরি করে ফেলেছিল। চেচনিয়ার তেলের খনি জার্মানদের হাতে পড়ার আগেই সোভিয়েতরা খনিতে আগুন ধরিয়ে দেন। ফলে জার্মান বাহিনী তেলের খনি দখল করতে ব্যর্থ হয়।
সবচেয়ে বড় একগুয়েমির পরিচয় দেন হিটলার স্ট্যালিনগ্রাদ শহরে। জার্মান বাহিনী স্ট্যালিনগ্রাদকে অবরোধ করতে এসে তারা নিজেরা সোভিয়েত লাল ফৌজের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে জার্মানরা চাইলে শুরুর দিকে অবরোধ ভেঙে পিছু হটে আসতে পারতো কিন্তু একগুঁয়ে হিটলার তার বাহিনীকে একচুলও পিছু না হটার নির্দেশ দেন।
তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দেন স্ট্যালিনগ্রাদের ভিতরে থেকে শহরটি দখল করে নেওয়ার এবং তাদের প্রয়োজনীয় রসদ বিমানে করে পাঠানো হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকার কারণে জার্মান বাহিনী অস্ত্র এবং রসদ ফুরিয়ে আসে। হিটলার বিমানযোগে তার পদাতিক বাহিনীর কাছে প্রতিদিন ১৪০ টন রসদ পৌঁছে দিতো, কিন্তু সেই রসদ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম।
ফলে দিন দিন রসদ এবং অস্ত্রের অভাবে জার্মান বাহিনী দুর্বল হতে থাকে। সেই সাথে খাবারের অভাবে জার্মান সেনারা মারা যেতে থাকে। শুধুমাত্র স্ট্যালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনীর দেড় লক্ষাধিক সৈন্য মারা যায় এবং আরো প্রায় এক লক্ষাধিক সৈন্যকে বন্ধী করে সোভিয়েত বাহিনী, যার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার জীবিত ফিরতে পেরেছিল। তবে জার্মান বাহিনীর চেয়ে সোভিয়েত বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো অনেক বেশি।
অ্যাডল্ফ হিটলার,মাঝে, জেনারেল ফিল্ড মার্শাল ওয়াল্টার ভন ব্রুচিটসচ, বামে, জার্মান সেনাপতি প্রধান, এবং চিফ অফ স্টাফ কর্নেল জেনারেল ফ্রানজ হালদারের সাথে রাশিয়ান যুদ্ধের মানচিত্র দেখছেন,০৭ আগস্ট ১৯৪১
রাশিয়াতে জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের পেছনে ছিল হিটলারের একগুঁয়েমি, হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং যুদ্ধ জয়ের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। হিটলার ভেবেছিলেন তার বাহিনী অতিদ্রুত রাশিয়া দখল করে নিতে সক্ষম হবেন, সে কারণে তিনি ডিসেম্বর মাসের রাশিয়ার প্রচণ্ড শীতকে অগ্রাহ্য করে শীতের আগেই যুদ্ধ জয়ের আশা করে ছিলেন। ফলে যুদ্ধ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয় তখন শীতের কাপড়ের অভাবে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জার্মান সৈন্যরা মারা যেতে শুরু করে কিন্তু হিটলার তখনও তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
একদিকে শীত অন্যদিকে খাদ্য, রসদ এবং জ্বালানি তেলের অভাবে জার্মান বাহিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে হিটলারের নিকট এই ক্ষয়ক্ষতি আটকানোর সুযোগ ছিল, তিনি যদি তার বাহিনীকে ডিসেম্বরের শীতে পিছু হটার নির্দেশ দিতেন তাহলে জার্মান বাহিনী হয়ত পরবর্তীতে আবার আক্রমণ করতে পারতো। কিন্তু হিটলারের একগুঁয়েমি স্বভাব এবং বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকা হিটলারের আত্মবিশ্বাসের কারণে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে জার্মানি পরাজিত হয়।
১৩০ বছর পূর্বে ফরাসি অধিপতি নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন, নেপোলিয়ন ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তার রাজত্বকাল শেষ হয়ে যায়। নেপোলিয়নের মতো হিটলারের রাশিয়া আক্রমণও ব্যর্থ হয় এবং তারও কবর রচিত হয় এখান থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর জয়রথ যখন লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছিল তখন রাশিয়ার কাছে হিটলারের পরাজয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধের পর রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিত ভাবে জার্মানির উপর আক্রমণ শুরু করে।
রাশিয়ার কাছে হেরে জার্মানির শক্তি কমে যায়, ফলে জার্মানি মিত্র শক্তির কাছে একের পর এক হারতে থাকে। পরবর্তীতে জার্মান বাহিনী ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং হিটলার আত্মহত্যা করেন।
জার্মান বাহিনী ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে; Image Source: politico.com
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে একই সাথে জার্মানি এবং তার পরাজয় ডেকে আনেন। এই যুদ্ধে জার্মানির মোট ১০ লাখ সেনা হতাহত হয়েছিল, অন্যদিকে রাশিয়ার সৈন্য এবং সাধারণ মানুষসহ মোট ৪৯ লাখ লোক হতাহত হয়েছিল। রাশিয়ায় যদি হিটলার জিততে পারতো কিংবা বিপদের সময় পিছু হটে যেতো তাহলে হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতো।
ফুয়েরার হিটলার যদি একগুঁয়েমি না করে পিছু হটে রাশিয়া থেকে ফিরে আসতেন, পরবর্তীতে আবার আক্রমনে যেতেন, তাহলে হয়তো এডলফ বিশ্বে অন্যরকমভাবে আবির্ভূত হতেন! কি বলেন, প্রকৃতির বিচার বলে একটি কথা তো থাকেই, না হলে শীতে জমে গিয়ে হিটলারের মত লোক বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবেন, ভাবা যায়!
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন