বেলা ১১টা বেজে ২৮ মিনিট
২০ আগস্ট, ১৯৭১
মাশরুর বিমানঘাঁটি, করাচি, পাকিস্তান।
দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ২১ বছর বয়সী শিক্ষানবিশ পাইলট রশিদ মিনহাজ। তার বিমানের সামনে এসে একটি গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নামলেন সিকিউরিটি অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। তারও বয়স বেশি নয়। আর দুমাস পর ৩০ হবে। রশিদকে থামার ইশারা দিলেন মতিউর। রশিদ অবাক। কারণ কন্ট্রোল রুম থেকে অনুমতি মিলে গেছে। উড্ডয়নে কোন বাধা নেই।
রশিদ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি (জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন। একটা রুমাল চেপে ধরেন রশিদের মুখে। ক্লোরোফর্মের ক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন রশিদ। জ্ঞান হারানোর আগে রশিদ কন্ট্রোল রুমকে জানাতে সক্ষম হন বিমানটি হাইজ্যাকের খবর। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডারকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আসার চেষ্টা করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের আত্মদানের কাহিনী এভাবেই প্রথম ছাপায় হয় পাকিস্তানের দৈনিক ডন পত্রিকায়।
ভারত সীমান্তের মাত্র ৪০ মাইল কাছাকাছি আসার পর রশিদের জ্ঞান ফিরে। সে তৎপর হয়ে ওঠে বিমানটিকে ঘাটিতে ফিরিয়ে নিতে। ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে মতিউরের সঙ্গে। কোনভাবে আটকাতে না পেরে রশিদ ইজেক্ট সুইচ চাপল। এতে বিমানের ঢাকান খুলে গেল। মতিউর রহমানের কোন প্রকারের প্রস্তুতি ছিল না। সিল্ট বেল্ট বাধারও সময় পাননি। ফলে বাইরের বাতাসের তোড়ে মুহূর্তে তিনি বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। মতিউর রহমানের সঙ্গে কোন প্যারাসুট ছিল না। ছিল না ফ্লাইং স্যুট। ফলে ছিটকে পড়ে নির্মমভাবে নিহত হন। হঠাৎ করে ইনজেক্ট সুইচ চাপায় বিমানটিকে আমার সামাল দিতে পারল না রাশিদ। ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩২ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ২১ বছর বয়সী শিক্ষানবিশ পাইলট রশিদ মিনহাজ; Image Source: dawn.com
এই ঘটনার পর রাশিদ পান পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সাহসিকতার পুরস্কার নিশান-ই হায়দার। মতিউর পান সর্বোচ্চ গাদ্দারের তিরস্কার। তাকে বিমান বাহিনীর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে কবর দেয়া হয়। ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পর মতিউর রহমান পান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাহসিকতার পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠ। নিজের দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ তারা স্বীকার করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বীরত্ব বিরল। বীরের মৃত্যু নেই। শ্রদ্ধা জানাই।