আগের পর্ব: চীনের পশ্চিমাঞ্চলে চেঙ্গিস খানের অভিযান ও নৃশংসতা
১২১৭ সাল, চেঙ্গিস খান চীনে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেই পশ্চিম দুনিয়া দখলের চিন্তায় মগ্ন হলো। অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন, মঙ্গোলরা/ তাতাররা বাগদাদকে কেন্দ্র করেই হামলা চালিয়েছিল, কারণ তারাও অন্যান্যদের মত ইসলাম বিদ্বেষী ছিল। কথাটা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে না হলেও খুব বেশী যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। কারণ মুসলিম ছাড়াও নিজ স্বজাতি, চীন, মুসলিম ও পশ্চিমের খ্রিস্টানরা যে ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে বুঝাই যায় তার কাছে ইসলাম, কনফুসিয়াস কিংবা ঈসায়ী সবাই একই মনে হয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে, মঙ্গোলদের মুসলিম সাম্রাজ্যে আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তাও যেমন ছিল, ঠিক তেমনি ইসলামের শত্রুদের প্ররোচনাও ভুলে যাওয়ার মত নয়।
মুসলিম বিশ্বের অবস্থা:
সে সময় জ্ঞানে বিজ্ঞানে, শিল্প, সাহিত্যে মুসলিমরা নিজেদের এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যা চরম ইসলাম বিদ্বেষী ইউরোপিয়ানরাও এখনো স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এমন এগিয়ে থাকা জাতিও একটি চরম সমস্যায় নিপতিত ছিল, যার সমাধান না করতে পারাটাই নিজেদের উপর বারংবার আপদগুলো আঘাত হানার সুযোগ পেয়েছিল। আর তা হচ্ছে— রাজনৈতিক সমস্যা।
গাজি সালাউদ্দিন আইয়ুবিকে ক্রুসেড গোয়েন্দা হরমুন একটা গোপন সংবাদ দিয়েছিল যে, মুসলিমদের আমরা জাতি ভিত্তিকভাবে আলাদা করে ফেলবো। কথাটির মর্মার্থ ছিল মেষের পালকে ছিন্নভিন্ন করে নেকড়ের পাল একে একে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কথাটি কত বাস্তব ছিল তা যেন আইয়ুবীর মৃত্যুর অল্প পরেই মুসলিম বিশ্ব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। পশ্চিমে আনাতোলিয়া নিয়ে বিস্তৃত ছিল সালজুক সাম্রাজ্য, সিরিয়া ও মুসলিমদের প্রথম কেবলা নিয়ে আইয়ুবিদ সাম্রাজ্য, ইরাক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে আব্বাসিয়, মিশর ও পশ্চিম আফ্রিকা নিয়ে মামলুক সাম্রাজ্য, স্পেন ও পর্তুগাল নিয়ে আন্দালুস ও পারস্য থেকে মধ্য এশিয়া, ককেসাস ও হিন্দুকুশের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য এবং ভারতে ছিল ঘুরী সালতানাতে বিভক্ত। আদর্শের দিক দিয়ে মুসলিমরা এক থাকলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতার কারণেই ভাই ভাইয়ের রক্ত ঝড়াতে কোনো দ্বিধা করতো না। ফলে তাদের মাঝে আদর্শিক একতা থাকলেও আঞ্চলিক ও জাতিগত বিশৃঙ্গলা সেই বিভক্ত মেষপালে পরিণত করেছিল।
মানচিত্রে গ্রেট সেলজুক সাম্রাজ্য; Image Source: commons.wikimedia.org
বর্তমানের দিকে তাকালে বুঝা যায়, ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান কলোনি মুক্ত মুসলিম বিশ্ব আজ ৫৪/৫৫ ভাগে বিভক্ত। এখনো কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, আরাকানসহ শত অঞ্চলে পশ্চিমারা যে নির্মমতা চালাচ্ছে তার দায় আমাদেরই। মাত্র কয়েক খণ্ডে বিভক্ত মুসলিম বিশ্ব যেখানে মঙ্গোল ঝড় থামাতে পারেনি, সেখানে এত খণ্ডে বিভক্ত মুসলিমরা বিশ্ব-ঝড় কী করে থামাবে?
মুসলিম সাম্রাজ্যের আরেকটি সমস্যা ছিল মাখো তেল থিওরি। যে প্রশাসনকে যত তেল মারতে পেরেছে, ততই মঙ্গল লাভ করেছে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে অগ্রসর মুসলিমদের আমল-আখলাক বর্তমানের মত এত নোংরা অবস্থায় যায়নি। কিন্তু ইসলামের সামগ্রিক আদর্শিক শিক্ষাগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় তাদের অবস্থাও সেই রাখালের মত যার কথা কেউ শুনে না। তেল থেরাপির কারণে প্রায়সই দেখা গেছে নিজ স্বার্থে বাবাকে দিয়ে ছেলে, ভাই কে দিয়ে ভাই কিংবা নিজেরা নিজেরাই বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে শতধা বিভক্ত করে হয়েছে দুর্বল। সে অনুপাতে বর্তমান নিয়ে কথা কথা বলার তেমন কিছুই নেই। চোখ মেলে তাকালেই সব পরিস্কার দেখা যায়।
ধর্ম ও রাজনৈতিক বিভক্তি:
ইসলাম ধর্ম ও রাজনীতিকে এক করে একটি আদর্শ দাঁড় করালেও এ সময়ে ধর্ম ও রাজনীতি পৃথক হয়ে পরে। ফলে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন রাষ্ট্রীয় লাভ ক্ষতির চিন্তা করত না, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র ধর্মের ব্যাপার তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। হাজারো জগত বিখ্যাত আলেম বর্তমান থাকা স্বত্বেও রাষ্ট্রীয় বহু কর্মে অধর্মের কাজকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়নি। আলেমে দ্বীনগণের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্র যে সুযোগ সুবিধা প্রদান করত, তা এক কথায় অনস্বীকার্য। ফলে আলেমগণও খুশিই থাকতেন। যার প্রভাবে রাজনীতি ও ইসলাম আলাদা পথে যাত্রা করার সুযোগ পেয়েছিল।
ক্রুসেডারদের ষড়যন্ত্র:
মুসলিমদের হাতে ক্রমাগত মার খেতে খেতে তারাও দুর্বল হয়ে যাওয়ায় শত্রু মুসলিমদের শায়েস্তা করতে নব উত্থিত মঙ্গোলদের সাহায্য নেওয়াটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। ইতিহাস থেকে জানা যায় নিজেদের পরাজয়ের গ্লানি মুছতে ও মুসলিমদের ক্ষমতাচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর ক্রুসেডাররা চেঙ্গিস খানের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। আমার ইহুদি ষড়যন্ত্রে বলেছিলাম সিল্করোড ইহুদিদের কিভাবে সে সুযোগ করে দিয়েছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির কারণে পারস্য ও অন্যান্য ইহুদিরাও ককেসাস থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। এই ইহুদিরাই ক্রুসেডার ও মঙ্গোলদের মুসলিম বিনাশে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ ও মুসলিম অঞ্চল জয়ের সুবিধাগুলো বর্ণনা করে চেঙ্গিস খানকে মুসলিম অঞ্চলে আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করে।
অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থা:
মুসলিম বিশ্ব এমনিতেই ছিল অর্থের বিশাল এক ভান্ডার, সেই সাথে মধ্য এশিয়া ছিল কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক অগ্রগামি। অর্থাৎ একটি বিশাল মঙ্গোল রাজ্য পরিচালনা করতে খাদ্য ও অর্থের যে যোগানের প্রয়োজন ছিল এর জন্য মুসলিম সাম্রাজ্য ব্যাতীত আর কোন উৎকৃষ্ট অঞ্চল বিবেচিত হওয়ার মত ছিলনা। তাই ক্রমাগত আয়তনে বাড়তে থাকা মঙ্গোলিয়ার জন্য মুসলিম সাম্রাজ্যে চেঙ্গিস হামলা ছিল অত্যাবশ্যকীয়।
সাবেক মুসলিম কাশগড় ও সমগ্র পশ্চিম লিয়াও চেঙ্গিসের হস্তগত হলে, বিশাল সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বাপেক্ষা বড় বাধা ছিল এই মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো। তাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিচারেও মুসলিম সাম্রাজ্যে আক্রমণ করাটা চেঙ্গিসের জন্য জরুরি ছিল। কারণ ঠান্ডা সাইবেরিয়া, ওরাল সাগর আর কেজালকুম মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ইউরোপ হামলা করা একদিকে যেমন অসম্ভব, সেই সাথে পিছন থেকে মুসলিম হামলার ভয়— দুইটাই এড়াতে মুসলিম সাম্রাজ্য জয়ের কোন বিকল্প চেঙ্গিসের কাছে ছিল না। তাই চেঙ্গিস খান চীন ছেড়ে এবার পশ্চিমে তার আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে চললো।
পরের পর্ব: চেঙ্গিস খানের আগ্রাসন ও খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন