ঢাকার ইতিহাস ঘাটলেই সরদারি প্রথার কথা চলে আসে। একটা সময় পঞ্চায়েতে বিভক্ত ছিল ঢাকা, সে পঞ্চায়েতগুলোতে একজন করে সরদার থাকতো। ঢাকার নবাবদের মাধ্যমে এই প্রথা গড়ে উঠেছিল, যা সরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছিল। এ প্রথা অনুযায়ী ঢাকা নগরীর প্রতিটি মহল্লা বা পঞ্চায়েত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো, এবং এই পরিষদের নেতা হিসেবে যিনি নির্বাচিত হতেন, তাকেই সরদার বলে গণ্য করা হতো।
এমনই একজন সরদার হলেন পিয়ারু সরদার। অনেকেই তাঁর নাম জানেন, অনেকেই জানেন না! তার জন্ম ১৮৯৩ সালে। ১৯৪৪ সালে পিতা মুন্নু সরদারের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক রেওয়াজ অনুযায়ী তাকে পাগড়ি পরিয়ে সরদার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
পিয়ারু সরদার; Image Source: bbarta24.net
তিনি ছিলেন হোসনি দালান, বকশিবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, উর্দু রোড, নূরকাতা লেন, আজিমপুর, পলাশীসহ বিভিন্ন মহল্লার সরদার। দানশীল ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে তার খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। একবার তিনি ঢাকা পৌর করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে কমিশনার নির্বাচিত হন।
পিয়ারু সরদারের কথা কেন নিয়ে আসছি, সেটা বলার আগে বলে নেই, তিনি কি কি করেছিলেন! যা যা করেছেন সবই আপনার আমার সামনে বিদ্যমান, অথচ আমরা জানি না!
ঠিকাদারি ব্যবসার দিকে মনোনিবেশ করার কারনে পাকিস্তান আমলে তিনি পরিণত হন একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারে। তার তত্ত্বাবধায়নেই নির্মিত হয়েছিল ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তন এবং রমনা পার্ক। এছাড়াও রানী এলিজাবেথের জন্য তিনি নির্মাণ করেছিলেন পার্কের বিশাল মঞ্চটি, যা আজ শতায়ু মঞ্চ নামে পরিচিত।
মন্ত্রিপাড়ার বেশ কিছু ভবন নির্মাণের সাথেও জড়িত ছিলেন পিয়ারু সরদার। কেউ কেউ মনে করেন, ঢাকা স্টেডিয়াম নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন যে কয়জন ঠিকাদার, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের আদমজি জুটমিল, মোহাম্মদপুরের রিফিউজি কলোনি, আসাদগেট, ঢাকা মেডিকেল কলেজের নার্সিং হোস্টেল প্রভৃতি নির্মাণকাজেরও ঠিকাদার ছিলেন তিনিই।
কথিত আছে, ঢাকায় রানী এলিজাবেথের আগমনের প্রাক্কালে শহরটিকে তিলোত্তমা করে সাজানোর উদ্দেশ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে লাটভবন (বর্তমান বঙ্গভবন) পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। আপাত অসম্ভব সেই কাজটিও সম্ভব হয়েছিল পিয়ারু সরদারে কর্মতৎপরতায়ই।
অনেকেই জেনে অবাক হবেন, এখনও যে ঢাকার ঈদগাহের নামাজের প্যান্ডেল নির্মিত হয়, সেটির পেছনে রয়েছে পিয়ারু সরদার অ্যান্ড কোং-এর অবদান। পিয়ারু সরদার যা করেছেন সে আসল কাজটির কথা না বললে লেখাটা শেষ করা যাবে না— পাঠকরা ও বুঝবেন না।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। যখন ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং আন্দোলনে মুখর হয়ে ওঠে, তখন তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। অনেকে তো নিহত হনই, এছাড়াও গুরুতর আহত হন বা বন্দি হন আরো শত শত আন্দোলনকারী। সব মিলিয়ে দেশ যখন এক মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন নিজ দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে এগিয়ে আসেন পিয়ারু সরদার।
২১ ফেব্রুয়ারির পরদিনই ছাত্ররা মনস্থির করেন যে তারা ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবেন। ঠিক যে জায়গাটায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়েছিল, সেখানেই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নামখচিত একটি স্মৃতির মিনার নির্মিত হবে। এ লক্ষ্যে সেদিনই বদরুল আলম তৈরি করেন মিনারটির নকশা। কিন্তু মিনার তৈরি করতে হয় নগদ অর্থ লাগবে, নয়তো লাগবে কাঁচামাল। ছাত্রদের কাছে সে সময়ে কিছুই ছিল না। তাহলে উপায়? ছাত্রদের মাথায় তখন প্রথম যে নামটি এলো, সেটি হলো— পিয়ারু সরদার।
ঐ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবনের সম্প্রসারণের কাজ চলছিল, যার ঠিকাদারি করছিলেন পিয়ারু সরদার। সেখানে কাজের জন্য যে পরিমাণ বালু ও ইট মজুদ ছিল, তা দিয়ে অনায়াসেই কাজ চলে যেত, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে সিমেন্ট, তা রাখা ছিল তালাবদ্ধ গুদামে। গুদামের চাবি ছিল কেবল পিয়ারু সরদারের কাছেই। ছাত্ররা ধরেই নিয়েছিল, পিয়ারু সরদারের কাছে সিমেন্টের আবদার করা হলেও তা রাখবেন না তিনি। কিংবা বলা ভালো, রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে, কেননা সরকারি সিমেন্ট তিনি ‘সরকারবিরোধী’ কাজে দান করে দিয়েছেন, এ কথা জানাজানি হলে আর রক্ষে ছিল না।
তারপরও ঢাকা মেডিকেল কলেজের দুই ছাত্র দুরু দুরু বুকে হাজির হলেন পিয়ারু সরদারের কাছে, পেশ করলেন নিজেদের দাবি। তাদের কথা শুনে সহসাই কোনো জবাব দিলেন না তিনি। নিঃশব্দে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন। যখন ফিরে এলেন, তখন তার হাতে একটি চাবি। ছাত্রদের হাতে চাবিটি তুলে দিতে দিতে শুধু বললেন— ‘কাজ শেষ করে পরদিন অবশ্যই চাবিটি ফেরত দিয়ে যেয়ো।’
তার কল্যাণেই জোগাড় হয়ে যায় মিনার নির্মাণের ইট, বালু, সিমেন্ট। তখনো ঢাকায় কারফিউ জারি ছিল। সেই কারফিউয়ের ভেতরই যথাসম্ভব নীরবে, শত শত স্বেচ্ছাসেবীর পরিশ্রমে ২৩ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে নির্মিত হয় ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার।
প্রথম শহীদ মিনার Image Source: ei-banglay.com
৬ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উচ্চতার সেই মিনারটি ছিল শক্ত ভিতের উপর নির্মিত। মিনারের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিল দুটি পোস্টার, মধ্যভাগে লেখা হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ আর নীচের দিকে লেখা হয়েছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এসে সেই শহীদ মিনারের স্মৃতিফলক উন্মোচন করলে, সেখানে ঢল নামে আবেগাপ্লুত হাজারো মানুষের। সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে থাকে ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের। মেয়েরা ফুলের পাশাপাশি নিজেদের শরীর থেকে গহনা খুলে নিবেদন করতে থাকে শহীদ মিনারের পাদদেশে। এছাড়া অনেকে নগদ টাকাও রাখে।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তো তার নাম জানেই না। কারণ অনেকদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি তিনি। তবে দেরিতে হলেও, ২০১৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
পুরান ঢাকার নতুন দিনের মানুষ পিয়ারু ভাই, আমরা আপনাকে ভুলি নাই!
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন