আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল তৃতীয় আরব দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি করেছে। উপসাগরীয় ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও চুক্তির পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে ইসরাইল সরকার। বিশেষ করে, যেসব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের গোপন সম্পর্ক রয়েছে, তারা প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চুক্তিতে আসতে পারে: যেমন- বাহরাইন, ওমান, মরক্কো, সৌদি আরব, কাতার ও সুদান। যদিও ঐ চুক্তির পর, ফিলিস্তিন সরকারসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশ এটাকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে।
সংযু্ক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মাঝে চুক্তি হওয়ার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ উপদেষ্টা জার্ড কুশনার বলেন: ইসরাইলের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা আগামী দিনগুলোতে হবে। সেসব দেশের পর, সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক গড়তে পারে।
আমিরাত-ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শান্তি চুক্তির নাটকীয় ঘোষণার পর, বেরিয়ে আসছে একের পর গোপন তথ্য!
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি স্বাভাবিক করতে একাধিকবার গোপনে আমিরাত সফর করেছেন! এটা ছিলো তার গোপন মিশন। শুক্রবার ইসরাইল টুডে পত্রিকা জানায়, দু দেশের মাঝে চুক্তি করতে গত দু বছরে নেতানিয়াহু অন্তত দুবার আরব আমিরাত সফর করেছেন। এ দু দফা সফর কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে এবং নেতানিয়াহুর সাথে তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান মীর বেন শব্বাত ছিলেন।
উল্লেখ্য, দু দেশের মাঝে কোনো সম্পর্ক না থাকায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী উপসাগরীয় দেশটিতে সরকারীভাবে কোনো সফর করতে পারেননি; গোপনেই তা করতে হয়েছিলো। যদিও ইসরাইল ও আরব আমিরাত এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। তবে ইসরাইলের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দু দেশের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং তাদের মধ্যকার চুক্তির বিষয়গুলো চূড়ান্ত করতে আগামী সপ্তাহে দু দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা আরব আমিরাতে একত্রিত হবেন। এ বৈঠকে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান যোশী কোহেন থাকবেন।
ইসরাইলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠনিক করতে পরবর্তী আরব দেশ বাহরাইন ও ওমান হবে বলে আশা করছে ইসরাইল। আজ (রবিবার) ইসরাইলের গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রী এলি কোহেন বলেছেন: এ (আমিরাত-ইসরাইল) চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আরো উপসাগরীয় দেশ ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো সঙ্গে অতিরিক্ত চুক্তি হবে। আমি মনে করি, বাহরাইন ও ওমান অবশ্যই এ এজেন্ডায় রয়েছে। এছাড়াও আমার মূল্যায়নে এমন একটি সম্ভাবনা রয়েছে যে, আগামী বছরে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি হবে – যাদের অন্যতম দেশ হলো সুদান।
গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান (মোসাদ) যোশী কোহেন গত সপ্তাহের শেষে বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী খলিফা বিন সালমান আল-খলিফার সঙ্গে কথা বলেছেন। বাহরাইনের বাদশাহর মুখপাত্রের বক্তব্য মোতাবেক, তাদের প্রধানমন্ত্রী শনিবার বাহরাইনের বাইরে একটি ‘ব্যক্তিগত সফর’ করেছেন! তাছাড়া, আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির পর, বাহরাইনের বাদশার কূটনৈতিক উপদেষ্টা এক টুইটে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে স্যালুট জানিয়েছেন!
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আরেক আরব দেশ ওমান লাইনে রয়েছে। আবুধাবির চুক্তি নিয়ে মাস্কট তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করেছে। দেশটির তরফ থেকে ইসরাইল-আমিরাতের চুক্তিতে সমর্থন জানানো হয়েছে। ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র এক টুইটে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের ঐতিহাসিক চুক্তির বিষয়ে সুলতানাতের (ওমান) সমর্থন রয়েছে! নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনের আগেই ওমান সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তিতে আসতে পারে।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক ডেভিড ইগাতিউস জানিয়েছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় যেসব মুসলিম দেশ, তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে মরোক্কো, ওমান ও বাহরাইন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইল ও ইহুদি প্রশ্নে অনেক নমনীয় ভূমিকায় আছে মরোক্কো। ফিলিস্তিন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তথাকথিক শান্তিচুক্তি বা পরিকল্পনার সমর্থক দেশটি। ফেব্রুয়ারীতে গুজব ওঠে – পশ্চিম সাহারায় মরোক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি সম্পর্কে শনিবার কোনো বিবৃতি দেয়নি সৌদি আরব। বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের ব্যাপারে অনেক বেশি খোলোমেলা অবস্থানে দেশটি। ইসরাইলের ব্যাপারে ওমান, আমিরাত ও বাহরাইনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে রিয়াদ।
যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান গত কয়েক বছরে ইসরাইল প্রসঙ্গে খোলামেলা অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ফেব্রুয়ারীতে ইসরাইলিদের সৌদি সফরের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তখন এক ইসরাইলি ব্লগারকে সাদর অভ্যর্থনা জানায় রিয়াদ!
১৯৯০ সাল থেকে কাতারের সঙ্গে ইসরাইলের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর, কাতারে বাণিজ্য দফতর খুলেছিলো ইসরাইল – যা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চালু ছিলো। ২০০৭ সালে ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিজিপি লিভানি কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খালিফা আছ-ছানীর সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বৈঠক করেন। ২০১৭ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর, নিজ দেশে ইসরাইলি সমর্থক বাড়িয়েছে কাতার!
এদিকে, মুসলিম জাহানের সমালোচনার মাঝেই ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কৌশলগত শান্তি চুক্তির দুদিনের মাথায় করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথমবারের মতো তাদের মাঝে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে।
আমিরাতি রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম ওয়াম জানিয়েছে, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে শনিবার আমিরাতি অ্যাপেক্স ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে ইসরাইলি টেরা গ্রুপের চুক্তি হয়েছে। অ্যাপেক্স চেয়ারম্যান খলিফা খরৌ বলেছেন: মানবতার সেবায় করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা জোরদার করতে আমিরাত-ইসরাইলের মাঝে বাণিজ্য, অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক খাতে কার্যকর অংশীদারিত্বের সূচনাকারী প্রথম বাণিজ্যিক চুক্তি হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আবুধাবিতে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এ চুক্তিতে দু দেশের পক্ষে যার যার প্রতিনিধি স্বাক্ষর করেন। আমিরাত ও ইসরাইলের মাঝে শান্তি চুক্তির দু দিন পরেই করোনাবিরোধী ভ্যাকসিন নিয়ে চুক্তি করলো তারা। এক যৌথ বিবৃতিতে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খুব দ্রুতই সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইল করোনভাইরাসের চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনের উন্নয়নে সহযোগিতা ত্বরান্বিত করবে। বিনিয়োগ, পর্যটন, সরাসরি বিমান চলাচল, সুরক্ষা, টেলিযোগাযোগ ও অন্যান্য বিষয়ে চুক্তি করতে ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিরা আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসবেন।
ওদিকে, টেলিফোন সেবা চালুর মধ্য দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছে। আজ (রবিবার) দুপুরে আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আন-নাহিয়ান ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাবি আশকেনাযিকে ফোন করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। এর আগে দুপুর ১টার দিকে জেরুজালেম ও দুবাইয়ে অবস্থিত বার্তা সংস্থা এপির দু সাংবাদিক নিজেদের মাঝে ল্যান্ডফোন ও মোবাইলে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এ ফোনকল যোগাযোগই হতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলে ঐতিহাসিক চুক্তির প্রথম স্বাক্ষর।
তবে আরব আমিরাত ও ইসরাইল কর্তৃপক্ষ বলছে, খুব দ্রুতই লাইনের কাজ শুরু হচ্ছে না।
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এর আগে ফোনকোড +৯৭২ ব্যবহার করে ইসরাইলের সাথে যোগাযোগের সুযোগ ছিলো না। তবে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেউ কেউ মাঝে মাঝে কল করতে পারতো; যদিও তা প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হতো। কিন্তু ইসরাইলের কিছু লোক ফিলিস্তিনের ফোন নাম্বার ব্যবহার করে আরব আমিরাতে কল করতে পারতো।
সূত্র: চ্যানেল ১২, জেরুজালেম পোস্ট, ইসরাইল টুডে,
টাইমস অব ইসরাইল, ওয়াশিংটন পোস্ট, এপি, ফ্রান্স২৪,
ওয়াম, রয়টার্স ও আল-জাজিরা।