লেবাননে প্রকৃত পরিবর্তন চায় দেশবাসী; অর্থাৎ শুধু সরকার নয়, পুরো শাসন ব্যবস্থাই বদলের দাবি তাদের। আর তা পূরণ না হওয়া তক রাজপথ না ছাড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণ। চলমান বিক্ষোভ ও ক্রমবর্ধমান জনরোষের মুখে সোমবার মন্ত্রীসভাসহ পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের সরকার। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বলছেন – সরকারের এ পদত্যাগে কিছুই যায়-আসে না। এতে চলমান সমস্যার কোনো পরিবর্তন হবে না। কেননা, সরকার পড়লেও সিস্টেম পড়েনি।
তাদের দাবি, বৈরুতের রাসায়নিক বিস্ফোরণের মতো দেশের সব সংকট ও সমস্যার জন্যে দায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন ব্যবস্থা ও এলিট শাসকশ্রেণী (প্রভাবশালী গোষ্ঠী)। এদের কারণেই লেবাননে চরম বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে এখন আর বিজলী বাতি জ্বলে না। আঁধারে নিমজ্জিত পুরো দেশ। আলো জ্বালাতে প্রদীপ আর মোমবাতিই এখন জনগণের একমাত্র ভরসা।
গত এক বছরে এ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। তার ওপর মুদ্রাস্ফীতি- বেকারত্বের অসন্তোষ। এসবের মাঝেই গত সপ্তাহে বৈরুতের বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাই কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত দু শতাধিক মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ৬ হাজারের বেশি মানুষ। উদ্বাস্তু হয়ে খোলা আকাশের নিচে প্রায় তিন লাখ অধিবাসী। নজিরবিহীন এ দুর্ঘটনার জন্যে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও অদক্ষতা এবং এলিট শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্বকে দায়ী করে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে রাজপথে নামে লেবাননী জনতা।
সোমবার বৈরুত বন্দরের কাছেই বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সেখান থেকেই স্লোগান ওঠে – ‘বারি দ্য অথরিটি ফার্স্ট’ (আগে শাসকশ্রেণীর কবর রচনা করতে হবে)। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই পদত্যাগের ঘোষণা দেয় সরকার।
সরকার যে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, তা পদত্যাগের ঘোষণাতেও স্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব। বৈরুত বিস্ফোরণের জন্যে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতিকেই দায়ী করে তিনি বলেন: আমি আগেই বলেছিলাম – দুর্নীতি আমাদের রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু পরে আমি দেখলাম – এ দুর্নীতির শিকড় আমাদের রাষ্ট্রের চেয়ে দীর্ঘ।
বিক্ষোভের মুখে গত বছরের নভেম্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরী সরকারের পতনের পর, সরকার ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন দিয়াব। কিন্তু এলিট শাসকশ্রেণীর কারণে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
লেবাননে এ মুহূর্তে চরম অর্থনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক নেতাদের কয়েক দশকের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অভিজাত ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত (সিন্ডিকেটবাজি), তার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সিরিয়ার যুদ্ধ দেশটির অর্থনীতিকে টেনে নামিয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে গভীর সংকটে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে হাজির হয় করোনাভাইরাস মহামারী।
তদুপরি, বৈরুত বিস্ফোরণে দেশের অর্থনীতি এখন পুরোপুরি পঙ্গু। আর্থিক খাতের দুর্দশা লাঘবে বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে চায় সরকার। কিন্তু সরকার, ব্যাংক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে থমকে গেছে আলোচনা। শাসন ব্যবস্থার সত্যিকারের পরিবর্তন ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
একই কথা শোনা যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের মুখেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্টে বলা হয়েছে – শুধু সরকারের পদত্যাগের মধ্যদিয়ে এ সমস্যার শেষ হবে না।
এখনও সেই একই প্রেসিডেন্ট (মিশেল আউন), একই পার্লামেন্ট-স্পিকার (নবি বারি) আর আগের পুরো সিস্টেমই (শাসন ব্যবস্থা) বহাল রয়েছে।
বৈরুত বন্দর ও লেবাননে অন্যান্য সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্ব রয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের পর থেকে সেই একই রাজনীতিকরাই পুরো দেশে রাজত্ব করছে। তবে সোমবারের সরকার পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে জনগণ।
সরকার পতনের পরদিন (মঙ্গলবার) বৈরুতে নিজের বিধ্বস্ত দোকানের সামনে থেকে এক সাক্ষাৎকারে সিলভারস্মিথ আভেদিস আনসারলিয়ান বলেন: এটা একটা ভালো ব্যাপার যে, সরকার পদত্যাগ করেছে। কিন্তু সরকার ব্যবস্থায় নতুন রক্ত আসা দরকার। নইলে শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না।
সূত্র: রয়টার্স।
পছন্দের আরো লেখা