আজব এক গ্রামের কথা বলবো, যার ঘর-বাড়ি সব বোমা দিয়ে তৈরি! হাসি পাচ্ছে আপনার, ভাবছেন রূপকথা, মোটেও না!
সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি হয়তো জমিতে কাজে গেলেন—গিয়ে দেখলেন, জমিতে পোঁতা আছে অব্যবহৃত বোমা, যেটি আজকের নয়, প্রায় ৪৭ বছর আগের নিক্ষেপিত বোমা! শিশুরা হয়তো বনেবাদাড়ে খেলতে গেল, সেখানে কুড়িয়ে পেল বোমা, সে বোমা কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয়-সুপ্ত! জলাশয়ে কাজ করতে গেলেন, দেখলেন পানির নিচে বোমা!
কেমন হবে ভাবুন তো! উপরে যে কথাগুলো বলেছি এগুলো রূপকথা নয়, রুঢ় বাস্তব। আপনি চাইলে এখনো গিয়ে দেখতে পারেন সে মানুষগুলোর জীবনধারা, যাদের দৈনন্দিন বসবাস বোমার সাথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিত্যাক্ত বোমাগুলো বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটায়, যার অধিকাংশ শিকারই আবার শিশু। ২০১২ পর্যন্ত হিসেবে সেখানে প্রায় ২৯ হাজার মানুষ এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়।
ভাবছেন কোথায় সেটি? বলছিলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ লাওসের ভেতরে জিয়াংখুয়াং প্রদেশের ‘বান নাপিয়া’ নামক একটা গ্রামের কথা। যে গ্রামটি বিখ্যাত ‘দ্য বম্ব ভিলেজ’ নামে! লাওসের এই গ্রামের বাসিন্দাদের বোমার সাথে দৈনন্দিন আর পাঁচটা জিনিসের মতো সম্পর্ক। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাতচল্লিশ বছর পরে এখনো বোমা বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে মাঠেঘাটে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয় তাদের।
লাওসের একটি গ্রামে প্রায় ৩০+ বছর আগে বোমা বিস্ফোরণের ফলে তৈরি হয় গর্তটি, Image Source: history.com
যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোপন যুদ্ধের’ ফলাফল হিসেবে, যার জন্য হতভাগ্য লাওসবাসীদের সাতচল্লিশ বছর পরেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গোপন যুদ্ধ বলার কারণ হচ্ছে, তৎকালীন আমেরিকাসহ বিশ্বের কেউই লাওসের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে জানত না। সবাই শুধু ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে এমনটাই জানত। আসল ঘটনা হলো-ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমিউনিস্ট গেরিলাদের সামরিক রসদের যোগান আসত লাওসের ভেতরকার ‘হো চি মিন ট্রেইল’ নামক রাস্তা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করতে লাওসে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে, যার মোট পরিমাণ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মোট বোমার থেকেও বেশি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলেন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলেন কিংবা এযাবৎ যত যুদ্ধই পৃথিবীতে সংঘঠিত হয়ে থাকুক না কেন— লাওস এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের শিকার দেশ। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লাওসে মোট পাঁচ লাখ আশি হাজার টন বোমা ফেলেছিলো মার্কিন বাহিনী। গাণিতিক হিসেবে গড় করলে দাঁড়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ৮ মিনিটে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে এবং সেটা চলেছিলো টানা ৯ বছর ধরে।
সে সময় নাকি লাওসে ‘বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ’ করা হয়েছিল। বোমাগুলোর ৩০ শতাংশ এখনো অবিস্ফোরিত অবস্থায় আছে, সংখ্যার হিসাবে তা প্রায় সাত কোটি ৫০ লাখ। লাওসের ১৮টি প্রদেশের মধ্যে ১০টিকে অবিস্ফোরিত বোমার কারণে ‘মারাত্মক দূষিত’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
বোমা ফেলা শেষ হয়েছে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই কবে, কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না, কৃষককে জমিতে কোদালের কোপ দিতেই হবে, শিশুরাও মাঠে খেলতে যাবে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে— মানুষ বেশ চমৎকারভাবে মানিয়ে নিয়েছে এসব বোমার সাথে। ঘরের সীমানার বেড়া দেয়া হচ্ছে বোমার শেল দিয়ে। কখনো বোমশেল কেটে দু’খণ্ড করে বানানো হয়েছে ফুলের টব। রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে ক্লাস্টার বোমার খোল ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যাশট্রে হিসেবে, বড় আকারের বোমার খোল ব্যবহৃত হচ্ছে চুলা হিসেবে। নদীতে দেখা যাবে জঙ্গীবিমানের জ্বালানী ট্যাংক (ড্রপ ট্যাংক) দিয়ে দিব্যি নৌকা বানানো হয়েছে।
বোমার খোলস দিয়ে তৈরি সব্জি চাষের মাচা, Image source: pinkplankton.com
এমনকি গবাদি পশুর গলার মালা হিসেবেও বোমার টুকরো ব্যবহৃত হচ্ছে। কি একটা জীবন, আপনি দোকানে যাবেন দেখবেন হয়তো দোকানের সামনে ছোট একটি ডাস্টবিন দেয়া আছে, যেটি প্লাস্টিকের নয়, বোমার খোলসের! আপনি দোকানে খেতে যে টেবিলে বসবেন সেটি কাঠের নয়, বোমার খন্ডাংশ!
৭৫ সালের পরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লাওস সরকার যাবতীয় ল্যান্ড মাইন, বোমা ইত্যাদি পরিস্কার করা শুরু করে। এ ধরনের কাজের জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত কর্মী, উন্নত প্রযুক্তি আর পর্যাপ্ত বাজেট দরকার হয়, যার কোনোটিই লাওস সরকারের নেই। এ সময় থেকেই ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে ভূমি বোমা মুক্তকরণ চলছে, যা আজও চলমান।
লাওস সরকার বলেছে— লাওসের যে কারিগরী সামর্থ্য, তাতে প্রায় শতাব্দী লেগে যাবে এগুলো সরাতে। লাওসে সরকারি বেসরকারি সবাই বোমা মুক্তকরণে কাজ করছে! সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে এনজিওর সহায়তায় স্বেচ্ছাশ্রমেও বোমা মুক্তকরণের কাজে এগিয়ে আসছে।
তবে ‘বান নাপিয়া’ গ্রামটি যে কারণে বিভিন্ন মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে তা হলো, গ্রামবাসী বোমার স্ক্র্যাপ গলিয়ে বিভিন্ন রকম স্মারক বস্তু তৈরি করছে পর্যটকদের জন্য। এর মধ্যে আছে চামচ, চাবির রিং, বোতলের ছিপি খোলার যন্ত্র, ব্রেসলেট ইত্যাদি।
বোমার খোলস দিয়ে তৈরি নৌকা, Image source: plethorist.com
লাওস ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেরই ভ্রমণ তালিকায় থাকে বম্ব ভিলেজ বান নাপিয়া। গ্রামটিতে গেলে যুদ্ধের ভয়াবহতার অনেক চিহ্ন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ফসলের ক্ষেতে গেলে দেখা যায় দিগন্ত পর্যন্ত পুরো মাঠ প্রচুর গর্তে ভরা। এসব গর্ত বিমান থেকে ফেলা বোমার বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে তোলা প্রচুর ছবির মাধ্যমে ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যায়।
এই জিয়াংখুয়াং প্রদেশের রাজধানী আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্যও বিখ্যাত। সেটি হলো ‘প্লেইন অব জার’ নামক অনেক সংখ্যক কলস আকৃতির পাথুরে পাত্র। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে মদ জমা রাখার জন্যে এসব পাত্র তৈরি করা হয়েছিলো। প্রাচীন নিদর্শনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বোমা বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট গর্তেরও দেখা মেলে।
লাওসে বোমা নিক্ষেপ ছিল আমেরিকার গোপন যুদ্ধ, আমেরিকা কখনোই সেটি স্বীকার করতো না। এমনভাবে অস্বীকার করতো তারা যেন আদৌ এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি! তবে ২০১৬ সালে বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাওস সফর করেন এবং স্বীকার করেন এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের দায়। বারাক ওবামার উদ্যোগে ৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়া হয় লাওসের ভূমিকে বোমা মুক্তকরণের জন্যে।
সত্যি-ই আজব এক গ্রাম, বোমা দিয়ে তৈরি সব ঘর-বাড়ি! তবে, লাওস মানুষের নিরাপদ বসবাসের স্থান হোক— এটাই চাওয়া।