বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্যে দায়ী ২,৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কেন এতোদিন বন্দরের গুদামে পড়েছিল? কে সেগুলোর মালিক? কেন কোনো দাবীদার নেই? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি।
বিস্ফোরণের পর, এক সপ্তাহের মাথায়ও কেউ ঐ রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর মালিকানা দাবি করেনি বা কাগজপত্র ঘেঁটেও মালিকের কোনো সন্ধান মেলেনি।
রয়টার্সের তরফ থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। আসল মালিককে খুঁজে বের করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। তাই, স্পষ্টভাবে মালিকের পরিচয় জানা জরুরি।
২০১৪ সালে মলদোভার পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ ‘রোসুস’ ঐ রাসায়নিক দ্রব্যগুলো নিয়ে বৈরুত বন্দরে ভেড়ে। নৌপথে পণ্য পরিবহনের নিয়মানুযায়ী এভাবে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো মারাত্মক দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য পরিবহন অত্যন্ত বিপজ্জনক।
কে বা কারা এতোটা ঝুঁকি নিয়ে বিপুল ঐ রাসায়নিক দ্রব্য এক দেশে থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাচ্ছিলো তা খুঁজে বের করতে রয়টার্স অন্তত ১০টি দেশের বেশ কয়েকজন নাগরিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এবং নথিপত্র ঘেঁটে আসল মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে।
লেবাননের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা হাসান হাসবানী বলেন: ‘পণ্যগুলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে পরিবহন করা হচ্ছিলো। তৃতীয় আরেকটি দেশে গিয়ে সেগুলো আটকে যায় এবং কেউ সেগুলোর মালিক নয়! কেন সেগুলোর যাত্রা এখানে শেষ হয়েছিলো?
এ চালানের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। কিন্তু তারা সবাই কার্গোটির আসল মালিক কে, তা জানেন না বলে জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে আর কোনও কথা বলতে রাজি হননি।
এমনকি পণ্যবাহী জাহাজটির ক্যাপ্টেন, জার্জিয়ার সার উৎপাদক প্রতিষ্ঠান – যারা কার্গোটি পাঠিয়েছিলো এবং আফ্রিকার যে ফার্ম ঐ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কেনার আদেশ দিয়েছিলো – তারা কেউই আসল মালিককে চেনেন না বলে দাবি করেছেন। আফ্রিকার ফার্মটির দাবি – তারা কেনার আদেশ দিলেও কখনোই ঐ রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর দাম পরিশোধ করেনি।
‘শিপিংয়ের’ নথি মোতাবেক, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জর্জিয়া থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের চালানটি পণ্যবাহী জাহাজ ‘রোসুসে’ তোলা হয়। রাসায়নিক দ্রব্যের চালানটি মোজাম্বিকের বিস্ফোরক উৎপাদক একটি প্রতিষ্ঠানকে ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিলো।
কিন্তু জাহাজটি ভূমধ্যসাগর পার হওয়ার আগেই তাদের কাছে একটি নির্দেশ আসে বলে জানান রোসুসের ক্যাপ্টেন ও দু ক্রু। রুশ ব্যবসায়ী ইগোর গ্রেচুশ্কিন তাদেরকে ঐ নির্দেশ দেন – যাকে তারা জাহাজটির মালিক বলে চিনতেন। ঐ নির্দেশে বলা হয় – বাড়তি কার্গো নিতে তাদেরকে বৈরুত বন্দরে থামতে হবে। যাত্রাসূচিতে যেটা বলা ছিলো না।
২০১৩ সালের নভেম্বরে বৈরুত বন্দরে পৌঁছায় রোসুস। কিন্তু ‘পোর্ট ফি’ দিতে না পারায় সেটি আইনি জটিলতার মুখে পড়ে। জাহাজটির দশাও বেহাল ছিলো, সেটিতে ফুটো ধরা পড়েছিলো। তারপর রোসুস আর কখনোই বৈরুত বন্দর ছাড়তে পারেনি।
বৈরুত বন্দরের নথিপত্র মোতাবেক, জাহাজটির বীমা কোম্পানি পানামা ভিত্তিক একটি ফার্মকে জাহাজটির আইনি মালিক দেখিয়ে সেটিকে বন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখায় মামলা করে।
সময়ে গড়াতে থাকে। এক সময় রাসায়নিক দ্রব্যগুলো কার্গো জাহাজ থেকে নামিয়ে বন্দরে ঘাটের কাছেই একটি গুদামে রাখা হয়। আর বাজেয়াপ্ত খালি জাহাজটি ২০১৮ সাল থেকে যেখানে নোঙর করা ছিলো – সেখানেই সম্ভবত ডুবে গেছে।
বৈরুতের যে আইনি ফার্ম বীমা কোম্পানির হয়ে মামলা করেছিলো – রয়টার্স থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। গ্রেচুশ্কিনের সঙ্গেও যোগযোগ করা যায়নি।
তাহলে কে ঐ দু হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কিনেছিল? এতো খোঁজাখুঁজির পরও সেই উত্তর এখনও গভীর অন্ধকারে।
বৈরুত বন্দরে রোসুসকে যখন বাজেয়াপ্ত করা হয়, তখন কি কেউ রাসায়নিক দ্রব্য বোঝাই কার্গোটির মালিকানা দাবি করেনি? না করে থাকলে, কেন করেনি? অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মূল্যবান রাসায়নিক দ্রব্য। ২০১৩ সালের দাম অনুযায়ী, ঐ রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর তখনকার বাজার মূল্য প্রায় সাত লাখ মার্কিন ডলার। কার্গোর ভেতর বড় বড় সাদা বস্তায় সেগুলো রাখা ছিলো।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কনভেনশনস এবং কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরীণ আইন অনুযায়ী, বাণিজ্যিক পরিবহনের ক্ষেত্রে বীমা করা বাধ্যতামূলক।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতি, জাহাজ ডুবে গেলে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, অন্য জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা বা সংঘর্ষের কারণে ক্ষতিপূরণের জন্যে জাহাজের বীমা করতেই হয়। দুটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানায়, এখন পর্যন্ত কেউ রোসুসের জন্যে বীমার অর্থ দাবি করেনি।
জাহাজের রুশ ক্যাপ্টেন বোরিস প্রোকোশেভ বলেন: আমি রোসুসের বীমার কাগজপত্র দেখেছিলাম। কিন্তু সেগুলোর সত্যতা যাচাই করিনি।
অন্যদিকে, মোজাম্বিকের কোম্পানিটির দাবি – তারা ঐ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মালিক নয়। কেননা, পণ্য ডেলিভারি পাওয়ার পরই কেবল তারা মূল্য পরিশোধের চুক্তি করেছিলো।
৪ঠা অগাস্টের বিস্ফোরণের পর এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। জনরোষের চাপে লেবানন সরকার সোমবার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়।
সূত্র: রয়টার্স।