জানেন কি? আমাদের ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের একটি বাড়ি দেখে সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানরা মুগ্ধ হতো এক সময়! রুপকথা মনে করবেন না; বাস্তবিক অর্থে এখনো আছে সে বাড়ি, তবে এখন আর কেউ মুগ্ধ হয় না, সেই জৌলুসও এখন আর নেই!
বুড়িগঙ্গার নাম শুনলে এখন লোকে নাক সিটকায়। কালো দূষিত পানি, নর্দমা-ময়লা-আবর্জনা চোখের সামনে ভেসে উঠে! অথচ এক সময় এ নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরূপ সৌন্দের্যের সৃষ্টি হতো। ১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন— ‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে, তখন ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।’
শুধু তাই নয়, এ বুড়িগঙ্গা নদীতে শুধু বিলাস জাহাজ নয়, বাণিজ্যিক জাহাজও ঢুকতো এক সময়ে। জাহাজিরা মুগ্ধ হয়ে যেত চারটি আলাদা ঘাটসহ সে বিখ্যাত বাড়ির চেহারা দেখে। আর্মেনিয়ান, ব্রিটিশ আর ঢাকার ক্লাসিক চেহারা মিলিয়ে সে বাড়িটি আসলেই ছিল দেখার মত।
বৃটিশদের সর্বগ্রাসী বাণিজ্যনীতি আর কলোনিয়াল শাসন প্রকৃতির কারণে এক সময় অন্যান্য বিদেশী বণিকেরা ঢাকা ছেড়ে যেতে থাকে। বিক্রি হতে থাকে তাঁদের স্থাবর সম্পত্তি, রয়ে যায় সেসবের স্থাপত্যরীতি আর এর সাথে যোগ হয় ব্রিটিশ ও দেশি স্থাপনার সে সময়ের ‘trend’. ঢাকার প্রায় এক শতকের বিখ্যাত ভবনগুলোতে এখনো রয়েছে সেই ছাপ।
রুপলাল দাস, যার নামানুসারে এই মহলটির নামকরণ করা হয়েছে। Image Source: en.wikipedia.org
ঠিক সে সময়টাতে ঢাকার দুই বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। ঢাকার বণিক সমাজে বেশ নামডাক হয়েছিল দুজনেরই। ১৮৩৫ সালের দিকে তারা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের সামাজিক মর্যাদার সাথে মানানসই একটা বাড়ি কেনা দরকার তাঁদের। তাঁরা বেছে নিলেন সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে বড় বাড়িগুলোর একটিকে।
আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন ১৮২৫ সালের কাছাকাছি সময়ে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ১০ বছর বয়সী বাড়িটি রূপলাল কিনে নেন নগদ টাকায়। কিনে ফেলে বাড়িটির নাম দিলেন ‘রুপলাল হাউজ’! পুরান ঢাকার অদূরে ফরাশগঞ্জের শ্যামবাজারে তার অবস্থান।
রূপলাল ব্যবসায়ী হিসাবে ধনাঢ্য ছিলেন। তবে প্রায় সব ইতিহাস ঘেটেই পাওয়া গেছে তাঁর ব্যবসার উন্নতির পেছনে মেধা, পরিশ্রম ও রুচির প্রশংসা। বাড়ির ব্যাপারেও শুধু বাড়ি কিনেই খুশী হননি তিনি। নিজের পছন্দ, চাহিদা ও রুচির সমন্বয়ে পুনঃনির্মাণ করেন বাড়িটি। এভাবেই রুপলাল হাউজ হয়ে ওঠে ঢাকার বিলাসী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর জৌলুসে ভরা বাসভবন।
রূপলাল হাউজ আসলেই অবাক করে। অবাক না হওয়া প্রজন্মকে আরও বেশি করে অবাক করে। রূপলাল নিজেও অবাক করেন অনেকবার। ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পেয়েছিলেন মেধাক্রমের জন্য ১০ টাকার বৃত্তি। ব্যবসাজীবন শুরু করেছিলেন লগ্নি ব্যবসা করে।
তাও একদম পথে পাটের তৈরি বস্তা বিছিয়ে হকার এর মত। সেখান থেকে মেধার জোরেই উঠে যান ঢাকা শহরের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাতারে।
আর মানুষ হিসাবে ছিলেন ভয়াবহ বিলাসী। এই বাড়ি পুনর্নির্মাণ এর কাজ তিনি দেন কলকাতার বিখ্যাত ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মার্টিন এন্ড কোং এর হাতে। বিশাল নির্মানযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় ভাবে পোড়ানো ইট আর প্রচুর লোহা। নির্মাণ কাজ চলেছিল দীর্ঘসময়। বিলাসী রূপলাল দশক পরিবর্তনের সাথে সাথে শুধু উপমহাদেশের ব্রিটিশ ভাবধারাই নয় বরং ইউরোপিয়ান স্থাপত্য হালচালের সর্বশেষ সব স্টাইল একটু একটু করে জুড়ে দিয়েছেন তার শখের বাড়িতে।
রুপলাল হাউজের ভেতরের দৃশ্য। Image Source: walkbangladesh.com
রুপলাল হাউজের বিখ্যাত জিনিস হলো তার জলসাঘর! এটি ছিল বুড়িগঙ্গার দিকে মুখ করা। ভবনের পশ্চিম দিকের এই কক্ষে কাঠের সূক্ষ্ম কাজ ছিল সিলিংয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা সংগীত ও নৃত্যশিল্পীরা আসতেন তাঁর জলসাঘরে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালিউল্লাহ খান বা লক্ষীদেবীদের সুরে-তালে, শান শওকতে ভরে থাকতো এই জলসাঘর।
উপর থেকে দেখলে ভবনের আকৃতি ইংরেজি বর্ণ E এর মত। নদীর তীর জুড়ে রয়েছে সবচেয়ে বড় অংশ। আর শহরের দিকে মুখ করে ছড়িয়ে গেছে তিনটি আলাদা উইং। এর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা উইং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ মিটার (৬০ফিট) এর মত।
আপনি কি জানেন— ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সাথে এই বাড়ির একটা মিল আছে? জ্বি, কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কথা বলছি! ভাবছেন—কী ধরনের মিল? এই দুই বাড়িতেই ইংল্যান্ডের রাণীর অতিথি হিসাবে থাকার কথা ছিলো। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তো বানানোই হয় সেইজন্য।
ঢাকায় আসলে নতুন করে কিছু বানানো হয়নি। ঢাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ছিল বলা যায় দু’টি। একটা ঢাকার নবাব পরিবারের আহসান মঞ্জিল। যেটা সবাই চেনে। আরেকটা হচ্ছে রূপলাল হাউজ।
প্রশ্ন হচ্ছে— দুটো বাড়িতে রানী কীভাবে থাকতেন? দু’টো বাড়িতে তো থাকতে পারবেন না। তাই ভোটাভুটি হয়েছিল। কিছু ব্রিটিশ সাহেব সরেজমিনে দুটো বাড়িই দেখে গিয়েছিলেন। রূপলালের বিলাসবহুল জীবন দেখে ব্রিটিশ সাহেবেরা থ মেরে গিয়েছিল পুরোপুরি। বিপুল ভোটে জিতে যায় রূপলাল হাউজ।
১৮৮৮ সালে লর্ড ডফরিন আসেন ঢাকায়। তিনি ছিলেন সে সময় ভারতের ভাইসরয়। রূপলাল হাউজে এসময় তাঁর সম্মানে একটি বল নাচের আয়োজন করা হয়। ডফরিন সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন রূপলাল এর বাড়ি এবং তাঁর আয়োজনে। তবে রানী শেষ পর্যন্ত আর উপমহাদেশেই আসেননি সে সময়ে। তাই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মত রূপলাল হাউজেও তাঁর পা পড়েনি।
রুপলাল হাউজের দু:খের গল্প আছে একটি। ১৮৯৭ সালে ঢাকায় বেশ বড় ধরনের একটা ভূমিকম্প হয়। নদীর তীরের নরম মাটিতে তৈরি পাকা ভবনে বেশ খারাপভাবে আঘাত করে এই দুর্যোগ। রূপলাল আবারো প্রচুর খরচ করে বাড়ির মেরামতির কাজ করেন। কিন্তু কিছু অপ্রাপ্তি রয়ে যায়। নদীর দিকে সম্মুখভাগে ‘আরবান স্কেল’ এর একটি ঘড়ি ছিল।
অনেকেই দাবী করেন এটি লন্ডন এর বিগ বেন থেকে অনুপ্রাণিত ছিল। তবে সে কথার তেমন শক্ত ভিত্তি পাওয়া যায় না। ভূমিকম্প মেরামতির পর এই ঘড়িটি আর পুন:স্থাপন করা হয়নি।
শেষের দিকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় দাস পরিবার আর যেন সাহস পায়নি ঢাকা শহরে থাকার। বাড়ি বিক্রি করে চলে গেলেন সীমানা পেরিয়ে। দেশভাগের আর দশটি বিয়োগান্তক সম্পর্কের মত শেষ হয়ে গেল দাস পরিবারের সাথে অভিজাত ঢাকার স্মৃতি। বাড়ির মালিকানা নিয়ে দলাদলির শুরু তখন থেকেই। তবে ১৯৫৮ সালে মোহাম্মদ সিদ্দিক জামাল রূপলাল হাউজ কিনে নেন। নাম দেন ‘জামাল হাউজ’। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির শরীরে এখনো এই নামটিই রয়েছে।
প্রচলিত আছে, পুরাতন সময়ে বিদেশীরা ঢাকায় আসলে ফাইভ স্টার হোটেল তো ছিল না, এখান থেকেই ঘর ভাড়া করত।
ডফরিনের ঢাকা সফরের সময় যে বলনাচ হয়েছিল সেটা আসলে রূপলাল এর আয়োজন করা ঠিকই, তবে বলরুম ব্রিটিশদের তরফ থেকে ভাড়া করা হয়েছিল। আর রূপলাল হাউজে সে সময় থাকার ভাড়া ছিল ২০০ টাকা।
তবে এখন খারাপই লাগে রুপলাল হাউজকে দেখলে, এর গায়ে বাসা বেঁধেছে বটবৃক্ষ। তাতে পাখিরা কিচিরমিচির ও করে। কিন্তু তাঁর চেয়ে বড় পরজীবী হিসাবে বাসা বেঁধেছি আমরা। আশেপাশে প্রত্নতত্ত্ব আইন আর পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতেই যেন ভবনের গায়ে আশেপাশের ভবন মালিকেরা তুলে দিয়েছেন নিজেদের ভবন। অনেকে শুরু করেছেন মসলা আর সবজির ব্যবসা। অনেকে ভাড়ায় এক দুই ঘর নিয়ে থাকছেন ও দিব্যি দোতলায়।
তবে আশার কথা, মসলার দোকানীদের কবল থেকে প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর রূপলাল হাউজকে উদ্ধার করেছে অল্প কিছুদিন আগে। এখনো সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উপযোগী করে খুলে দেয়া হয়নি। তবে নিকট ভবিষ্যতে কোনদিন এরকম সুখবর শুনব বলে আশা করে বসে আছি। তবে আপনি চাইলে এখনো গিয়ে দেখে আসতে পারেন রুপলাল হাউজ, বেশি দূরে না পুরনো ঢাকার অদূরেই!