তাবুক যুদ্ধে যাচ্ছেন আল্লাহর রাসূল। যৌক্তিক কারণেই অনেক সাহাবি পিছপা হলেন। বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকছেন কিছু মোনাফিক। আল্লাহর রাসূল আর কারো জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন মনে করলেন না। রওয়ানা হলেন আগন্তুক সাহাবিদের সাথে নিয়ে। কিন্তু এক সাহাবি পিছনে পড়ে গেলেন। তার উট ঠিকঠাক যাচ্ছিল না। তিনি কী করলেন, উট থেকে নেমে সমস্ত মালামাল কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। এজন্যই পড়ে গেলেন বেশ পেছনে। এক মঞ্জিল পর তথা পরবর্তী জনপদে আল্লার রাসূলের সাথে থাকা সাহাবীরা অস্পষ্ট কিছু একটা দেখতে পেলেন। দূর থেকে কে যেন আসছে মনে হচ্ছে!
রাসূলকে জানালেন। দূরপানে দৃষ্টি ফেললেন আরশদর্শক নবি। নীরবতা ভেঙে বললেন- “আবু যারই হবে”। কিছুক্ষণ পর অস্পষ্টতা কিছুটা দূর হলো। সাহাবীরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম! এ তো আবু যারই“। রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চয়তাসূচক বাক্যে বললেন, “আল্লাহ আবু যারের উপর রহম করুন। সে একাকী চলে, একাকিই ইন্তেকাল করবে এবং হাশরেও উঠবে একাই”। (তারিখুল ইসলাম, ইমাম যাহাবী, ৩য় খণ্ড)
হ্যাঁ, তিনি আমাদের আবু যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। কতটা দুনিয়াবিমুখ ছিলেন তিনি, জানেন? খেলাফত চলাকালীন ক্রমশঃ মুসলমানদের দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেননি। হজরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আমলে তিনি বাস করতে চলে যান শামের নির্জন এক প্রান্তরে। খলিফা এ কথা শুনে উনাকে ডাকলেন। বললেন- “আপনি আমার কাছে থাকুন, দুগ্ধবতী উটনী প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আপনার দরজায় হাজির হবে।” খলিফার এ প্রস্তাব তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন: “তোমার এ দুনিয়ার কোন প্রয়োজন আমার নেই।” এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন।
একদিন তার বাসগৃহে একজন আসল। চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী যেন দেখলেন। কিন্তু একেবারে শূন্য ঘর। কিছুই তার দৃষ্টিতে পড়ল না। গৃহস্থালীতে কিছুই দেখতে না পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– আবু যার, আপনার সামান-পত্র কোথায়?
– আখিরাতে আমার একটি বাড়ি আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দিই।
একদা তার নিকট সিরিয়ার আমীর পাঠালেন তিনশ’ দীনার । প্রয়োজন পূর্ণ করার অনুরোধ জানালেন। হজরত আবু যর দীনারগুলো কী বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, জানেন?
“শামের আমীর কি আমার থেকে অধিকতর নীচ কোন আল্লাহর বান্দাকে পেল না?”
মাত্র আটাশটি হাদিস তার থেকে বর্ণিত হয়েছে। অথচ তিনি ইসলাম গ্রহণে চতুর্থ কিংবা পঞ্চমতম। চাইলে বর্ণনা করতে পারতেন আরও বহু। কিন্তু তিনি সর্বদা আত্মমগ্ন থাকতেন। মিতভাষী ছিলেন। মুখরতা অপছন্দ করতেন। দুনিয়াবিমুখতা তাকে সব থেকে দূরে রেখেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন জ্ঞানপূর্ণ এক সাহাবি। হজরত আনাস ইবনে মালিক, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ন্যায় বিদ্বান ব্যাক্তিবর্গ তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। জ্ঞান-মদিনার দরজা হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন তার জ্ঞানের গভীরতা সম্বন্ধে, “এমন জ্ঞান তিনি লাভ করেছেন যা মানুষ অর্জন করতে অক্ষম। সে জ্ঞানভাণ্ডার আগুন দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্ত তা থেকে কোন খাদ বের হয়নি।” (ইমাম ইবনে আসাকির ‘তারিখে দামেশক’-এর মধ্যে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।)
প্রিয়নবির ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ আছে তো? সেই তাবুকক্ষণে যে বলেছিলেন “আবু যর ইন্তেকাল করবে একাকী”! বাস্তবতা দেখাব অন্যদিন।
সদ্য বিদায়ী ৮ যিলহজ ছিল হজরত আবু যর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকাল দিবস। কিন্তু আমরা কেউ জানি না। সকলের অগোচরে রয়েছেন তিনি আপন উজ্জ্বলতায়। আজও তিনি আছেন নির্জনতায়। স্মরি রাহমাতুল-লিল আলামিন নবির বাণী, আবু যর একাকী চলে…