আগের পর্ব: খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ও পিতা-পুত্রের করুণ পরিণতি
চেঙ্গিস খানের যে কয়জন ছেলে ছিল তাদের মাঝে জসি ছিল কিছুটা উদারপন্থী কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রে অদমনীয়। সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্বে আক্রমনের সময় জসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তিয়েনশানের ফারগানায় জালাল উদ্দিনকে আটকে রাখতে যেন পিছন থেকে মোঙ্গল আর্মির উপর ঝাপিয়ে পরতে না পারে। কাজ সুন্দরভাবে সমাধার পর জসিকে উপহার দেয়া হয় বুখারা। চেঙ্গিস খানের খুনি আদেশ অমান্য করে জসি বুখারাবাসীর প্রতি দয়াদ্র আচরণ করায় তাকে বুখারার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ওগেদাইকে দিয়ে চেঙ্গিসখান বুখারায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। সে দিনই মোটামুটি ঠিক হয়েই গিয়েছিল যে, চেঙ্গিসের রক্তনীতির সাথে জসি খুব মানানসই না, তাই পরবর্তি মঙ্গল প্রধান হওয়া তার কপালে নাই। হয়েছিলও তাই। তৎকালীন মঙ্গল রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা অনুর্বর ও ঝুকিপূর্ণ অঞ্চল ককেশাস ও বলকানের কিছু অংশ তিনি পেয়েছিলেন। এই অনুর্বর ভুমিকেই তার বংশধরেরা মঙ্গল বিশ্বের গর্বের ধন গোল্ডেন হোর্দে রুপান্তরিত করেছিলেন।
চেঙ্গিস খান; Image Source: en.wikipedia.org
জসির বড় ছেলে বাতু খানের অন্যতম আস্থার নাম ছিল বারকে খান। মঙ্গলদের ইউরোপ ঝড়ের অন্যতম মহানায়ক ও ইউরোপিয়ানদের মনে মঙ্গল আতংক স্থায়িভাবে বসিয়ে দেয়ার নাম ছিল বারকে খান। এমনকি গ্রেট খান নির্বাচনে কুরুলতাইয়েও বারকে খানের প্রভাব ছিল প্রচুর। রাজনীতি, সমরনীতি— উভয় ক্ষেত্রেই গোল্ডেন হোর্দকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌছাতে বাতু খানের ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বারকে খান। মঙ্কে খানের সিংহাসন লাভের পিছনে যে ব্যক্তি কুরুলতাইয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি ভুমিকা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন বাতু খানের প্রতিনিধি বারকে খান। শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা, প্রশাসনিক অবকাঠামো ও ধ্বংসাত্মক আর্মির মালিক হওয়ায় এককালের সেকেলে অঞ্চল মঙ্গলদের গর্বের প্রতিক গোল্ডেন হোর্দের প্রতাপ ছিল সবার উপরে।
গোল্ডেন হর্ডের সেনাবাহিনী; Image Source: pinterest.com
মঙ্কে খানকে গ্রেট খান বানিয়ে ফেরার পথে বুখারায় এক বণিক দলের কাছে ইসলামের আহবান পেয়ে প্রথম মঙ্গল হিসেবে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন এই বারকে খান। সমাজের অন্যতম প্রভাবক যেদিকে যায় স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই সে পথে হাটে। এরই ধারাবাহিকতায় শামানিজম ও বোদ্ধ ধর্ম ছেড়ে এলিট ও সাধারণ জনগণ ইসলামের ছায়াতলে চলে আসতে শুরু করে।
একদিকে ক্রুসেডার, অন্যদিকে ইহুদি এবং শিয়াদের অনবরত চক্রান্তের ফলে হালাকু খান সিদ্ধান্ত নেয় বাগদাদ আক্রমণ করবে। সমস্যা বেধে যায় বাগদাদের সাথে সন্ধি থাকায়, পরবর্তিতে যদি আবার এ নিয়ে গ্রেট খানকে ম্যানেজ করতে বড়ভাই কুবলাই খানকে কাজে লাগায়। কুবলাই খান মঙ্কে খানকে রাজি করিয়ে বাগদাদ আক্রমণের গ্রিন সিগন্যাল পেলে হালাকু খান মঙ্গল, শিয়া, ক্রুসেডার, আর্মেনিয়ান ও জর্জিয়ান ক্যাভালরি মিলে হামলে পরে বাগদাদের উপর। লিখা হয় বাগদাদের রক্তাক্ত ইতিহাস।
ইলখায়ানাত তার রাজ্য বিস্তারে হামলা করবে তা অনুমেয়ই ছিল কিন্তু এত বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে তা কেও অনুমান করতে পারেনি। এদিকে বাতু খানের মৃত্যুর পর রাজ সিংহাসন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বারকে খান এই রক্তাক্ত বাগদাদের খবর পান প্রায় ৬ মাস পর। সংবাদ পেয়েই তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোষণা করেন অবশ্যই তিনি হালাকু খানের প্রতিটি মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নিবেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় তিনটি বিষয়।
১. গ্রেট খানের অনুমতিক্রমে হামলা হওয়ায় এখন যুদ্ধ মানেই সমগ্র মঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা।
২. হালাকুর সাথে যুদ্ধে গেলেই তার বড় ভাই কুবলাই খান সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
৩. আরবের ক্রুসেডাররা যেমন হালাকুর পাশে দাঁড়াবে, ঠিক তেমনি পশ্চিমে ইউরোপিয়ানরাও এই সুযোগে গোল্ডেন হর্দের উপর হামলে পড়বে।
এ সমস্যার কারণে একদিকে সরাসরি হালাকু খানের সাথে দ্বন্দ্ব জড়ানো যাচ্ছিলো না, অন্যদিকে যদি কিছু করা না হয় তবে ক্রুসেডার ও ইহুদীদের চক্রান্তে খুব দ্রুতই হালাকু খান ইসলামের পবিত্র ভূমিগুলোর দিকে এগিয়ে যাবে। সুতরাং এমন কিছু করতে হবে যেন হালাকু খানের এই অগ্রযাত্রা কিছুটা রোধ করা যায়, এবং টেম্পলার ও ক্রুসেডারদের একটা শিক্ষা দেয়া যায়। এই লক্ষ্যে বারকে খান হামলে পড়লেন পোল্যান্ডে। বারকে খানের ধোলাই খেয়ে পোপ শেষ পর্যন্ত রুল জারি করতে বাধ্য হলেন, যে কেউ মঙ্গলদের সাথে সম্পর্ক রাখবে তাকে খৃষ্টান দুনিয়া থেকে একঘরে করে দেয়া হবে। এ রুলসের কারণে এবার টেম্পলার, ক্রুসেডার, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া হালাকুখানকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হল। অন্যদিকে গোলন্ডেন হর্দ ও ইলখায়ানাতের কিছু সিমান্ত নিয়ে বারকে খান হালাকু খানের কাছে অভিযোগ করায় হালাকু খান বাধ্য হলেন তার সেনাবাহীনিকে দুইটি ভাগে ভাগ করতে। এক ভাগ সীমান্তে পাঠিয়ে অন্যভাগ নিয়ে এগিয়ে চলল সিরিয়া হয়ে ইসলামের পবিত্র ভূমিগুলোর দিকে।
হালাকু খান; Image Source: en.wikipedia.org
বারকে খান জানতেন হালাকু খানের শক্তি আরও কমিয়ে আনতে না পারলে বিপদের কোন সীমা থাকবে না। তাই ইলখায়ানাতের উত্তরাঞ্চলে খন্ড খন্ড হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি করায় বাধ্য হয়ে হালাকু খানকে তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরিয়া অভিমুখ থেকে ফিরিয়ে ককেশাসে নিয়ে আসতে হয়। একই সাথে মঙ্কে খানের মৃত্যু হলে কুরুতালাইয়ে যাওয়ার জন্য হালাকু খানের ডাক পড়ে। ফলে জেনারেল কিতবুকাকে ৩০ হাজার এলিট ফোর্স দিয়ে মূলবাহিনী সঙ্গে নিয়ে মঙ্গোলিয়ার দিকে রওনা হয়।
কিতবুকা যে বাহিনী পেয়েছিল তা দিয়েই আন্তর্দ্বন্দ্বে জড়ানো মুসলিম বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে ফেলা যথেষ্ট ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে মামলুকরা এক হয়ে যাওয়ায় এবং বারকে খানের চাতুরতায় টেম্পলার ও ক্রুসেডার যুদ্ধে আসতে না পারায় আইনে জালুতে কিতবুকা মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়। আফগানিস্তানের পর এটাই ছিল মঙ্গলদের সাথে মুসলিমদের প্রথম বিজয়। বারকে খান জানতেন হালাকু খান এ হামলার প্রতিশোধ নিবেই, এবং সে ঝড় থামানো মামলুকদের পক্ষ্যে থামানো সম্ভব না। এখন শুধুমাত্র তার কিছু সিদ্ধান্তই পারে মুসলিম অঞ্চলগুলোকে বাঁচাতে। তবে এ জন্যে তাকে অবশ্যই মঙ্গলদের মৃত্যু পরোয়ানা লিখতে হবে। বারকে খানের সামনে মঙ্গলদের সাথে নিয়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। মঙ্গলরা যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল যদি বারকে আর হালাকু এক হয়ে যেত সে ঝড় থামানোর কোন সুযোগতো মুসলিমদের ছিলই না, পশ্চিমের খ্রিষ্ঠান সম্মিলিত শক্তিও এ দুই শক্তির সামনে স্রেফ খড় কুটুর মত উড়ে যেত।
দুনিয়ার এত সফলতার আহবান থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও মুসলিমদের রক্ষা করার নেশায় বারকে খান মঙ্গলদের মরণপত্রে স্বাক্ষর করলেন। সভার শুরুতেই হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমনের কথা তুলে হালাকু খানের এহেন কুকর্মের প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলে কুবলাই খান বিরোধিতা করেন। হালাকু খান কুবলাই খানকে সমর্থন করে গ্রেট খান হিসেবে। বারকে খান নিজেই গ্রেট খান হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারতেন, তবে এর ফলে আইনের নানান চক্করে তিনি বাধা পরে যেতেন, ফলে মুসলিম ও ইসলাম রক্ষার নিমিত্তে তার অভিযানের পথ সংকোচিত হয়ে যেত। তাই নিজে প্রার্থী না হয়ে আরিক বোকাকে গ্রেট খান হিসেবে ঘোষণা করলেন। একদিকে হালাকু খান ও কুবলাই খান অন্যদিকে আরিক বোকা ও বারকে খান থাকাকায় কুরতালাইয়ের সদস্যরা নতুন খান নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এবার গ্রেট খানের চেয়ার নিয়ে আরিক বোকা ও কুবলাই খান দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায়।
আরিক বোকা; Image Source: en.wikipedia.org
সে দুজন দ্বন্দ্বে থাকা মানে কুবলাই ইচ্ছে করলেও আর হালাকুকে সাহায্য করতে পারবে না। এবার হালাকুর সীমান্তে একের পর এক হামলা চালাতে থাকেন, ফলে হালাকু খান আইনে জালুতের প্রতিশোধের চাইতেও নিজের সীমান্ত রক্ষায় বেশি ব্যাস্ত হয়ে পরেন। অন্যদিকে আনাতোলিয়ার তুর্কি গোত্রগুলোকে সহায়তা দিয়ে আরও শক্তিশালী করে তোলেন, যেন বাইজাইন্টাইন ও টেম্পলরা তুর্কিদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে থাকে, ফলে তারাও আর হালাকু খানের সাথে মিলে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে মাততে পারবে না।
কুবলাই খান; Image Source: en.wikipedia.org
কিন্তু কুবলাই খান কয়েক বছরের মাঝেই আরিক বোকাকে পরাজিত করায় হালাকু খানের সামনে আবারো আইনে জালুতের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ আসে। কুবলাই খান এ জন্য ৩৫ হাজার এলিট ফোর্সও প্রেরণ করে। এবার কূটনৈতিক অন্য কোন উপায় না থাকায় আজারবাইজানকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠা দ্বন্দ্ব নিরসনে বারকে খান সরাসরি হালাকু খানের মুখোমুখি হন, একটাই উদ্দেশ্যে তা হচ্ছে হালাকু খান যেন কোন ভাবেই মুসলিমদের পবিত্রভূমিগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে না পারে। অবশেষে তেরেক নদীর তীরে দুই বৃহৎ শক্তিশালী মঙ্গল বাহিনী মুখোমুখি হলে হালাকু খান পরাজিত হন ও তার লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়। ফলে হালাকু খানের কাছে আইনে জালুত থেকেও গোল্ডেন হর্দ ও ইলখায়ানাতের দ্বন্দ্বই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
এ যুদ্ধে একই টেক্টিক্স ফলো করায় ভয়ঙ্কর মঙ্গল যুদ্ধে বারকে খানের মূল বাহিনীও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিনি আফসোস করেই বলেছিলেন, যদি আমি মঙ্গল মঙ্গলে যুদ্ধ না বাধাতাম তবে মঙ্গলরা বিশ্ব জয় করতে পারতো। দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ক্রমাগতহারে বিভাজন সৃষ্ঠি হতে থাকে যা পরবর্তিতে মঙ্গল বিশ্বকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর এ সব কিছুই হয়েছে একজন মানুষের হাত ধরে নাম ‘বারকে খান’। আর তিনি এ সবই করেছিলেন শুধুমাত্র, একমাত্র, কেবলমাত্র ইসলামকে ভালবাসেন বলে। কোন এক অজানা কারণে ইতিহাস এ মহাবীরকে নিয়ে তেমন আলোচনা করেনি, তিনি সবার অলক্ষেই থেকে যাচ্ছেন। তাই এই মহান মর্দে মুজাহিদকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার ক্ষুদ্রে প্রয়াস চালালাম।
পরের পর্ব: দুর্ধর্ষ মঙ্গল সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে হয়েছিল
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন