মানুষের ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি ও আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধনের ক্ষেত্রে মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াজ-মাহফিল নতুন কোন বিষয় নয়। যুগযুগ ধরে তা নিজস্ব গতিতে চলে আসছে। মাহফিল শব্দটি শুনতেই হৃদয়ের গভীরে একটি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জন্ম নেয়। দেখেছি ছোট বেলায় ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলো মাহফিল মুখি। দূর-দুরান্ত থেকে সদলবলে ছুটে আসতো প্রিয় বক্তাদের বক্তব্য শুনতে। শ্রোতাদের অগভীর ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানার্জন করে ফিরে যেতো নিজেকে পরিবর্তন করার মানসে। বক্তা আর শ্রোতাদের মাঝে তৈরী হতো ভালোবাসার এক ঈমানী বন্ধন।
কিন্তু আজ সেই আবেগময় পরিবেশের সমাপ্তি ঘটতে শুরু করেছে। আজকের কথাগুলো খুব গভীর উপলব্ধি থেকে লিখছি। আশাকরি মনোযোগ সহকারে পড়ে নিজেদের মাঝে সচেতনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। কোন ব্যক্তি বিশেষে আজ আমার এ লেখা নয় বরং সামগ্রিক বর্তমান চিত্রটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছিমাত্র। সত্য কথা বলতে কি! যে ব্যক্তি বা জাতি নিজেদের ভুলগুলো দেখেনা তারা নিশ্চিত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যায়। পরিতাপের বিষয় হলো, কতো সুন্দর ইসলামের হুকুম আহকাম প্রচারকার্যে চালু হওয়া এ মাহফিল অর্থাৎ ধর্মীয় সভাগুলো আজ ক্রমান্বয়ে সমালোচনার জন্মদিয়ে নাট্যমঞ্চে পরিণত হতে চলেছে। বক্তাদের অশোভন আচরণ আর অমার্জনীয় বাচনভঙ্গির সাথে শ্রোতাদেরকে তুই তোকারি করে সম্মোধনের ফলে হেদায়েতের পথটি মোটামুটি বাধাগ্রস্তই হতে চলেছে।
আজকের বক্তারা ছোট্ট এ কথাটিও বুঝেনা যে চিল্লাইয়া নয় বরং বিনয়ী আচরণই মানুষের হৃদয়ে স্থান পেতে সহায়তা করেন। কিন্তু আজকে অনেক বক্তার বক্তব্যে বিন্দুমাত্র বিনয়ের লেশমাত্র নেই। শব্দচয়ণে তো তারা আজ রাস্তার ঔষধ বিক্রেতাকেও হার মানাচ্ছে। ইদানীং মাহফিল মানেই অন্যের সমালোচনায় পরিণত হয়েছে। বিষয়বস্তুর উপর কিতাব দেখা তো দূরের কথা এখন তারা মনেহয় ইউটিউবে ভিন্ন মতের বক্তাদের ভিডিও দেখেই হয়তো মাহফিলে যায়। নিজেকে আলেম হিসেবে দাবি করেন অথচ অশ্রাব্য ভাষার প্রয়োগ ক্ষেত্রে তারা অগ্রনেতা হিসেবেই আজ বিবেচিত। আরে ভাই- ভিন্ন মতের হোকনা কেউ, সেতো মুসলমান! সে ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যবহারই আপন জ্ঞানের মাধুর্যটি ফুটিয়ে তুলতে হবে আপনাকে।
এছাড়াও মাহফিল আয়োজকদেরও বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। হক্কানি আলেমদের মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু সুন্দর কণ্ঠ কিংবা মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও কোন মানুষের হিদায়াত হবেনা। এজন্য বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়! এভাবে চলতে থাকলে হিদায়াত আসবে কোত্থেকে ?
আফসোস! হিদায়াতের মাধ্যম নবী বন্দনার মাহফিলে আজ এক বক্তা আরেক বক্তাকে সম্মোধন করে “ওরে বাটপার ” “ওরে চিটার”। সেদিন অনলাইনে দেখলাম এক মাহফিলে বক্তা তার বক্তব্য দেয়ার প্রাক্কালে এক শ্রোতা বক্তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ” ওরে বাটপার “।
কি আশ্চর্য ! জনসম্মুখে এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে? ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে আজ কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? ওহে বক্তা, কী জওয়াব দিবেন কাল হাশরে আল্লাহর দরবারে? ইসলামের একজন দা-ঈ হিসেবে আপনি কতটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন?
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় প্রতি জুমাবারে মসজিদের খতিবরা নিয়মিত সমাজ বিনির্মানের খোতবা দেওয়ার পরেও কেন একটি মুসলিম সমাজে মাহফিল নামের এ ধর্মানুষ্ঠান করার প্রয়োজনীয়তা? এসব বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা চাই। শুধু দাওয়াতের নামে পকেট ভরা নয় বরং আপনাকে দিয়ে ইসলামের কতটুকু খেদমত হচ্ছে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা চাই।
এজন্য আমি বলি শুধু বক্তা আর একজন হক্কানি আলেম প্লাস বক্তার মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে। স্বরণে রাখা চাই যে, কোন আলেমের জবান থেকে অশোভন শব্দের ব্যবহার শ্রোতারা মোটেও আশা করেনা। ভক্তির আসরে বিষোদগার কিংবা কুৎসা রটনা তো আশাই করেনা। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় কিছু কথা বলা উচিৎ তার মানে এই নয় যে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে হবে। এতে শ্রোতারা কি শিখবে? এসব অবান্তর বক্তব্য দিয়ে কি আপনি মাহফিল এন্তেজামিয়া কমিটির হক আদায় করতে পারছেন? এতো পরিশ্রম আর ব্যয়বহুল এসব মাহফিলগুলো করার উদ্দেশ্যটা কি সেটা অন্তত আপনাকেই অনুধাবন করতে হবে। মাহফিলের উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা।
মানব মুক্তির দিশারি মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন , আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুই ঐ আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা হয় । (বাইহাকী)
দাওয়াতকারী আপনাকে দাওয়াত দিয়েছে শ্রোতাদেরকে হিদায়াতের মুখোমুখি দাঁড় করাতে। সমালোচনা কিংবা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরী করতে নয়। জানেন! পাষাণ প্রাচীরে ধর্মপ্রেমের আঘাত করে ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে ধার্মিকতা তৈরীর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মাহফিল করা। মূলত একজন মানুষ ধার্মিক হলে সে ধার্মিক ব্যক্তির মাধ্যমে সে সমাজটি পরিবর্তন হয়।
একসময় মানুষ মাহফিলে বসে হুজুরের নুরানি বয়ান শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করে যেতো। আর এখন সুবহানাল্লাহ বলতেও শ্রোতাদের বাধ্য করতে হয়! কেন? উত্তর কেবল একটাই মাহফিলের মাঝে খুলুসিয়ত নেই। বক্তার বক্তব্যে শ্রোতাদের হৃদয়ে রহমতের ঝর্ণা প্রবাহিত হয়না। বক্তা আজ শ্রোতাদের আমলের পরিবর্তন করার পরিবর্তে ফাসেকিতে নিমজ্জিত করছেন। এভাবেই যদি চলতে থাকে তো আগামীতে মানুষ তার সন্তানদের এসব মাহফিলে যেতেও নিষেধ করতে হয়তো বাধ্য হবেন।
সম্প্রতি দেখলাম এক বক্তার যে হাতে পবিত্র কুরআন, হাদিসের কিতাব উঠার কথা সেখানে মাহফিলে শ্রোতাদের সামনে একটি ইসলামি জলসায় পায়ের জুতা প্রদর্শন করছে! কুত্তার বাচ্চা বলে তার মতই আরেক বক্তাকে অবিহিত করছেন। খুবই মর্মাহত হলাম এমন চিত্র দেখে। আপনার সাথে মতের অমিল হলেও ইসলামে এমন শিক্ষার কোন স্থান নেই। ইসলাম বেয়াদবের ধর্ম নয়, ইসলাম শালীনতা প্রদর্শনকারীদের ধর্ম। এগুলো কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে আগামীর জন্য অমঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসবে।
আসুন, ইসলামকে জেনে বুঝে পালন করার চেষ্টা করি। মনে রাখবেন, যুগেযুগে অতি আবেগীদের দ্বারাই অনিয়ন্ত্রিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছে মুসলিম সমাজ। আল্লাহ বুঝার ক্ষমতা সবাইকে দান করুক।